ড. প্রণব কুমার পান্ডে : ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ও ভারত দক্ষিণ এশিয়ার দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র। একে অপরের প্রতিবেশী হিসাবে উভয় দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্যসহ নানা বিষয়ের মিল রয়েছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, তৎকালীন ভারত সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে সকল সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন। সুতরাং, সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদার হয়েছে। দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে সুসম্পর্ক এই অঞ্চলের স্থায়িত্বের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন।
এ বিষয়টি অস্বীকার করার মতো নয় যে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। সময়ের সাথে সাথে তাদের সম্পর্কের ভিত্তি আরো শক্তিশালী হয়েছে। দলীয় রাজনীতির উর্দ্ধে গিয়ে ভারত সরকার বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দলের পরিবর্তন আসলেও বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত সরকারের নীতির পরিবর্তন আসেনি। সবচেয়ে বড় কথা হলো – ২০০৯ সালে যখন আওয়ামী সরকার যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় তখন ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ক্ষমতাসীন দল। এটি সর্বজনবিদিত ছিল যে, ১৯৭১ সালে প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন বিধায় আওয়ামী লীগ কংগ্রেসের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। সুতরাং, কংগ্রেস সরকারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা আওয়ামী লীগের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক ছিল।
তবে, ২০১৪ সালে যখন বিজেপি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশি রাজনৈতিক অঙ্গনের বিভিন্ন পক্ষ থেকে একথা বলা হয়েছিল যে, বিজেপি সরকারের আস্থা অর্জনে আওয়ামী লীগ সরকারকে বেশ অসুবিধার পড়তে হতে পারে। দুর্ভাগ্যক্রমে, যারা এই ধরনের পূর্বাভাস করেছিলেন তারা ভুল প্রমাণিত হলেন। সেই সময়ে আমি আমার কয়েকটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে, আমাদের মনে রাখা উচিত ভারত সরকারের পররাষ্ট্রনীতি কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের নীতি নয়। বরং এটি ভারত সরকারের বৈদেশিক নীতি। সুতরাং, ভারতে সরকারে যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের বৈদেশিক নীতির কোনো পরিবর্তন হবে না। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যে নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের মাধ্যমে আমার এই পূর্বাভাস সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। সেই সফরে এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। এটিই প্রমাণ করে যে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করতে সরকারের রাজনৈতিক পরিচয় মুখ্য বিষয় নয়।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারত সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। নিজের স্বার্থে উভয় দেশের সরকারের উচিত এই সমস্যাগুলো সমাধানে সচেষ্ট হওয়া। কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে প্রথম বিষয়টি হলো সীমান্তে হত্যাকাণ্ড। গত কয়েকমাস ধরে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। এই বিষয়টি নিয়ে উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে প্রায়শই উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশিদের মৃত্যুর খবর বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে।
অন্যদিকে, ভারতও দাবি করছে যে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বিজিবি দ্বারা তাদের নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, কোনো সরকারই তাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে অন্য দেশের নাগরিকদের হত্যা করার নির্দেশনা প্রদান করবে না। এই ধরনের ঘটনাগুলো মূলত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের আচরণের কারণে ঘটে থাকে। তবে একথা বলা যায় যে, উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের নাগরিকদের অন্য দেশের ভূখণ্ডে প্রবেশ আটকাতে ব্যর্থ হচ্ছে। তদুপরি, প্রত্যেক দেশের নাগরিকদের উচিত সীমান্তে কাজ করার সময় সাবধানতা অবলম্বন করা। ভুলবশত হলেও অন্য দেশের ভূখণ্ডে প্রবেশ করা উচিত নয়, যা আন্তর্জাতিক আইন সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রচেষ্টার পরেও যদি একটি দেশের নাগরিকরা সীমান্ত অতিক্রম করে অন্য দেশের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে তবে তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর উচিত অনুপ্রবেশকারীদের আটক করে বিচারের সম্মুখিন করা। একটি দেশের ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশের দায়ে অন্য একটি দেশের নাগরিকদের গুলি তরে হত্যা করা কোনো সমাধান নয়। এই ধরনের অনুপ্রবেশের ঘটনা শুধু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তেই ঘটে না বরং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই ঘটে থাকে।
আমরা সকলেই জানি যে, সীমান্তে হত্যাসংক্রান্ত সমস্যা সমাধান বিভিন্ন পদ্ধতিতে করা যেতে পারে। একটি প্রক্রিয়া হলো সীমান্তবর্তী স্থানে অবস্থিত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে পতাকা বৈঠক মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে সমস্যার সমাধান করা। আরেকটি প্রক্রিয়া হলো সীমান্তরক্ষী বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠকের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা। এই ধরনের বৈঠক যে কোনো দেশেই হতে পারে। তৃতীয় প্রক্রিয়াটি হচ্ছে দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠান। উভয় পক্ষই যদি এই সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়, তবে বিষয়টি দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকের এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। যেহেতু উভয় দেশের মধ্যে বেশ উষ্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক বিরাজমান, সুতরাং এই সমস্যার সমাধান মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকেই সমাধান করা প্রয়োজন। উভয় দেশেরই উচিত এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে সীমান্তে হত্যা বন্ধ করা। যেহেতু উভয় রাষ্ট্র স্থল এবং সমুদ্রের বৃহত্তম প্রতিবেশী। উভয়ের উচিত যত দ্রুত সম্ভব এই সমস্যা সমাধানে মনোযোগী হওয়া।
ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) এবং সাম্প্রতিক সময়ে দিল্লিতে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বাংলাদেশে অভ্যন্তরে আলোচনা এবং সমালোচনার জন্ম দিয়েছে যদিও পররাষ্ট্রসচিবসহ বিভিন্ন ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তারা বারবার এটিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসাবে উল্লেখ করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই ধরনের সহিংসতাকে কখনই সমর্থন করি না। আবার এটিও ঠিক, নিকটতম প্রতিবেশী হওয়ায় একটি দেশের মধ্যে ঘটে যাওয়া অনেক বিষয়েই অন্য একটি দেশে উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে এবং এর থেকে বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে। তবে, দুটি দেশের মধ্যে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখার স্বার্থে, প্রত্যেক দেশের উচিত অন্য দেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা। তবে ভারতে সংঘটিত কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এর প্রভাব দেখা দিলে সরকারের উচিত ভারত সরকারের সাথে আলোচনা করা। এই আলোচনার মাধ্যমে উভয় দেশের সম্পর্কের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব।
সাম্প্রতিক সময়ে দিল্লিতে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশের জনগণের একটি অংশ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানোর সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন । আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, সিএএ এবং এটির প্রভাব সংক্রান্ত ঘটনা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে ভারতে সিএএ-র ইস্যুকে কেন্দ্র করে যে কোনও ধরনের সহিংসতাকে সমর্থন করি না।
লেখক : প্রফেসর, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ।