কাফকোর দূষণ আনোয়ারায়, অথচ সিএসআরের কোটি টাকা পেল বরিশাল


জিন্নাত আয়ুব, আনোয়ারা (চট্টগ্রাম) : বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানির (কাফকো) পক্ষ থেকে গত দুই অর্থবছরে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) খাতে প্রায় এক কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে বরিশালের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে। কবরস্থানের উন্নয়ন থেকে শুরু করে উড়োজাহাজে বরিশালে যাওয়া-আসা কিংবা বরিশালে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার বিলও পরিশোধ করা হয়েছে ওই খাত থেকে। মূলত কাফকোর সদ্য অবসরপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বাড়ি বরিশালে হওয়ার সুবাদেই ওই টাকা সেখানে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পারে আনোয়ারা উপজেলায় কাফকোর অবস্থান হলেও করপোরেট সামাজিক খাত থেকে একটি টাকাও ওই এলাকার মানুষের ভাগ্যে জোটেনি। বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বরিশাল অঞ্চলে। অথচ কাফকোতে সার উৎপাদন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার হয়ে থাকে কারখানার আশপাশের মানুষ ও পরিবেশ। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের পেশাজীবীরা।

টিআইবির সাধারণ পর্ষদ সদস্য প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার এ প্রসঙ্গে বলেন, কাফকো প্রতিষ্ঠার পর আশপাশের এলাকায় মারাত্মকভাবে পরিবেশদূষণ হয়। ফলে কাফকোর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ সেখানে আছে। এ ছাড়া কাফকো এলাকায় অনেক গরিব মানুষের বাস। বহুজাতিক এই প্রতিষ্ঠানের সিএসআর খাতের বরাদ্দ অর্থের দাবিদার তারাই। কিন্তু তাদের পাশ কাটিয়ে পুরো টাকা বরিশালে বরাদ্দ দেওয়াটা শুধু অন্যায় নয়, দুর্নীতিও।

জানা গেছে, কাফকোর সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হালিমের বাড়ি বরিশালে। এই সাবেক শিল্পসচিব গত মে মাসে চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। নিয়ম অনুযায়ী শিল্পসচিব কাফকোর চেয়ারম্যান থাকেন। কাফকোর চিফ করপোরেট অফিসার (সিসিও) রবিউল হক চৌধুরীর হাত দিয়েই এই পুরো টাকার বরাদ্দ বরিশালে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

কাফকোর আইনে ১০০ ইউএস ডলার কিংবা সমপরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রার বেশি অর্থের পণ্য নগদে কেনার সুযোগ নেই। এর বেশি কেনাকাটা করতে হলে তাতে কাফকোর ক্রয় কমিটির অনুমোদন লাগবে কিংবা ওই কমিটিই তা কিনবে। রবিউল হক চৌধুরী এই আইনের ধার ধারেননি। তিনি নিজেই সব কিছু কিনেছেন করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার টাকায়। আর বিলটি ধরিয়ে দিয়েছেন কাফকোকে। করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার এক কোটি টাকার মধ্যে ৮৩ লাখ ৮৯ হাজার ৮৬১ টাকা তিনি এভাবেই ব্যয় করেছেন।

প্রাপ্ত তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, বিগত ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরিশালের ফজলুল হক স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে সাড়ে ১২ হাজার, কম্পিউটার ও সায়েন্স ল্যাবের জন্য ১৫ লাখ ৬৮ হাজার, ল্যাপটপ বাবদ তিন লাখ ৯৪ হাজার, আইসিটি ল্যাবের জন্য এক লাখ ১২ হাজার ১৬৬, কম্পিউটার সেটআপের জন্য দুই লাখ ২১ হাজার ৬৮৬ ও সায়েন্স ল্যাবের জন্য দুই লাখ ১৩ হাজার ৬৬০ টাকা; ছারগরিয়া মসজিদে অনুদান হিসেবে দুই লাখ, ঢাকা থেকে বরিশালে যাওয়া-আসার উড়োজাহাজ ভাড়া ৬৮ হাজার ৪০০, বরিশালের আরেকটি স্কুলের কম্পিউটার ল্যাবের জন্য পাঁচ লাখ, আরেক স্কুলের ল্যাপটপ কিনতে আট লাখ ১৪ হাজার ১১৩, শেরেবাংলা স্মৃতি বৃত্তির জন্য পাঁচ লাখ, হালতা হাজিবাড়ী কবরস্থান উন্নয়নে ৯ লাখ, এ হাশেম বালিকা মাদরাসায় দেড় লাখ, ঢাকার সুরের ধারা স্কুলের জন্য সাত লাখ, হালতা স্কুলের জন্য ডোনেশন পাঁচ লাখ, ওই স্কুলে ল্যাপটপের জন্য সাত লাখ ৬৪ হাজার ৩১০, নামহীন প্রতিষ্ঠানের ল্যাবের যন্ত্রপাতি কিনতে এক লাখ ১২ হাজার ৭৫২, বরিশালে হোটেলে থাকার বিল এক লাখ ৫৮ হাজার ২৫৪, বরিশাল আলতাফ স্কুলে পাঁচ লাখ এবং মুকুল স্মৃতি স্কুলে সাত লাখ টাকা ডোনেশন দেখানো হয়েছে।

এভাবে অর্থ বরাদ্দের ব্যাপারে জানতে কাফকোর চিফ করপোরেট অফিসার (সিসিও) রবিউল হক চৌধুরীর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বারবার ফোনের সংযোগ কেটে দেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জিএম (এডিমন) গাউছুল আজম সিদ্দিকী বলেন, এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। এসব ঢাকা অফিস থেকে ‘প্রসেসিং’ হয় বলে বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি।

উল্লেখ্য, কাফকোতে তিন বছর ধরে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নেই। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) ও প্রধান করপোরেট কর্মকর্তা (সিসিও) মিলেই মূলত কাফকোর মূল সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে থাকেন। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটির ৪৯ শতাংশ শেয়ার বাংলাদেশ সরকারের; আর ৫১ শতাংশ শেয়ার বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের।