বিএনপির শোডাউন মানবিক সাংবাদিকতা

আজাদ তালুকদার : ৫ জানুয়ারি ২০১৫। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের একবছর পূর্তি। দিনটিকে বিএনপি ‘গণতন্ত্র হত্যা’ দিবস আখ্যায়িত করে ঢাকা, চট্টগ্রামে বড় ধরনের শোডাউনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। শেষ পর্যন্ত গোলযোগের আশঙ্কায় বিএনপিকে ঢাকায় সমাবেশ করতে না দিলেও শর্তসাপেক্ষে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপিকে দলীয় কার্যালয়ের
সামনে সমাবেশের অনুমতি দেয় সিএমপি কমিশনার।

সকাল থেকে নানা স্থান থেকে ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা মিছিল, প্লেকার্ড আর রঙ-বেরঙের মূর্তি নিয়ে জড়ো হতে থাকে সমাবেশস্থলে। বিকেল হতে না হতেই লোকে-লোকারণ্য কাজীর দেউড়ি, আউটার স্টেডিয়াম, নূর আহমদ চৌধুরী রোড ছাড়িয়ে লাভলেন, জুবিলী রোড এলাকা পর্যন্ত।

ঠিকঠাক চলছিল সবকিছুই। মূলত গণ্ডগোলটা বাঁধে বিকাল তিনটার দিকে। কাজীর দেউড়ি মোড় দিয়ে একটি উসকানিমূলক মিছিল থেকেই শিবিরকর্মীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে যায়। প্রথমে পুলিশকে লক্ষ করে ইট-পাটকেল ছুঁড়ে মারার ঘটনা, পরে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। ব্যস, পুলিশও হয়ে উঠে মারমুখী,  হিংস্র্র। অ্যাকশন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের অন্তত দুই কিলোমিটার এলাকায়। পুলিশের টিয়ারস্যাল, লাঠিচার্জ ও গুলিতে আহত ২০ দলীয় জোটের শতাধিক নেতাকর্মী। গ্রেফতার হয় দুইশরও বেশি লোক।

এমন যুদ্ধাবস্থায় যে যেভাবে পারেন দৌড়ে, পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিএনপির চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আহ্বায়ক আসলাম চৌধুরীসহ বেশকিছু নেতাকর্মী আটকা পড়েন নাসিমন ভবনের সামনে ইয়াসমিন প্যালেসে। সন্ধ্যার দিকে পুলিশ ইয়াসমিন প্যালেস ঘিরে শুরু করে চিরুনি অভিযান। একঘণ্টার অভিযান শেষে বের করে নিয়ে আসে আসলাম চৌধুরীসহ অন্তত ৫০ জন নেতাকর্মী। এরমাঝেই তিন তলা থেকে লাফ দিয়ে গ্রেফতার এড়াতে চেষ্টা করেন এক যুবক।

চারদিকে হুড়োহুড়ি আর আতঙ্কের মাঝে চাপা পড়ে যায় এই ঘটনা। পুলিশ-সাংবাদিকরাও ব্যস্ত যে যার কাজ নিয়ে। নাসিমন ভবনের উত্তর-পশ্চিম কোণায় গাছের নিচে অন্ধকারে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ওই যুবক।  থেমে থেমে মৃদুস্বরে ভেসে আসছে গোঙানির শব্দ। ১৫ মিনিট পরই ৭টার প্রাইম বুলেটিন। আর সেই বুলেটিনের শুরুতেই আমার ‘লাইভ’।

টেলিভিশনের পর্দায় বিবর্ণ লাগবে বলে মুখের ধুলাবালি সরাতে গিয়েছিলাম পানির ঝাপ্টায়। যেই হাতে থাকা মিনারেল ওয়াটারের বোতল নিয়ে মার্কেট-ভবনের অন্ধকার দিকটায় গেলাম তখনই অন্ধকারে মাঠিতে লুটিয়ে থাকা মানুষের অস্তিত্ব টের পেলাম। মানুষটা নিঃশ্বাস নিচ্ছে জোরে জোরে। কাছে যেতেই দেখি এক পা, এক হাত ভেঙে চুরমার। রক্তময় পুরো শরীর, রক্তে রঞ্জিত আশপাশ।

ঘটনার আকস্মিতায় হতবিহ্বল আমি। কী করতে পারি! একদিকে লাইভে দাঁড়ানোর তাগাদা। অন্যদিকে একটি মানবপ্রাণের বাঁচার তীব্র আকুতি। মুহূর্তেই আমার কাছে মুখ্য হয়ে উঠলো মানবসন্তানটির প্রাণ। একা তুলতে পারছিলাম না। তাই দ্রুত ডেকে আনি সহকর্মী এক ফটো সাংবাদিককে। এক হাতে মাইক্রোফোন। অফিসের সম্পদ, সেটিই ফেলতে পারি না। সমস্ত শক্তি দিয়ে দুজনেই সেই যুবককে উদ্ধার করে নিয়ে যাই যে পুলিশের তাড়া খেয়ে মানুষটি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সেই পুলিশেরই গাড়ির কাছে।

চারদিকে অন্ধকার। থমথমে অবস্থা। গাড়ি দূরের কথা, সাংবাদিক-পুলিশ ছাড়া কারো চলাচল নেই সড়কে। অনেকটা জোর করেই পুলিশের গাড়িতে তুলে দিয়ে বললাম, এক্ষুনি তাকে মেডিকেল নিতে হবে। পুলিশ প্রথমে ইতস্তত বোধ করলেও পরে আমাদের ‘সিরায়াসনেস’ দেখে মেডিকেলে নিয়ে যেতে রাজি হলেন। গাড়িতে তুলে দিই পরিচিত এক যুবককে, মেডিকেলের জরুরি বিভাগ পর্যন্ত তিনি যেন গাইড হিসেবে কাজ করেন।

গাড়ি মেডিকেলে পৌঁছার আগে মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই পঙ্কজ বড়ুয়াকে ফোন করে আহত যুবকটিকে রিসিভ করার জন্য ফোনে অনুরোধ জানাই। এরপর ফোন দিই ঘটনার পর দ্রুত আত্মগোপনে চলে যাওয়া চট্টগ্রাম নগর বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেনকে। ভয়ে-আতঙ্কে অপরিচিত কারো ফোন ধরছিলেন না শাহাদাত ভাই। কিন্তু সেভ থাকার কারণে সঙ্গে সঙ্গে আমার ফোনটি ধরলেন। আহত যুবকটির ভাগ্যই বলা যায়।

পুরো ঘটনা জানিয়ে শাহাদাত ভাইকে বললাম, আপনাদের দলের কোনো কর্মী হবে হয়তো। খুবই খারাপ অবস্থা তার। যেভাবে হোক যুবকটিকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিন। ন্যূনতম সময়ক্ষেপন হলে ছেলেটির নিশ্চিত মৃত্যু হবে।

এমনিতেই কর্মীদের প্রতি শাহাদাত ভাইয়ের অসীম দরদের কথা জানি। তার উপর যুক্ত হয় তাদের কর্মী অথচ একটি তাজা প্রাণ, একজন মানুষকে বাঁচাতে আমার আকুতি। আশ্বস্ত করে শাহাদাত ভাই বললেন, আমি  যেখানেই থাকি আহত যুবকটির চিকিৎসার কোনো ত্রুটি হবে না, নিশ্চিত থাকুন।

তবুও মনকে মানাতে পারি না। বাঁচবে তো মানুষটা! ফিরে যাবে তো পিছু নেওয়া মৃত্যুদূত! কিছুক্ষণ পর পর ফোন দিতে থাকি মেডিকেলের জরুরি বিভাগে। এএসআই পঙ্কজ বড়–য়ার মুখেই শুনতে পাই জরুরি বিভাগে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে যুবকটির প্রাণরক্ষায় কর্তব্যরত চিকিৎসদের প্রাণপণ চেষ্টার কথা। নিস্তেজ হতে যাওয়া প্রাণটিকে সঠিক সময়ে সঠিক চেষ্টার কাছে পৌঁছে দিতে পেরে মুহূর্তেই অন্যরকম এক ভালোলাগায় ভরে উঠে মন।

ততক্ষণে ৭টার বুলেটিন শেষ। বার্তাকক্ষ, ব্রডকাস্ট, কনসোল বিভাগ কেউ আমাকে পায় না। তাদের ফোনকলে মিসডকলের স্তূপ জমা হয় আমার মোবাইল ফোনে। চট্টগ্রামের এই খবর তখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও ঠাঁই করে নিয়েছে। কেবল একাত্তর টেলিভিশনের প্রাইম বুলেটিনে এত বড় ঘটনার নিউজ নেই।

সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালনের চেয়ে আমার সামনে তখন একটি প্রাণ বাঁচানো দায়িত্ব, মানবিক সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ। কোনোভাবেই একটি মুমূর্ষু প্রাণ ঠেলে দিতে পারি না, এড়িয়ে যেতে পারি না আমি। ভাবি, এজন্য আমার যা হবার হবে, কর্তৃপক্ষ যা বলবার বলবে। তা নিয়ে আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আমার মাঝে তখন এক মহাআনন্দ। এই আনন্দ প্রাণজয়ের, ভুবন জয়ের।

নোট : চিকিৎসদের নিবিড় পরিচর্যায় সেই যুবক ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেন। ফিরে পান নতুন জীবন। সেই জীবনের নাম জাহেদ। তিনি যুবদলকর্মী। বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। আমার বাড়িও চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। কী অদ্ভুত সমীকরণ! রাঙ্গুনিয়ার এক হতভাগ্য যুবকের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় যুক্ত হওয়ার সুযোগটা ঐশ্বরিকভাবে এসে পড়ে রাঙ্গুনিয়ারই আরেকজনের ওপর। একেই বোধহয় বলে মাটির টান, নাড়ির সম্পর্ক।

আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে, সেদিন নিউজ মিস করার ব্যাখ্যা দেওয়ার পর সাধুবাদ জোটেছিল একাত্তর টেলিভিশন কর্তৃপক্ষেরও। তারা বলেছে, রিপোর্টিং কিংবা নিউজ প্রেরণের দায়িত্বের চেয়ে কখনো কখনো মানবিক সাংবাদিকতাই বড় হয়ে উঠে। আর সেটি করতে পারেন কেবল মানবিক সাংবাদিকরাই।

[আজাদ তালুকদারের প্রকাশিতব্য গ্রন্থ ‘রিপোর্টারের ডায়েরি’র অংশবিশেষ]