সুরেশ কুমার দাশ : বার্ট্রান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০) কীটপতঙ্গ ও অণুজীবের কারণে মানবজাতির ধ্বংসের সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন ১৯৩৩ সালে তার ‘মানবজাতি বনাম কীট-পতঙ্গ’ প্রবন্ধে। বাংলা একাডেমির ‘আলস্যের জয়গান’ অনুবাদ গ্রন্থ থেকে সেই প্রবন্ধের কিছু অংশ তুলে ধরা হল- যা আজকের দুনিয়ার করোনা ভাইরাসের মহামারির সাথে তার সেই ভবিষ্যদ্বাণীর অনেকটাই মিল পাওয়া যাচ্ছে।
আমরা নিজেদের Lords of Creation বা আদি পুরুষ হিসাবে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। গুহামানবের মত সিংহ, বাঘ, হাতির মতো কোনো প্রাণি বা বন্যশূকরের ভয়ে ভীত হওয়ার দরকার পড়ে না আমাদের। আমরা একে অপরকে যে ভয় পাই, সেটা বাদ দিয়ে ধরলে নিজেদের নিরাপদই বোধ করি। কিন্তু বৃহৎ জন্তুরা আমাদের অস্তিত্বের জন্য আর হুমকি না হলেও ক্ষুদ্র জন্তুদের ব্যাপারে সেই কথা বলা চলে না।
এই গ্রহের প্রাণের ইতিহাসে পূর্বে বৃহৎ জন্তুরা ক্ষুদ্র জন্তুদের একবার জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল। বহুকাল ডাইনোসর নিরুদ্বেগভাবে জলাশয় ও বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছে, একটি ডাইনোসরের অপর একটি ডাইনোসরকে ভয় করা ছাড়া তাদের আর কোনো ভয়ের ব্যাপার ছিল না। সংশয় ছিল না তাদের সাম্রাজ্য নিরঙ্কুশ।
স্তন্যপায়ী প্রাণিদের জায়গা করে দিয়ে ডাইনোসর এক সময় বিলুপ্ত হয়। ডাইনোসরের বংশ কেন ধ্বংস হয় তা জানা যায় না। তবে মনে করা হয় যে ঐ অতিকায় প্রাণির মাথার মগজ ছিল খুবই সূক্ষ্ম। শিকারের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের জন্য অসংখ্য শিং গজানোর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে। ঘটনা যাই হোক- ডাইনোসরের ধারা অনুসরণ করে জীবনের বিকাশ ঘটেনি।
স্তন্যপায়ী প্রাণি নিরঙ্কুশ প্রাধান্য পাবার পর আকারে বাড়তে লাগলো। কিন্তু হস্তীসদৃশ অতিকায় প্রাণির বিলুপ্তি ঘটেছে। অন্যান্য বৃহৎ আকৃতির প্রাণিও বিরল হয়ে এসেছে।
ব্যতিক্রম শুধু মানুষ এবং মানুষের বশীভূত প্রাণিরা। ক্ষুদ্রকায় মানুষ বুদ্ধি দ্বারা সফলতার সঙ্গে বিরাট জনসংখ্যার পুষ্টির ব্যবস্থা করেছে। মানুষ নিরাপদ, তবে ক্ষুদ্রকায় প্রাণি, কীটপতঙ্গ এবং অণুজীব থেকে নয়।
কীট পতঙ্গাদির প্রাথমিক সুবিধা এই যে- এদের সংখ্যা অগণন। এরা আমাদের খাদ্য পরিপক্ক হওয়ার আগেই ভক্ষণে সক্ষম।
অনেক অনিষ্টকর কীটপতঙ্গ অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে বসবাসে অভ্যস্ত ছিলো। মানুষ এদের বিনা অভিপ্রায়ে নতুন পরিবেশে স্থানান্তর করে। হলুদ জ্বর আগে শুধু পশ্চিম আফ্রিকায় দেখা গেছে। ক্রীতদাস ব্যবসা এই রোগকে পশ্চিম গোলার্ধে বহন করে আনে। পরে প্রাচ্যে এবং তারপর ভারত ও চিনে। সৌভাগ্য যে, বিজ্ঞান একটা উপায় উদ্ভাবন করেছে- যা দিয়ে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দমন করা সম্ভব।
পরবর্তী মহাযুদ্ধে মানুষ যদি একে অপরের ক্রোধবশত কীটপতঙ্গ এবং অনুজীবদের সাহায্য গ্রহণ করে এবং আরো একটি মহাযুদ্ধ শুরু হলে তারা তা করবে, তাহলে এটা কোনো মতেই অসম্ভব নয় যে শেষ পর্যন্ত প্রকৃত বিজয়ী হবে কীটপতঙ্গ ও অনুজীবেরা। হয়তো মহাজাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দুঃখিত হবার কিছুই নেই, কিন্তু মানুষ হিসাবে আমি নিজ প্রজাতির জন্য দীর্ঘশ্বাস না ছেড়ে পারি না।
দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল দুনিয়ার সর্বকালের অতিপ্রজ লেখকদের একজন। বহুমাত্রিক জ্ঞানের ধারক, ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। গণিতবিদ, মানবতাবাদী, বিজ্ঞান বিশ্লেষক, রাজনীতিক ইত্যাদি। তার জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’।
যুদ্ধ এবং মহামারি সম্পর্কে রাসেল বলতে চেয়েছেন- কীটপতঙ্গ আর অণুজীবরা এমনি এমনি আমাদের ধ্বংস করার জন্য যুদ্ধ করবে না। এর প্রধান কারণ পরিবেশকে বিপন্ন করে তোলা। প্রাণসত্ত্বাকে তার পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার মরিয়া প্রচেষ্টা মানুষের। তিনি দেখালেন- হলুদ জ্বর কিভাবে আফ্রিকা থেকে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেখানে পরিবেশ বিচ্ছিন্ন মানুষের মাইগ্রেশন তথা ক্রীতদাস ব্যবসার কথা যেমন এসেছে তেমনি অমানবিক এই ক্রীতদাস ব্যবসা কীভাবে তখনকার সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা মেনে নিয়েছিল সেই অন্যায় ও নির্মমতার কথা। আমাদের সামগ্রিক জীবন কিভাবে নিজেদের অজান্তেই অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়তে পারে তা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। আজ আমরাও তাই দেখছি।
আজকের দিনে বার্ট্রান্ড রাসেলকে মনে রাখার দায় নেই। সভ্যতা যখন এক জনগোষ্ঠী আর এক জনগোষ্ঠীকে মুহূর্তে ধ্বংস করে দেয়ার মত গরিমায় অন্ধ তখন তাদের কাবু করে দিয়েছে অদৃশ্য ভাইরাস। মারণাস্ত্রের এত দম্ভ গেল কোথায়। এত এত মারণাস্ত্র কোনটাই কাজে লাগছে না করোনা ভাইরাস তথা অদৃশ শত্রুর বিরুদ্ধে। আর এসব পরাশক্তিগুলোর দর্পচূর্ণ হয় কিনা কে জানে। তারা যাদের অনেকের বিরুদ্ধে জীবাণু অস্ত্র তৈরির অভিযোগ শোনা যায়। এটা হলে বার্ট্রান্ড রাসেলের কথা সত্য প্রমাণিত হবে – মানবজাতির বিরুদ্ধে বিজয়ী পক্ষ হবে নানা কীটপতঙ্গ ও অণুজীবেরা।
সুরেশ কুমার দাশ : লেখক ও বার্তা প্রযোজক, বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্র