ঢাকা : গৃহকর্মী থেকে শত শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। চাকরিচ্যুত সিপাহী হয়েও তিনি অবসরপ্রাপ্ত মেজর পরিচয় দিতেন বলে অভিযোগ।
নিবন্ধন না পেলেও ‘বাংলাদেশ জাতীয় বঙ্গলীগ’ নামের একটি রাজনৈতিক সংগঠন চালান তিনি; এই সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ আছে, তার প্রতারণার হাত থেকে রেহাই পায়নি ধর্মীয় উপাসানালয়ও।
তিনি শওকত হাসান মিয়া; বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউআইটিএসের (ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস) উপাচার্যকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে প্রায় ৬০ কোটি টাকা চাঁদা দাবির মামলায় গত ২৭ জুলাই তাকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।
এদিকে শওকত হাসান মিয়ার কারাগারে যাওয়ার পর বেরিয়ে আসছে তার প্রতারণার নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। তার উত্থান কাহিনী রূপকথার গল্পকেও যেন হার মানাবে। নদী ভাঙনে ঘর-বাড়ি হারিয়ে এক সময় ‘নুন আনতে পানতা ফুরোয়’ অবস্থা থাকলেও শওকত এখন শত শত কোটি টাকার মালিক। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে তার বিস্তর সম্পতি।
এক সময় কুমিল্লা সেনানিবাসের জনৈক মেজরের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োজিত এই শওকত মিয়া এখন থাকেন আলিশান বহুতল ভবনে, হাকিয়ে চলেন বিলাসবহুল গাড়ি। ধুপ-দুরস্ত পোশাক পড়ে চলেন সমাজের উঁচু তলার মানুষের সঙ্গে। মেইনটেইন করেন বেশ কয়েকজন বডিগার্ড। প্রশ্ন উঠেছে, এক সময়কার হতদরিদ্র এই শওকত কোন ‘আলাদিনের চেরাগের’ বদৌলতে ক’বছরেই হয়ে গেলেন এত বিত্ত-বৈভবের মালিক?
জানা গেছে, ১৯৭৭ সালে এক কর্ণেলের সুপারিশে এই শওকত আলী মিয়া সেনাবাহিনীর ৩৫, বেঙ্গল রেজিমেন্টে সিপাহী (নম্বর-৩৯৬৯৮১০) পদে চাকরি পান। যদিও চাকরিটি পেতে পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া শওকতকে অষ্টম শ্রেণীর জাল সনদ জোগাড় করতে পোহাতে হয়েছিলো বহু কাঠ-খড়। গুরুতর এক অভিযোগে ১৯৮৩ সালের ১৯ জুন সেনা কোর্টমার্শালের বিচারে চাকরিচ্যূত হন সিপাহী শওকত। আর এতেই যেন ‘শাপে বর’ হয় তার। বাইরে এসেই চাকরিচ্যুত শওকত বনে যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর! অভিযোগ রয়েছে, ভূয়া এই পরিচয় জাহির করে তিনি চট্টগ্রামে বাঁশ ব্যবসার অন্তরালে জড়িয়ে পড়েন বাংলাদেশ ও পাশ্ববর্তী দেশের ‘চোরাই’ কাঠ পাচার সিন্ডিকেটে। গড়ে তোলেন বিশাল ক্যাডার বাহিনী।
এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি শওকত হাসানকে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর পরিচয়ে ধরাকে সরাজ্ঞান করে পেয়ে যান তিনি আলাদীনের চেরাগ। আর সেই চেরাগ ঘষেই হতদরিদ্র শওকত আজ শত কোটি টাকার মালিক। অ্যাসার্ট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান তিনি। রাজধানীর গুলশান বারিধারার প্রগতি স্বরণী সড়ক সংলগ্ন বহুতল ভবন জামালপুর টুইন টাওয়ারটি তার। ঢাকা ও জামালপুরের বিভিন্ন এলাকায় প্লট-ফ্লাট ছাড়াও জমি কিনে গড়ে তুলেছেন একাধিক সুউচ্চ ভবন। বাংলাদেশ স্বাধীনতার ধারক-বাহক ঐতিহ্যবাহী ‘লীগ’ নামটি ব্যবহার করে তৈরী করেছেন তথাকথিত রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ জাতীয় বঙ্গলীগ’। বনে গেছেন এর প্রেসিডেন্ট। অভিযোগ আছে, এই দলকে ঘিরেও শুরু করেন অভিনব ‘চাঁদাবাজি’। অথচ ইসিতে বর্তমানে নিবন্ধিত ৪১টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে নেই এই দলের নাম! বঙ্গলীগ নামে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অনুমোদিত কোন অঙ্গ সংগঠন নেই বলে জানিয়েছেন দলটির একাধিক নেতাও।
প্রতারণা ছাড়াও জামালপুরের নিরীহ গ্রামবাসীর জমি জবরদখলের অভিযোগও রয়েছে শওকতের বিরুদ্ধে। অবঃ মেজরের ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে বঙ্গলীগের প্রেসিডেন্ট শওকত হাসান শুধু যে অন্যের জমি জবরদখল করেছেন তা নয়, ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে নিয়েছেন ডেসকোর বিদ্যুৎ সংযোগ। প্রভাব খাটিয়ে বছরের পর বছর ধরে জ্বালিয়েছেন সুউচ্চ ভবনে অবৈধ গ্যাস সংযোগও। যদিও এই চৌর্যবৃত্তির দায়ে তাকে জরিমানা গুনতে হয়েছিলো কয়েক লাখ টাকা।
সুচতুর শওকত শুধু সরকারের সঙ্গেই প্রতারণা করেননি। তার হাত থেকে রেহাই পায়নি ধর্মীয় উপাসানালয়ও। জনপ্রিয়তা পেতে সদলবলে বিরাট বহর নিয়ে শোডাউন করে বিভিন্ন মদজিদ-মাদ্রাসায় গিয়ে জনসম্মুখে লাখ লাখ টাকা অনুদান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও কথা রাখেন না প্রতারণার এই শিরোমনি। দেন না কোনও টাকা! পেশি শক্তির বলে নিরীহ অনেকের জমি জবরদখল, প্রতারণাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অতিষ্ট হয়ে শওকত হাসানের বিরুদ্ধে লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করা থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ প্রশাসনের কয়েকটি দপ্তরে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন গ্রামবাসী।
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১৪ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের (আইন-৩ অধিশাখা) তৎকালীন উপসচিব মো. খায়রুল আলম সেখ এক চিঠির মাধ্যমে ‘ভুয়া মেজর (অবঃ)’ শওকত হাসান মিয়ার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জামালপুরের পুলিশ সুপারকে (এসপি) দ্বিতীয় দফায় নির্দেশক্রমে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি।
প্রতারণায় সম্রান্তদেরও ছাড় দেননি শওকত। পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সমাজসেবায় একুশে পদকপ্রাপ্ত সূফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের স্বাক্ষর জাল করেও তিনি দাবি করেছেন অর্ধশত কোটি টাকা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অবশেষে ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেসের (ইউআইটিএস) উপাচার্যকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ৬০ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে ফেঁসে গেছেন ‘বাংলাদেশ জাতীয় বঙ্গলীগ’র প্রেসিডেন্ট শওকত হাসান মিয়া। এই চাঁদা দাবির ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বর্তমানে তিনি কারাগারে। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নির্দেশে গত ২৭ জুলাই থেকে শওকত কারান্তরীণ।
এদিকে জনৈক এক মেজরের বাসায় কর্মরত গৃহকর্মী শওকত হাসান কীভাবে স্বল্পসময়ে এত বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন, তা সঠিক তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে শওকতের বরাবর সম্পত্তির বিবরণাদি প্রদানের নোটিশ প্রদান করেছে। অভিযোগ দুদকের অধীনে বর্তমানে তদন্তাধীন।
ঢাকা এবং শওকতের গ্রামের বাড়ি জামালপুরের স্থানীয় বাসিন্দা ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে অধিকাংশ অভিযোগেরই সত্যতা পাওয়া গেছে। মিলেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্যও।
বঙ্গলীগের প্রেসিডেন্ট শওকত মিয়া বর্তমানে কারাগারে থাকায় এ সব অভিযোগের বিষয়ে তার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তার মনোনীত দু’জন আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাজমুল আলম ও বিউটি আক্তারের কাছে মামলার শেষ অবস্থার কথা জানতে চাইলে তারা বলেন, এই মামলা এখন আর তারা দেখছেন না। ফলে শেষ আপডেটের বিষয় অবগত নন তারা।
চাকুরিচ্যূত সিপাহী হয়েই বনে যান অবঃ মেজর!
শওকতের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরে দাখিল করা ভুক্তভোগীদের অভিযোগ সূত্র ছাড়াও জামালপুর ইসলামপুর এলাকার একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বঙ্গলীগ প্রেসিডেন্ট শওকত হাসানের বাবার নাম মোজাম্মেল হক মিয়া (মৃত)। গ্রামের বাড়ি জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলাধীন কুলকান্দী ইউনিয়নে। তার মা সিরিয়া খাতুন বিশ্বখাদ্য কর্মসূচীর আওতায় ইসলামপুরের ৭ নম্বর ইউনিয়ন পরিষদের ‘দুঃস্থমাতা কার্ডধারী বিধবা’ তালিকাভুক্ত।
মুক্তিযুদ্ধের আগে যমুনার ভাঙনে নদীগর্ভে ঘর-বাড়ি বিলীন হবার পর শওকতের বাবা জামালপুরের কুলকান্দি এলাকায় মাগুল মিয়া বাজারে ভিক্ষা করতেন। দানের টাকায় সচল রেখেছিলেন তিনি সংসারের চাকা। অন্যের বাড়িতে কাজ করেও চার সন্তানের মুখে দু-বেলা খাবার তুলে দিতে কষ্ট হত মা ও হতদরিদ্র বাবার।
শওকত হাসান নিজেও কুমিল্লা সেনানিবাসের এক মেজরের বাড়িতে গৃহভৃত্যের কাজ করতেন। ওই বাসা থেকে বিতারিত হয়ে যখন তিনি অথৈ সাগরে পরেন, তখন আলো হয়ে দেখা দেন জনৈক এক কর্ণেল। তার সুপারিশে শওকত আলী ১৯৭৭ সালে অষ্টম শ্রেণীর জাল সনদ দিয়ে সেনাবাহিনীর ৩৫, বেঙ্গল রেজিমেন্টে সিপাহী পদে চাকরি পান।
এদিকে পালে হাওয়া লাগতেই কুমিল্লার দেবীদ্বার থানায় কর্মরত পুলিশের এক এসআইয়ের কন্যাকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করেন শওকত। বছরটি ছিলো ১৯৮০ সাল। ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান হবার পর উধাও হয়ে যান তিনি। প্রায় দুই বছর ধরে ছিলেন লাপাত্তা। এদিকে পালিয়ে বিয়ে করায় ঘরে উঠতে পারছিলেন না তার স্ত্রী। অনেক খোঁজাখুঁজির পর কোলের সন্তানকে নিয়ে শওকতের চট্টগ্রামের কর্মস্থলে হাজির হন তিনি। স্বামীর সহকর্মীদের কাছে জানতে পারেন- চট্টগ্রামের এক মেয়েকে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন শওকত। উপায়ান্তর না পেয়ে প্রথম স্ত্রী চট্টগ্রামের কাপ্তাই সেনা ক্যাম্পের ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে শওকতের বিরুদ্ধে নালিশ করেন।
অভিযোগে সত্যতা পেয়ে ১৯৮৩ সালের ১৯ জুন সেনা কোর্টমার্শালের বিচারে চাকরিচ্যূত করা হয় সিপাহী শওকতকে। এরপর চাকরিচ্যুত সেই শওকত বনে যান ‘অবসরপ্রাপ্ত মেজর’! ভূয়া এই পরিচয় জাহির করে তিনি বাঁশ ব্যবসার অন্তরালে জড়িয়ে পড়েন বাংলাদেশ ও পাশ্ববর্তী দেশের ‘চোরাই’ কাঠ পাচার সিন্ডিকেটে। এই কাঠ ব্যবসার অন্তরালে বিভিন্ন অবৈধ কাণ্ড চালিয়ে বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক হন তিনি।
অবসরপ্রাপ্ত মেজরের ভুয়া পরিচয়ে নিয়েছেন বিদ্যুৎ সংযোগ
সবখানেই অবঃ মেজরের পরিচয় দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতেন শওকত মিয়া। তিনি এতটাই বেপরোয়া ছিলেন যে, রাজধানীর মিরপুরে আরামবাগ হাউজিংয়ের ই-ব্লকের ৭ নম্বর সড়কের ১৪-ই নম্বর তার নিজস্ব ভবনে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিঃ (ডেসকো)-এর বৈদ্যুতিক লাইন নেওয়ার আবেদনেও নিজেকে মেজর অবঃ হিসেবে পরিচয় দেন। তার নামে নেওয়া দুটি মিটারের বিলে নাম ও ঠিকানার স্থলে- মেজর (অবঃ) সওকত হাসান মিয়া লেখা দেখা গেছে। ভুয়া মেজর সেজে নেওয়া ওই বিদ্যুতের মিটারের বিলের ফটোকপি এসেছে আমাদের সময়ের কাছেও।
ধর্মীয় উপাসানালয়ও তার প্রতারণার হাত থেকে রেহাই পায়নি
জামালপুর ইসলামপুরের একাধিক গ্রামবাসী বলেন, রিজেন্টের শাহেদের মত শওকত হাসানও একজন উচু মাপের প্রতারক। সিপাহী হয়েও ভুয়া মেজর পরিচয় দিয়ে প্রভাব বিস্তার করে গ্রামে। বিভিন্ন ধর্মসভায় ‘প্রধান অতিথি’ হওয়ার জন্য প্রলোভন দেখিয়ে তার ম্যানেজার ও কিছু বখাটে-বাটপার দালাল চক্রের মাধ্যমে মাদ্রাসা, মসজিদ, ঈদগাহ, কবরস্থানের কমিটির লোকজনের কাছে বলেন যে, বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে তাকে প্রধান অতিথি করলে পাঁচ-দশ লক্ষ টাকা অনুদান দেবেন। তবে প্রচারপত্রে তার নামের সাথে আলহাজ্ব, দানবীর, শিক্ষানুরাগী ইত্যাদি উপাধি উল্লেখ থাকতে হবে এবং তাকে অনার করে নেওয়ার জন্য ২০ থেকে ২৫টি মটর সাইকেল বহরসহ যেতে হবে।
জনপ্রিয়তার সস্তা প্রচারণা পেতে এভাবে তিনি অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের ধর্মসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুই লক্ষ থেকে দশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অনুদান দেয়ার প্রতিশ্রুতি করেছেন। কিন্তু অদ্যাবধী কোন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি শওকত। প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে বিভিন্ন জনাকীর্ণ অনুষ্ঠানে নিজের নাম জাহির করেছেন মাত্র। তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি তার কাছে টাকা চাইতে গেলে শওকত অকপটে বলেন যে- সেই টাকা তো ওই প্রতিষ্ঠানের কমিটির কাছে হস্তান্তর করেছি। পরবর্তীতে কমিটির সাথে কথা বললে তিনি যে জলজ্যান্ত মিথ্যা বলেছেন তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু তার বাহিনীর ভয়ে এই অন্যায়ের প্রতিবাদে মুখ খুলতে সাহস পায় না গ্রামবাসী।
সম্প্রতি ইসলামপুরের ‘মুখশিমলা বাজার ওয়াক্ত জামে মসজিদ’কে কেন্দ্র করে নজির বিহীন ঘটনার জন্ম দিয়েছেন তিনি। সস্তা প্রচারণা পেতে জনাকীর্ণ এক মজলিসে মসজিদটি নতুন করে গড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন শওকত। তার কথা মতো টিনসেড মসজিদটি ভেঙে দেওয়ার পর বহুবার শওকতের কাছে টাকা চাওয়া হয়। কিন্তু অদ্যাবদি সাড়া দেননি তিনি। উল্টো অপমানিত হতে হয় মসজিদ কমিটির লোকজনকে।
এর মাঝে তিনি কিছু রড-সিমেন্ট দিয়েছিলেন মসজিদ গড়ার জন্য। পরবর্তীতে লোকজন দিয়ে সেই রড-সিমেন্টও তিনি ফেরত নিয়ে যান বলে মসজিদ কর্তৃপক্ষের ভাষ্য। এ অভিযোগের বিষয়ে গতকাল শনিবার ‘মুখশিমলা বাজার ওয়াক্ত জামে মসজিদ’ কমিটির সভাপতি নুরুজ্জামান নুন্নু মিয়ার (সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার) সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। কিন্তু জীবনের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজী হননি তিনি।
পেশী শক্তির বলে জমি দখল
শওকত হাসান নিজেকে অবঃ মেজর পরিচয় দিয়ে ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলায় অনেকের জমি দখল করেছেন এমন অভিযোগ রয়েছে। এমনই একজন ভুক্তভোগী ইসলামপুরের মুখশিমলা গ্রামের বাসিন্দা মো. আব্দুল আজিজ প্রধান। তিনি জানান, অবঃ মেজর পরিচয়ে প্রভাব খাটিয়ে জামালপুরের হরিয়াবাড়ি এলাকায় আ. আজিজের ৪৯ শতাংশ জমি জবরদখল করে সেখানে মাছের ঘের তৈরী করেছেন শওকত। এখন নিজের জমির কাছে নিজেই যেতে পারেন না বয়ঃবৃদ্ধ আজিজ প্রধান। ইসলামপুরের সালদার ব্যাপারী পাড়ায় অন্যের প্রায় ১৬ বিঘা জমির উপর জোর করে দেয়াল তৈরী করেছেন শওকত। কিন্তু সেখানকার দরিদ্র চুরি তৈরির ব্যবসায়ীরা তার বাহিনীর ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পায় না বলেও আজিজ প্রধান জানান।
নিবন্ধন না পেলেও দলের নাম ভাঙিয়ে করেন চাঁদাবাজি
২০১৫ সালে আত্মপ্রকাশ ঘটা ‘বাংলাদেশ জাতীয় বঙ্গলীগ’ নামের দলটি রাজনৈতিক বা সরকারের সংশ্লিষ্ট কোনও দপ্তর থেকে নিবন্ধন না পেলেও শুরু থেকেই চাঁদাবাজী শুরু করে দেন সংগঠনের প্রসিডেন্ট শওকত। তার চাঁদাবাজীর প্রথম টার্গেট নিজ দলেরই নেতা-কর্মীরাই।
জানা গেছে, ঋণ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে হাজার হাজার নারী-পুরুষকে নতুন এই রাজনৈতিক দলের সদস্য করা হয়। তাদের কাছ থেকে দৈনিক, সাপ্তাহিক ভিত্তিতে আদায় করা হয় চাঁদার টাকা। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার সদর ইউনিয়নের মুসলিমবাগ এলাকায় প্রতারণার মাধ্যমে সদস্য সংগ্রহ করতে গেলে মোছাম্মদ রুনা বেগম ও আয়শা বেগম নামে দলের দুই মাঠকর্মীকে আটক করে পুলিশে দেয় স্থানীয়রা।
আটকরা পুলিশকে জানায়, বঙ্গলীগের হয়ে নারী-পুরুষ সমন্বয়ে ভাগ হয়ে মাঠপর্যায়ে চাঁদার টাকা তোলেন তারা। সিলেটের ইকবাল হোসেন নামে এক ব্যক্তি মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলে তাদের এই কাজে লাগান। আটকরা প্রায় দেড় হাজার সদস্য সংগ্রহ করে উত্তোলিত চাঁদার সব টাকা তারা জনৈক ইকবাল হোসেনকে দেন। তাদের বলা হয়েছিল, পাঁচ হাজার টাকা করে ঋণ দেওয়ার কথা বলে সদস্যদের কাছ থেকে ৪০ টাকা করে চাঁদা আদায় করার জন্য। তারা সেভাবেই কাজ করছেন। ২০১৫ সালের আগষ্ট মাসের আলোচিত এই ঘটনাটি তখন বিভিন্ন পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়েছিলো।