চট্টগ্রাম: মোহাম্মদ মামুন, মোহাম্মদ নাজিম, সৌমেন পালিত- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এ তিন সহ সভাপতি ও পাঠাগার সম্পাদক আবু বকর তোহা; কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দিয়েছেন। তাই তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানানো হয়েছে।
মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপু। এ সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন তিনি।
তিনি বলেন, প্রয়াত ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজের পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকায় মীমাংসিত একটি বিষয়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করার পরও কোন ধরণের প্রতিবাদতো দূরের কথা, কোন মন্তব্য করা থেকে পর্যন্ত আমরা বিরত থেকেছি। কিন্তু অবাক হলেও সত্য, সহকর্মী দিয়াজের আত্মহত্যার পর একমাস অতিবাহিত হল, এ সময়ের মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই একটি জাতীয় পত্রিকায় উদ্দেশ্যে প্রণোদিতভাবে দিয়াজের বড় বোন জুবাইদা ছরওয়ার নিপা মিথ্যা মন্তব্য করে যাচ্ছেন। তিনি কখনো বলে বেড়াচ্ছেন, ‘আসামীরা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রভাবিত করেছেন’, কখনো বলেছেন, ‘দিয়াজের পরিবারের সদস্যদের আমরা হুমকি দিচ্ছি’. কখনো বলেছেন, ‘দিয়াজের পরিবারের সদস্যরা ক্যাম্পাসে গেলে তাদের ঘিরে ধরে আমরা শ্লোগান দিয়েছি’।
টিপু আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর আত্মহত্যাকে হত্যাকান্ড হিসেবে প্রচার করে সম্প্রতি বিএমএ নির্বাচনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ভাইয়ের সমর্থন নিয়ে জয়ী হওয়া ড. মুজিব – ডা. ফয়সাল পরিষদকে বিতর্কিত করতে চবি ছাত্রলীগের বিপথগামী সহ সভাপতি মোহাম্মদ মামুন, মোহাম্মদ নাজিম, সৌমেন পালিত, পাঠাগার সম্পাদক আবু বকর তোহা দিয়াজের পরিবারকে ব্যবহার করেছে। দিয়াজের পরিবারকে দিয়ে তারা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের মতো একজন চিকিৎসাবিদকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। এ জন্য একটি পক্ষের কাছ থেকে চবি ছাত্রলীগের এই বিপথগামীরা লাখ লাখ টাকা নিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দুই লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় সহকারী অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, সাবেক সভাপতি আবুল মনসুর জামশেদসহ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সিনিয়র নের্তৃবৃন্দ দিয়াজকে হত্যা করতে পারে- এমন বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ আদালতে দায়ের করেছেন দিয়াজের মা জাহেদা আমিন। তার মায়ের অভিযোগে উল্লেখ করা টাকা হিসেব করলে, একজন শিক্ষক ও ছাত্রলীগের সকল নেতারা ভাগে বিশ হাজার টাকা করে পাবে। এমন হাস্যকর অভিযোগ আদালতে দায়ের করার পরও শোকসন্তপ্ত দিয়াজের পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আমরা দীর্ঘ এক মাস ধরে কোন মন্তব্য করিনি।
আলমগীর টিপু বলেন, দিয়াজের বোনের স্বামী ছরওয়ার ও দিয়াজের মামা রাশেদ বিন আমিন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, দিয়াজ এক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকার যে চেক নিয়েছে, সেই চেকটির টাকার ভাগাভাগি নিয়ে দিয়াজের সাথে চবি ছাত্রলীগের সহ সভাপতি মামুনের সাথে দ্বন্ধ শুরু হয়। মামুন নানাভাবে দিয়াজকে হুমকি দিয়ে আসছিল।
টিপু আরও বলেন, গত ২৯ অক্টোবর তপুকে কুপিয়ে আহত করে চবি ছাত্রলীগের সহ সভাপতি মোহাম্মদ মামুন, মোহাম্মদ নাজিম, সৌমেন পালিত, যুগ্ম সম্পাদক সুমন কান্তি, পাঠাগার সম্পাদক আবু বকর তোহা, আইন সম্পাদক আবু সাইদ মারজানসহ ১০-১৫ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। আশংকাজনক অবস্থায় তপুকে দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এরপর তপুর বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক আপ্যায়ন সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদি হয়ে মামলা দায়ের করে হাটহাজারী থানায়।
টিপু বলেন, গণমাধ্যমের বিভিন্ন সংবাদে আমরা জানতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি ও সাংবাদিকদের দিয়াজ ইরফান চৌধুরী বারবার বলেছে, তপুর উপর হামলা করার বিষয়ে দিয়াজ কিছু জানেনা। জুনিয়রদের উপর থেকে দিয়াজের নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে। সহ-সভাপতি মামুন ও নাজিম জুনিয়রদের দিয়ে তপুকে এভাবে আহত করেছে। মামুন ও নাজিমদের দায়িত্ব দিয়াজ নেবেনা। তারা দিয়াজের কথা না শুনে তপুকে এমনভাবে কুপিয়েছে যা কোনো সভ্য মানুষের পক্ষে সম্ভব না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বলে দিয়েছি মামুনদের দায়িত্ব তিনি আর নেবেনা।
টিপু আরও বলেন, গণমাধ্যমে উল্লেখিত এসব তথ্যে আরও বলা হয়, গত ১১ নভেম্বর রাত ৭টা ৫২ মিনিটে দিয়াজ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর আমি একজন সাবেক শিক্ষার্থী। চবির সাথে আমার সম্পর্ক এটাই। চবির রাজনৈতিক কোনো বিষয়ে আমার সাথে কেউ যোগাযোগ না করার অনুরোধ রইলো, করলে ব্লেকলিস্টে ঢুকবেন। আমায় আমার মত করে ভাল থাকতে দেন, সবাই ভাল থাকুন।’
তিনি আরও বলেন, এই স্ট্যাটাস দেওয়ার পর সহ সভাপতি মামুন ওনাজিম জুনিয়রদের নানাভাবে দিয়াজের বিরুদ্ধে ক্ষ্যাপাতে থাকে। মামুনসহ কয়েকজন সিনিয়র বলে বেড়াতে থাকেন, ‘দিয়াজকে নেতা বানাতে গিয়ে আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েছি। সবকিছু বিসর্জন দিয়েছি। অনেক ফাইট করেছি সবসময়। আজ যখন আমরা মামলা খেয়ে ক্যাম্পাস থেকে আউট, তখন দিয়াজ বেঈমানি করছে। সে ২৫ লাখ টাকার চেক নিয়েছে আমাদের বিক্রি করে। এখন সে চবির রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে প্রতারণা করেছে।’ সিনিয়রদের এসব কথা তার গ্রুপের জুনিয়রদের মধ্যে খুবই প্রভাব ফেলে। ওই সময়ের মধ্যে দিয়াজের গ্রুপে ধরে যায় ফাটল। কিছু অনুসারী চলে যায় সহ সভাপতি মোহাম্মদ মামুন ও মোহাম্মদ নাজিমের পক্ষে। আর কিছু অনুসারী চলে যায় দিয়াজের অনুসারী চবি ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম জিসানের পক্ষে। তপুর উপর হামলার পর থেকে জুনিয়ররা নিজেদের ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হওয়ার পেছনে দিয়াজের ‘প্রতারণা’কে দায়ী করতে থাকে। এবং তাকে ওই ২৫ লাখ টাকার চেকটির ভাগ দিয়ে দিতে চাপ দিতে থাকে জুনিয়ররা। এ সময় দিয়াজ জুনিয়রদের জানান, বাড়াবাড়ি করলে চেকের এক পয়সাও কেউ পাবে না। একপর্যায়ে দিয়াজ চেক নিয়ে নিজের গ্রুপের সদস্যদের রোষানলে পড়ে যান প্রকাশ্যে। চেকের ভাগ দিতে দেরি হওয়ায় মামুন ও নাজিম দিয়াজকে মারধর করেছে। নিজ গ্রুপের নেতা মামুন ও নাজিমের হাতে মার খাওয়ায় অপমান সইতে না পেরে দিয়াজ আত্মহত্যা করেছে।
টিপু বলেন, দিয়াজকে ২০১৫ সালের ৩ নভেম্বর তার বিবাহিত স্ত্রী তালাক দেয়। যার প্রমাণ হিসেবে আমরা তালাকনামাটি সংগ্রহ করেছি। চাইলে যে কাউকে দিতে পারবো। দিয়াজ কয়েক মাস ধরে চবি ছাত্রলীগের এক নেত্রীর সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ওই ছাত্রলীগ নেত্রীর সাথে গত ১৯ নভেম্বর রাতে সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠান শেষে এমন কিছু হয়, যা নিয়ে নগর আওয়ামী লীগের এক নেতার কাছে অভিযোগ করেন ওই নেত্রী। একদিকে নিজ গ্রুপের নেতার হাতে মার খাওয়া, অন্যদিকে দুই নারীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে টানাপোড়েনের কারণে দিয়াজ হতাশা হয়ে পড়ে। মামুনদের হাতে মার খাওয়া এবং নারী ঘটিত এসব জটিলতায় পড়ে হতাশ হয়ে মূলত দিয়াজ আত্মহত্যা করেছে।
আলমগীর টিপু বলেন, গত ৯ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনার সংলগ্ন ঝুপড়িতে দুপুরের খাবার খেতে গেলে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন অভির উপর হামলা চালিয়ে তার দুই হাত, দুই পা থেঁতলে দেয় সহ সভাপতি মামুন, নাজিম, সৌমেন পালিত ও পাঠাগার সম্পাদক আবু বকর তোহা। এর আগে ২৯ অক্টোবর নভেম্বর তারাই শহীদ আব্দুর রব হলের মাঠে তুলে নিয়ে গিয়ে ছাত্রলীগের সহ সভাপতি তায়েফুল হক তপুর উপর হামলা চালিয়ে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। ছাত্রলীগ নেতা ইমতিয়াজ উদ্দিন অভি ও তায়েফুল হক তপুর অবস্থা এখনো আশংকাজনক। দিয়াজ আত্মহত্যা করতে বাধ্যকারী বিপথগামী এ চারজন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের উপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটি দীর্ঘ ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে অসংখ্য ছাত্রলীগ কর্মীর রক্ত¯œাত হয়েছে। তাদের রক্তে ভিজে এ ক্যাম্পাসটির প্রতিটি কোণা আজ মৌলবাদী শক্তি ছাত্রশিবিরমুক্ত। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসলে এ ছাত্রশিবির মুক্ত ক্যাম্পাস গড়তে যারা নিজেদের যৌবনের শ্রম, মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে লড়াই করে গেছেন তাদের মধ্যে অগ্রষৈনিক ছিলেন চবি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবুল মনসুর জামশেদ ও বিশ্ববিদ্যালয় সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী। একই সাথে আমিও ২০০৭ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মী হয়ে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি সামনে থেকে। যা প্রমাণ ছাত্রশিবিরের দায়ের করা প্রতিটি মামলায় আমাকে আসামী করা হয়েছে। মূলত প্রগতিশীল শিক্ষক ও ত্যাগী ছাত্রলীগ নেতাদের টার্গেট করে আদালতে দায়ের করা কথিত দিয়াজের হত্যার অভিযোগে আসামী করা হয়েছে। মামুন, নাজিম ও তাদের দোসররা এসব অপ্রচার চালাতে ব্যবহার করছে দিয়াজের পরিবারকে। অথচ একজন শিক্ষক হিসেবে আনোয়ার হোসেন চৌধুরী নৈতিকতা পরায়ণ ব্যক্তিত্ব বলেই আদালতে অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় সহকারী প্রক্টরের পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন।
দিয়াজের পরিবার নিয়ে টিপু বলেন, দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর বোন জোবাঈদা সরোয়ার নিপা দিয়াজের আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের আশায় বিভিন্ন সময় মনগড়া ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবি সমিতির আসন্ন নির্বাচনে সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছেন। দিয়াজের মৃত্যুকে পুঁজি করে তিনি লাইমলাইটে এসে নিজ স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জোবাঈদা সরোয়ার নিপার স্বামী সরোয়ার আলম ফটিকছড়ি উপেজলার ভূজপুর থানার আওয়ামী লীগ নেতা এটিএম পেয়ারুল ইসলামের গাড়িবহরে হামলা ও তিনটি হত্যা মামলা আসামী। এই সরোয়ার শিবির ক্যাডার বিডিআর সেলিমের দেহরক্ষী ছিলেন। কিছুদিন আগেও তাকে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র থেকে চিকিৎসা শেষে বাড়িতে আনা হয়। শুধু তাই নয়, তার মামা সাদিত বিন আমিন শিবিরের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন চবি ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ সভাপতি মনসুর আলম, সহ সভাপতি সাজিদুল কবির, আব্দুল মালেক, সাখাওয়াত হোসেন রায়হান, নাজমুল করিম নিপুন, যুগ্ম সম্পাদক কৌশিক বিশ্বাস, কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক মাহবুব রহমান, সমাজসেবা সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ, ত্রাণ ও দূর্যোগ বিষয়ক সম্পাদক ইমাম হোসেন গাজী, উপ গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু, উপ সাহিত্য বিষয়ক সম্পাক ইমাম উদ্দিন ফয়সাল পারভেজ, উপ তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক রকিবুল হাসান দিনার প্রমুখ।