রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

যেভাবে হামকা নুর আলমের উত্থান

প্রকাশিতঃ ২৩ জানুয়ারী ২০১৭ | ১২:৪৯ অপরাহ্ন

শরীফুল রুকন: চট্টগ্রামের অন্যতম অপরাধ নিয়ন্ত্রক তিনি। তার বিরুদ্ধে পাঁচ বছর আগেও ছিল ৩৫টির বেশী মামলা। এর মধ্যে বেশকিছু মামলায় ইতিমধ্যে খালাস পেয়েছেন তিনি। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ১৪টির বেশী; এরমধ্যে ৬টি অস্ত্র মামলা। প্রতি মাসে মামলার পেছনে তার ব্যয় হয় ৩০ হাজার টাকার বেশী। এসব তথ্য চট্টগ্রামের ভয়ংকর ছিনতাইকারীদের গ্রুপ ‘হামকা বাহিনীর’ একাংশের প্রধান নুরুল আলম ওরফে হামকা নুর আলমের।

মামলার ভারে জর্জরিত নুরুল আলম জানিয়েছে, সে কিংবা তার পরিবার এই জীবন চায়নি। অন্যায়ের বিচার না পেয়ে আইন হাতে তুলে নিতে গিয়ে তার এই করুণ পরিণতি। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর এ প্রতিবেদকের কাছে জানিয়েছে, কিভাবে অপরাধীর খাতায় নাম লিখিয়েছে সে; তার বিরুদ্ধে এত বেশী মামলার জন্য অভিযোগের আঙুল তুলেছে পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রতিও।

অপরাধে জড়ানোর আগে ঘর ছেড়ে সাব-কন্ট্রাক্ট্রে পোশাক কারখানার কাজ শুরু করেন নুরুল আলম। কি পরিস্থিতিতে ঘর ছেড়েছিলেন তাও জানিয়েছেন তিনি, ‘বাসায় মদ খেত বাবা, জুয়া খেলতো। এসব নিয়ে মায়ের সাথে ঝামেলা হতো। মাকে ধরে বাবা মারতো। এসব আমি সহ্য করতে পারতাম না। বাবার গায়ে হাত তুলতে হয়েছে। আর বিকল্প কোন পথ ছিল না। মাকে বলি, হয়তো বাবার কাছে থাকো, নয়তো আমার কাছে চলে আসো। আমি আলাদা বাসা নেব। কিন্তু আমার মা কিছুই বলেনি। শেষ পর্যন্ত ঘর থেকে আমি বের হয়ে আসি।’

অপরাধী হয়ে উঠার নেপথ্যে কারণ বর্ননা করেন হামকা নুর আলম, ‘২০০০ সালের আগের ঘটনা। গার্মেন্টেসের সাব-কন্ট্রাক্টরি করতাম তখন। ৫০ হাজার টাকা চাঁদা চাইলো সুলতান কবির ও সালাম। তখন মগের মুল্লুক ছিল আরকি। কাজ করলে চাঁদা দিতে হতো। আজকে দেবো, কালকে দেবো বলে তাদেরকে আমি টাকা দিইনি। দিতে না পারায় একদিন বায়েজিদের বাংলাবাজারে বাবাকে ছুরি মারে তারা। থানায় গেলে বলে মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়ে আসো। তারপর মামলা হবে। কোন উদ্যোগই নিল না। এরপর মেডিকেলে নিয়ে গেলাম। সার্টিফিকেট আনার পর বলে অরজিনাল সার্টিফিকেট লাগবে। পুলিশ বিচার করলো না। বাবার প্রতি আমার ঘৃণা কাজ করতো। তারপরও বাবাকে যখন ছুরি মারলো চুপ করে থাকতে পারিনি। হাজার হলেও বাপ তো। তবে প্রতিশোধ নেয়ার আগেই বাবাকে ছুরি মারা চাঁদাবাজরা গণপিটুনিতে মারা যায়।’

উপরোক্ত ঘটনাটি অপরাধী হওয়ার পেছনে টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে জানিয়ে নুরুল আলম বলেন, ‘ঘটনার পর আমি অনেক চিন্তা করছি। না খেয়ে ছিলাম, পাহাড়ে পাহাড়ে ছিলাম। পরে গোলাম সরওয়ার মিলনকে নিয়ে হামকা গ্রুপ গঠন করি। ঢাকাইয়্যা আলমগীর পরে আমাদের গ্রুপে যোগ দেয়। এরপর নানা কারণে তিনজন পৃথক হয়ে যাই। এই পথে আসার আগে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমাকে এমন ক্ষমতাবান হতে হবে। যাতে একটা অপরাধ দিয়ে ১০টা অপরাধ বন্ধ করতে পারি। এক সাথে আমরা ২০টা পিস্তল নিয়ে ঘুরেছি, এমন দিনও গেছে। ২০টা পিস্তল দিয়ে অনেককিছুই করতে পারতাম। পোলাপাইন যেগুলো ছিল, তাতে সবকিছুই সম্ভব।’

নুরল আলম দাবি করেন, ‘জীবনে আমি কাউকে একটা ছুরিও মারিনি। এক কোটি টাকাও ছেড়ে দিয়েছি। কারণ ছুরি মারতে হবে। আমার সাথে থেকে একজনে একবার ছুরি মেরেছিল, তাকে সাথে সাথে দল থেকে বের করে দিয়েছি, জেলে ঢুকাই দিছি। নিজেদের অর্জন দেখানোর জন্য অনেকবার অস্ত্র দিয়ে পুলিশ আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।’

হামকা নুর আলমের মতে, ‘কেউ একটা অপরাধ করলে, আর ১০টা অপরাধ অটোমেটিক করছে। একবার জেলে গিয়ে ‘ভালো’ মানুষের সাথে পরিচয় হচ্ছে। রাজনীতিক-প্রভাবশালীরা আশ্রয় দেয়, গুন্ডামী করার জন্য। বড় বড় সব অপরাধ রাজনীতিকরাই করাচ্ছে, এরাই সবকিছু করাচ্ছে। রাজনীতিকের বাইরে কেউ নেই।’

‘সিন্ডিকেট করে সবকিছুর দাম বাড়াচ্ছে। সারা বছর চাষ করে কৃষক পেট চালাইতে পারছে না। ১০ টাকা করে কিনে নিয়ে ৩০-৪০ টাকা বিক্রি করতেছে। সরকার এই অনিয়ম ভাঙতে পারেনা? সরকার চাইলে কিনা পারে? দুই টাকা দিয়ে কিনে তিন টাকা বিক্রি কর, নইলে চার টাকা বিক্রি কর। দুই টাকা দিয়ে কিনে আট টাকা তো বিক্রি করতে পারছ না। গরীব নিচেই নামতেছে, গরীব গরীবই থেকে যাচ্ছে। পয়সাওয়ালারা পয়সাওয়ালাই হচ্ছে। ২০ কোটি মানুষের এই দেশে সবার হক তো সমান আছে, আছে না? দুই-চার, পাঁচ’শ জনে পুরো ২০ কোটি মানুষের হক খাইতেছে। কে করবে এদের বিচার? রাজনীতিতে একটা ভালো মানুষ পোস্টে যেতে পারছে, বলেন?’

নুরুল আলম তার এই পরিণতি সম্পর্কে বলেন, ‘জীবনে অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু তার কিছুই হলো না। মানুষ এখন আমাকে হামকা নুর আলম বলছে। আর এটাই এখন আমার পরিচয় হয়ে গেল! নুরুল আলম বললে কেউ চিনে না। সবার চোখে আমি বড় অপরাধী।’

৫ বছর আগে বিয়ে করা নুরুল আলমের এখন চার বছর বয়সী একটি ছেলে সন্তান আছে। মাসখানেক আগে কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান নুরুল আলম। কারাগারে বন্দি থাকাবস্থায় সেখানে মাদক ব্যবসার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। এ প্রসঙ্গটি তুলতেই বাকরুদ্ধ কন্ঠে নুরুল আলম বলেন, ‘কারাগারে গুটির (ইয়াবা) ব্যবসা করেছি ফ্যামিলির জন্য। ফ্যামিলিকে ভালো রাখার জন্য। ফ্যামিলি ভালো থাকেনি। মনে অনেক যন্ত্রণা। আমাকে কেউ কোনদিন বুঝতে পারেনি, বুঝতে চায়নি।’ এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন নগর পুলিশের তালিকাভুক্ত এই অপরাধী।

পুলিশের খাতায় নুরুল আলমের বর্তমান ঠিকানা- শেরশাহ, বাংলাবাজার সিরাজের কলোনী, বায়েজিদ বোস্তামী, চট্টগ্রাম। জানতে চাইলে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘হামকা নুর আলম বর্তমানে আমার থানা এলাকায় বসবাস করে না। তাকে ছিনতাইকারীদের দলনেতা ও চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে আমরা জানি। সে খুবই ধুরন্ধর, কল্পনাতীত মাত্রার খারাপ প্রকৃতির লোক। তবে সে ভালো হতে চাইলে পুলিশ তাকে সেই সুযোগ দেবে। প্রয়োজনে পুলিশ তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে।’