আইনজ্ঞরা মানুষের সুখ-দুঃখ নিয়ে খেলেন : শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন

তৌফিকুল ইসলাম সৌরভ, অমিতি সাহা : শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড স্টাডিস, বাংলাদেশ আনসার একাডেমি, পুলিশ স্টাফ কলেজসহ বিভিন্ন সরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও বেসরকারি বিশ্ববিবদ্যালয়ে ‘ভিজিটিং লেকচারার’ হিসেবে বক্তৃতা করেন।

তার লেখা ‘থিয়োরেটিক্যাল অ্যান্ড এ্যাপ্লায়িড ক্রিমিনোলজি’, ’হিউম্যান রাইটস ট্রেনিং ম্যানুয়াল ফর পুলিশ’ ও ’হ্যান্ডবুক অব ক্রিমিনোলজি, ক্রিমিনাল জাস্টিস, ভিক্টিমোলজি অ্যান্ড রেস্টোরেটিভ জাস্টিস’ তিনটি বই বাংলাদেশের আইন, বিচার ও অপরাধ জগতে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে।

তিনি একজন খ্যাতিমান কলামিস্ট। দৈনিক প্রথম অলো, দ্য ডেইলি স্টার, দৈনিক সমকাল, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক যুগান্তরসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের নিয়মিত কলাম লেখক। অনুসন্ধানী লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় ১৯৯৬ সালে ‘রিপোটার্স ইউনিটি প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন তিনি।

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন ১৯৮৬ সালে যশোর জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং ১৯৮৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে আইন বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন। তিনি এলএলএম এ প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি সুইজারল্যান্ডের ওয়ার্ল্ড ট্রেড ইনস্টিটিউটে আন্তর্জাতিক আইন ও অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশুনা করেন। জনাব কার্জন লেখালেখি, একাডেমিক কর্মকা- ছাড়াও মানবাধিকার ও পরিবেশ আন্দোলন এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।

সম্প্রতি খ্যাতিমান এই মানুষটির মুখোমুখি হয় একুশে পত্রিকা। তিনি কথা বলেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দৈন্যদশা নিয়ে।
শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই। এই বিভাগ থেকে অনেক প্রতিথযশা আইনজ্ঞ, বিচারপতি, রাজনীতিবিদ, বর্তমান স্পীকারসহ অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলো ছড়াচ্ছেন। সেই বিভাগটিই এখন নানান সমস্যায় জর্জরিত।
অথচ এই বিভাগে বাংলাদেশের অন্যতম মেধাবী ছাত্ররাই শুধু ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করে। এখানে ভর্তির জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা হয়। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলে। মেধার অন্যরকম দ্যুতি ছড়িয়ে এখানে ভর্তি হলেও শেষপর্যন্ত আশানুরূপ সাফল্য নিয়ে শিক্ষার্থীরা বের হতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাপদ্ধতি, মানসমম্মত ও সময়োপযোগী শিক্ষকের অভাব, একাডেমিক অবকাঠামোয় গলদ, সময়োপযোগী পাঠ্যসূচির প্রবর্তন না হওয়া এর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন এই শিক্ষক।

গবেষণার জন্য যে রকম বাজেট দরকার, তা হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারি বরাদ্দের ৭৫ শতাংশই শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতনে ব্যয় হয়। বাকি বাজেটের যৎসামান্য গবেষণার কাজে ব্যয় হয়, যা অতি নগণ্য। অথচ গবেষণাই হচ্ছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরুদ-। গবেষণালব্ধ জ্ঞান ব্যতিরেকে গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা দেশ-জাতির কল্যাণে কোনো অবদান রাখতে পারে না।’

তিনি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘ভারতে প্রতিবছর শিক্ষাখাতে বাজেট বৃদ্ধি করা হয়। আগের বছরের বাজেটের চেয়ে সর্বশেষ বাজেটে ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি করেছিল ভারত সরকার। কারণ তারা জানে শিক্ষাই হচ্ছে আধুনিক জাতিগঠনের বড় হাতিয়ার। আমরা বলে থাকি শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। প্রতিদিন বক্তৃতা, বিবৃতি, সেমিনার সিম্পোজিয়ামে আমরা ফেনা তুলি-কী সরকার, কী নীতিনির্ধারক, বুদ্ধিজীবী সকলেই। কিন্তু বাস্তবে শিক্ষা জাতির মেরুদ- হয়ে উঠার জন্য, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন মেধাবী শিক্ষার্থীকে বিশ্ব-উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ কিংবা প্রণোদনা চোখে পড়ে না।’

তিনি বলেন, আমরা যখন শিক্ষার্থী ছিলাম (১৯৮৯ থেকে ১৯৯৫) আইন বিভাগে হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষক পেয়েছিলাম, যাঁরা মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারতেন। পরবর্তীতে সেই মানের শিক্ষক, শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে। শিক্ষক নিয়োগে গলদ, শিক্ষকদের অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদার বিষয়টি উপেক্ষিত হওয়ায় শিক্ষকরা আধুনিক, মানসম্মত শিক্ষাপ্রদান করতে পারছেন না বলে মনে করেন শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন।

তিনি বলেন, ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে আইন বিভাগ যুক্ত। এখানে থাকার কথা ক্রিমোনলজি বিভাগ, ফরেনসিক বিভাগ, আন্তর্জাতিক আইন বিভাগ, বাণিজ্য আইন বিভাগ ইত্যাদি। কিন্তু যুগোপযোগী বিষয়গুলো না থাকায় ৯৭ বছরেও এটি ইনস্টিটিউটে রূপান্তর হয়ে উঠতে পারেনি।’

তিনি বলেন, ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা আন্তর্জাতিক উষ্ণায়ন বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। এসবের এমন কিছু দিক আছে যা আইনের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। এই ঝুঁকি মোকাবিলা করে বাংলাদেশ কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে, জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরা এবং এ সংক্রান্ত প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে জলবায়ু আইনের উপর বিশেষ পড়াশোনা অপরিহার্য। বাস্তবতা হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে এই ধরনের পড়াশোনা ও গবেষণা হয় না বললেই চলে।’

জনাব কার্জন বলেন, ‘এই বিভাগে সান্ধ্যকালীন পড়াশোনা নেই, বিদেশি ছাত্রদের পড়াশোনার সুযোগ নেই। অথচ অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, ক্যামব্রিজসহ বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেধাবীদের জন্য খুলে রেখেছে গবেষণার অবারিত দ্বার।’

তিনি বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বিভাগের ছাত্র ছিলেন। এটি আমাদের গর্ব ও অহঙ্কারের বিষয়। মহান এই নেতার নামে কোনো গবেষণা, ইনস্টিটিউটের ব্যবস্থা না করে আমরা মানসিক দৈন্যতার পরিচয় দিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর উপর কোনো সেমিনার-সিম্পোজিয়াম আয়োজন করে না এই বিভাগ। তাতে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতার কিছু যায় আসে না। লাভ হতো বরঞ্চ আমাদের। আমরা তার নামে সুপরিচিতি হতাম, প্রতিষ্ঠা লাভ করতাম। হতে পারতাম অন্য বিভাগের জন্য অনন্য উদাহরণ, মডেল। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকনেতারাও কখনো এই বিষয়ে সরকারের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেছে বলে আমার জানা নেই- যোগ করেন ড. শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন।

আমি মনে করি, আইন বিভাগের এই দৈন্যতা সমগ্র বাংলাদেশেরই দৈন্যতা। এটা শুধু বিশেষ আইন বিভাগের সমস্যা নয়। আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, ভারতের মাহাত্মা গান্ধী তাদের দেশ ও জাতির কাছে যেমন, বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির কাছে তেমনই এক শ্রদ্ধা ও আরাধনার প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আমরা এমন এক জাতি আমাদের পিতাকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতেই আমরা আবদ্ধ রাখতে চাই। দলমতের উর্ধ্বে উঠে আমরা তাঁকে সাবর্জনীন করতে পারিনি। যা আমাদের উন্নয়ন, অগ্রযাত্রাকে বাঁধাগ্রস্ত করছে। আমাদের নীতিনির্ধারক যারা, তারাও কখনো এই বিষয়ে চিন্তা করেছেন বলে আমার মনে হয় না। দুঃখজনক হচ্ছে, আমরা এখনো এক্ষেত্রে যথেষ্ট ম্যাচিউর হতে পারিনি।

তিনি বলেন, ‘ডাক্তাররা মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে খেলে, আর আইনজ্ঞরা খেলেন মানুষের সুখ-দু:খ, সহায়-সম্পত্তি নিয়ে। কাজেই চেষ্টা, ত্যাগ, সাধনার মাধ্যমে আইন বিভাগকে সেই উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য আইন বিভাগের ভর্তিপরীক্ষায় পরিবর্তনসহ বিদ্যমান সঙ্কটগুলো দূরীকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আজ সময়ের দাবি।’