একুশে প্রতিবেদক : চট্টগ্রামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রোকসানা জাহানের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। থাকতেন চকবাজার এলাকায় একটি মেসবাড়িতে। বাড়িভাড়া আর আনুষঙ্গিক খরচ মিলে মাসে সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ পড়তো। টিউশনির টাকায় চলতো সেই খরচ। আর বাকি টাকা গ্রামে পাঠাতেন। কিন্তু ভয়াল করোনার থাবায় পাল্টে গেছে হিসেবের খাতা। গেলো সাড়ে তিন মাস ধরে বন্ধ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেই সাথে বন্ধ হয়ে গেছে তাঁর টিউশনির চাকা। উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নিদারুণ আর্থিক কষ্টে চলছে তাঁর দিন।
একুশে পত্রিকার সাথে কথা বলতে গিয়ে এক প্রকার কান্নায় ভেঙে পড়েন রোকসানা। কান্না সংবেদন করে তিনি জানান, নগরের খুলশি মুরাদপুর আর জামালখানে তিনটি টিউশন করিয়ে মাসে ৯ হাজার টাকা পেতেন। এই টাকায় নিজের পড়াশোনা, যাবতীয় খরচ মিটিয়ে বাড়িতে পাঠাতেন। বাসায় অসুস্থ বাবা। বড় ভাই বিয়ের পর নিজ পরিবার নিয়ে আলাদা থাকছেন। ছোট বোন বাড়ির একটি প্রাইমারি স্কুলে পড়ছেন। ফলে তাঁকেই পরিবারের হাল ধরতে হয়েছে। করোনার প্রথম দিকেও কিছুদিন টিউশন করালেও, সংক্রমণ ঝুঁকিতে অভিভাবকরা টিউশনে আসতে বারণ করেন। এপ্রিলে চট্টগ্রামে ছেড়ে গ্রামে আসেন। এমন আর্থিক কষ্টের মধ্যে মেসভাড়ার জন্যও তাগাদা দিচ্ছেন কেয়ারটেকার।
করোনাভাইরাসের এমন দুঃসময়ে রোকসানার মতো টিউশন করে চলা শিক্ষার্থীরা পার করছেন অসহ্য কষ্ট, চরম সঙ্কট। আবাসিক হলের বাইরে যারা মেস বা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন তাদের কষ্ট বহুগুণে বেশি। এমন কষ্ট আর কতদিন বয়ে চলতে হবে, এর উত্তর জানা নেই কারও কাছে। হতাশা আর অবসাদ ভর করছে এসব শিক্ষার্থীদের মনে।
ইউজিসির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৪৬টি পাবলিক ও ১০৫ টির অধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়া আছে অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে পাবলিক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা টিউশন করে পড়াশোনা করেন, পরিবারে সাহায্য করেন। টিউশন ঘিরে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু কোচিং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সহযোগী অধ্যাপক মনজুরুল আলমের সাথে কথা বলে এমন পরিসংখ্যানের কিছুটা আঁচ পাওয়া গেছে। তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, এখন পর্যন্ত সাড়ে তিনশ’ শিক্ষার্থীকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে আরও দেড় থেকে দুইশ’ শিক্ষার্থীর অ্যাকাউন্টে সহায়তা দিব। প্রতি শিক্ষার্থী আড়াই হাজার টাকা করে পেয়েছেন। এর মাঝে যেসব শিক্ষার্থীর বাবা নেই, শারীরিকভাবে অসুস্থ তাদের ক্ষেত্রবিশেষে বেশি অর্থ দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের সহায়তার কথা বিবেচনা করে শিক্ষকরা একদিনের বেতন সংগঠনের হাতে তুলে দিয়েছেন। এর পাশাপাশি নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষক দুলক্ষ টাকা প্রদান করেছেন। এছাড়া সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রোটারি ক্লাব ও সানসাইন নামে একটি দ্রাতব্য প্রতিষ্ঠান দেড় লক্ষ টাকা দিয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ১৭ মার্চের পর থেকে বন্ধ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এমন নির্দেশনা অগাস্ট পর্যন্ত বহাল রয়েছে। তবে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকিতে এ বন্ধ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। যার কারণে শিক্ষার্থীদের সংকট সহসায় কাটছে না। সেই সাথে বাড়ি বা মেস ভাড়া নিয়ে বাড়তি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষার্থী একুশে পত্রিকাকে বলেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত একটি কটেজে থাকতেন। সপ্তাহে শাটল ট্রেনে যাতায়াত করে দুইটি টিউশন করতেন। এই টাকায় নিজের পড়োশোনাসহ যাবতীয় খরচ মেটাতেন। করোনার কারণে তাঁর টিউশন বন্ধ। কটেজে বইসহ মালামাল রেখে আসায় মালিক ফোন করে ভাড়া পরিশোধ করতে তাগাদা দিচ্ছেন। বাসায় টাকা চাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই।
পরিসংখ্যান বিভাগের আরেক এক শিক্ষার্থী আর্থিক অনটনের ছোবল থেকে বাঁচতে বেছে নিয়েছেন মুদি দোকানের কাজ। একুশে পত্রিকার কাছে পরিবারের আর্থিক অনটনের কথা বললেও নাম প্রকাশ করতে চাননি তিনি। এর মাঝে কেউ কেউ আবার অনলাইনে টিউশন পড়াচ্ছেন।
এদিকে দীর্ঘ পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ থাকায় অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভিভাবক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সেক্ষেত্রে সকল শিক্ষার্থীর ইন্টারনেট সুবিধা রয়েছে কিনা সেটিও ঘুরেফিরে আলোচনায় আসছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সহযোগী অধ্যাপক মনজুরুল আলম একুশে পত্রিকা বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পেক্ষাপটে এমন সুবিধা সবার ক্ষেত্রে চালু করা কঠিন। কোন প্রক্রিয়ায়, কোন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার হবে, শিক্ষার্থী ছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেভাবে প্রস্তুত কিনা এসব বিষয়ও ভাবতে হবে। বিশ্বের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এক্ষেত্রে দুটি প্ল্যাটফর্মেরর সুযোগ রাখছে। এসব বিষয় বিবেচনা না করলে এটি শিক্ষার্থীদের জন্য কাউন্টার অ্যাটাক হয়ে যেতে পারে। শিক্ষার্থীরা হতাশায় ভুগছে, তাদের প্রস্তুত করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক প্রণোদনার দেওয়া গেলে এর সুফল গ্রহণ করা যাবে।
শিক্ষার্থীদের সেশনজোটসহ মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখতে অনলাইন ক্লাস সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসির) সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন। তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, দুর্যোগপূর্ণ এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা যাতে পড়াশোনা করতে পারে সে বিষয়টি মাথায় রেখে এমন পরিকল্পনা করা হয়েছে। একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর কোথাও কিন্তু একই সুবিধার সবাইকে একীভূত করা সম্ভব নয়। এরপরেও আমরা শিক্ষামন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রীকে জানিয়েছে। যাতে করে শিক্ষার্থীরা সুবিধা পায়। সরকার আন্তরিক, সহানুভূতিশীল হয়ে বিষয়টি পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নিবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। একইসাথে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সহায়ত কামনা করছি।
একুশে/আরকে