শরীফুল রুকন : আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসেবার প্রতিশ্রুতিতে চট্টগ্রামে গত বছরের ১৫ জুন উদ্বোধন হয় ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল লিমিটেড।
নগরের পাহাড়তলীতে ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পাঁচটি ভবনে ৩৭৫ শয্যার এই হাসপাতালটিতে থাকার কথা সার্বক্ষণিক জরুরি সেবা, কার্ডিয়াক, ট্রান্সপ্ল্যান্ট, নিউরো, অর্থোপেডিক গাইনিসহ ১৪টি অপারেশন থিয়েটার।
বেসরকারি পর্যায়ে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বড় এই হাসপাতালে ভারতের বেঙ্গালুরুর নারায়ণা হেলথের কার্ডিয়াক বিভাগের একটি দল রোগীদের সেবা দেওয়া এবং এর প্রত্যক্ষ তদারকি করার কথা ছিল খ্যাতিমান হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও ভারতের নারায়ণা হেলথের চেয়ারম্যান দেবী প্রসাদ শেঠির।
বাংলাদেশের চিকিৎসাজগতে এভাবেই আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে তৈরি হওয়া হাসপাতালটির কার্যক্রম করোনা-আতঙ্কে এখন অনেকটা বন্ধ। গত ২২ মার্চ থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে কার্ডিয়াক বিভাগের।
প্রাণঘাতি করোনায় পুরো বিশ্ব যখন নাকাল, আতঙ্কিত বাংলাদেশের জনগণ, তখন হাসপাতালটির কার্যক্রম সংকুচিত করে নিজেদের রক্ষা কিংবা ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ ভূমিকাকে কোনোভাবেই ভালো চোখে দেখছেন না চট্টগ্রামের সচেতনমহল, এমনকি প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাও।
প্রশাসনের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা ইম্পেরিয়াল হাসপাতালের এই ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে একুশে পত্রিকাকে জানিয়েছেন, দেশের এই ক্রান্তিকালে এগিয়ে আসার জন্য ইম্পেরিয়াল কর্তৃপক্ষকে আমরা অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তারা কোনোভাবেই সায় দিচ্ছে না, বরং হাসপাতালের বিদ্যমান লজিস্টিকগুলো সংকুচিত করছে যাতে করে করোনা-রোগীদের জন্য হাসপাতালটিকে ব্যবহারের চিন্তা সরকার না করে।
তবে বিষয়টি অস্বীকার করে ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল লিমিটেডের বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. রবিউল হোসেন বুধবার সকালে একুশে পত্রিকার কাছে উল্টো জিজ্ঞেস করেন, কে বলেছে আপনাদের এসব কথা। এগুলো সব ভুল, মিথ্যা কথা। শুধু শুধু বিভ্রান্তি না ছড়ানোর অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা হাসপাতাল পুরোপুরি চালু রেখেছি। নিয়মিত চিকিৎসাসেবা দিচ্ছি। সরকারের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীর লোক, স্বাস্থ্য পরিচালক, ডিসি আমাদের কাছে এসেছেন। আমরা চিন্তা করছি কী করে এই দুর্যোগে পাশে থাকা যায়!’
এরপর ডা. রবিউল হোসেনকে করোনার অজুহাতে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ইম্পেরিয়াল কার্ডিয়াক সেন্টারের চিকিৎসা-কার্যক্রম বন্ধ করার কথা জানানো হলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে জানতে চান, কখন কোথায় বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে আমাকে পড়ে শোনাতে পারবেন?
In line with the measures taken by the Government of Bangladesh and India to prevent transmission of COVID – 19 (Corona Virus), the management of Imperial-Narayana Cardiac Centre of Imperial Hospital, Chattogram – Bangladesh have taken decision to temporarily suspend all activities of Imperial – Narayana Cardiac Center (NCC) from 22nd March 2020. The clinical activities will be resumed at the earliest possible time to be notified in due course.
– Imperial Hospital Authority
একুশে পত্রিকার পক্ষ থেকে পত্রিকায় প্রকাশিত তাদের বিজ্ঞপ্তিটি পড়ে শোনানোর পর এবার ডা. রবিউল হোসেন বললেন, হ্যাঁ, আপনার কথা ঠিক আছে। তবে এখানে শুধু কার্ডিয়াক বিভাগটি বন্ধের কথা বলা হয়েছে। বাকি ইউনিটগুলো আমরা সচল রেখেছি। নারায়ণার ২৪ জন চিকিৎসক-স্টাফের ২২ জনই করোনা-দুর্যোগে তাদের দেশে ফিরে গেছে। আটকে পড়া বাকি দুইজন পরিবার-পরিজন ছেড়ে এখানে একটা রুমে আবদ্ধ হয়ে আছে। তারা যদি চিকিৎসা না দেয় তাহলে কীভাবে কার্ডিয়াক বিভাগ চালু রাখি বলুন, যোগ করেন ডা. রবিউল হোসেন।
এদিকে, ইম্পেরিয়াল হাসপাতালটিকে করোনা মোকাবিলায় কাজে লাগানোর কোনো চিন্তা বা চেষ্টা সরকারের আছে কিনা জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর একুশে পত্রিকাকে বলেন, আসলে এ উদ্দেশ্য নিয়েই গত সপ্তাহে ডিসি সাহেবসহ আমরা একটা টিম গিয়েছিলাম ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে। তারা আমাদেরকে একপ্রকার হাতিঘোড়া দেখাল। আমাদেরকে বসিয়ে মিটিং করে জানালো, তাদের এসি কাজ করছে না। এই কারণে আগের দিন নারায়ণার ডাক্তাররা সবাই দেশে চলে গেছেন।
এসি কাজ করছে না তা নয়, ঠাণ্ডা হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু এসির যে ফিলট্রেশন অর্থাৎ ভেতরের রোগজীবাণু টেনে বের করে দেবে সেন্ট্রাল, মডার্ন সিস্টেম সেই সিস্টেমে গলদ আছে, তার জন্য তারা এটি করতে পারছে না। এবং এ কারণেই নারায়ণা চলে গেছে বলে দাবি তাদের। ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীরের দাবি, অন্য কোনো কারণ নয়, করোনার ভয়ে চলে গেছে নারায়ণা।
শেষপর্যন্ত ইম্পেরিয়াল কর্তৃপক্ষ আমাদের জানাল যে, এসিতে করোনার জীবাণু ঢুকলে আর বের হবে না, বরং পুরো হাসপাতালে ছড়িয়ে পড়বে। তখন পুরো হাসপাতাল বন্ধ করে দিতে হবে ইত্যাদি। দুই ঘণ্টা ধরে আলোচনার পর তারা আমাদেরকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলো যে, তারা করোনা মোকাবিলায় কোনো সাহায্য করতে পারবে না। এরপর আমরা কথা না বাড়িয়ে ফিরে আসি। ডিসি সাহেব একটু অসন্তুষ্টই হয়েছেন। – বলেন ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, হ্যাঁ, ইম্পেরিয়াল হাসপাতালকে জাতির এই কঠিন সময়ে আমরা কাছে পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা একদমই সহযোগিতা করলো না। বরঞ্চ নেগেটিভ অ্যাপ্রোচই করলো। তাদের যে সুযোগ-সুবিধা ছিল আমাদের তৎপরতা টের পেয়ে পরবর্তীতে সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে শুনেছি। আসলে তারা কী চিন্তাভাবনা থেকে এই হাসপাতালটি করলো এখনো আমার বোধে আসছে না – দুঃখ করে বলেন জেলা প্রশাসক।
এদিকে, এই দুর্যোগে কি কিছুই করার নেই ইম্পেরিয়াল হাসপাতালের, এমন প্রশ্নে চেয়ারম্যান ডা. রবিউল হোসেন বলেন, অবশ্যই আছে। এসির ত্রুটি না থাকলে আমরা সাথে সাথে করোনার পাশে দাঁড়াতে পারতাম। আমাদের অসুবিধা হচ্ছে একটাই, অন্যান্য জায়গাতে লোকাল এয়ার কন্ডিশন-একটি কক্ষে। আমাদের সেন্ট্রাল এসি হওয়ায় যে ঠাণ্ডা বাতাস সার্কুলেট হচ্ছে তা থেকে জীবাণু ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। আর এই ভাইরাসের ক্ষেত্রে সেন্ট্রাল এসি আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
সেন্ট্রাল এসি-ব্যবস্থায় জীবাণু দূর করতে ফিল্টার দরকার। আমরা যখনই চীন থেকে এই ফিল্টার আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি তখনই দেশটিতে করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি হয়। আমরা চেষ্টা করছি ফিল্টার জোগাড় করে জীবাণুনিরোধক ব্যবস্থার মাধ্যমে করোনা-দুর্যোগে মানুষের পাশে থাকতে। সেবার জন্য হাসপাতাল করেছি। দুর্দিনে মানুষের সেবা যদি করতে না পারি তাহলে হাসপাতাল করে লাভ কী? ইতোমধ্যে আর্মি অফিসার মাসুদ সাহেবের সাথে আমাদের কথা হয়েছে।- যোগ করেন প্রফেসর ডা. রবিউল হোসেন।
### করোনা-মোকাবিলায় ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল রিক্যুইজিশন!