সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

শিবির, হত্যার আসামি, দোকানদারদের দখলে ছাত্রলীগের কমিটি

প্রকাশিতঃ ৮ মার্চ ২০২০ | ৭:৪৩ অপরাহ্ন

 

জাহিদ হাসান : দীর্ঘ ২২ বছর পর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের ২৭৮ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। আর এই কমিটি নিয়ে বিতর্কের যেন শেষ নেই।  অভিযোগ আছে, কমিটিতে স্থান পেয়েছেন কাপড়ের দোকানদার, শিবিরের ক্যাডার, হত্যা মামলার আসামি, বিবাহিত, ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী, চাকরিজীবী, অছাত্রসহ অনেক বিতর্কিত ছাত্র নেতারা।

এদিকে ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জেলা ইউনিটের কমিটি ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট হওয়ার কথা থাকলেও গঠনতন্ত্রের নির্দেশনাকে পাশ কাটিয়ে ১২৭ জন বেশি করা হয়েছে। এ কমিটিতে সহ-সভাপতির পদ দেওয়া হয়েছে ৬০ জনকে। এছাড়া সহ-সম্পাদকই রয়েছেন ৩৫ জন। কমিটিতে যুগ্ম সম্পাদক পদে ১১ জন, সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ১১ জন, বিভাগীয় সম্পাদক ও উপ-সম্পাদক পদে ১৪৮ জন এবং সদস্য পদে ১১ জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। 

এর আগে গত ৪ মার্চ (বুধবার) কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরে ২৭৮ সদস্যের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। এ কমিটি ঘোষণার পরপরই শুরু হয় নানা  সমালোচনা। তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, প্রকৃত ছাত্র নেতারা অপরাজনীতি, সুপারিশ ও টাকার নেতৃত্বে প্রতিযোগিতায় ঠিকতে না পেরে কমিটিতে স্থান পাননি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সহ-সভাপতি পদে বিতর্কিতদের মধ্যে স্থান পেয়েছেন চান্দগাঁও থানা এলাকার গৃহবধু হত্যা মামলার প্রধান আসামি আব্দুল খালেক খালিদ, ইভটিজিং মামলার আসামি রুহল আমিন, জামায়াতের সাবেক এমপি সামশুল ইসলামের খালাতো ভাই কে এম পারভেজ উদ্দীন, ছাত্রলীগ নেতা তৌকি হত্যা মামলার আসামি সোহরাব হোসেন চৌধুরী শুভ। সহ-সভাপতি পদে স্থান পাওয়া সাইদুর রহমান জিহান ও ফয়সাল জামিল সাকিরের বয়স উত্তীর্ণ হয়েছে ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী। এছাড়া  সহ-সভাপতি পদে এসেছেন চাকরিজীবী জয়নুল আবেদীন ফরহাদ, বিবাহিত মো. মঈন উদ্দিন, রেয়াজউদ্দীন বাজার তামাকুমন্ডী লাইনে ডিওর নামক কাপড়ের দোকানদার মো. মিনহাজুল আবেদীন, সদ্য ২০১৯ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এমরান উদ্দিন।

যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদ পাওয়াদের মধ্যে জয়নাল আবেদীন কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডে (কাফকো) ২০১৯ সালে ৩০ সেপ্টেম্বের থেকে চাকরি করে আসছেন ও আরেকুর রহমান কয়েক মাস আগে নারী কেলেঙ্কারির ঘটনায় আনোয়ারা কলেজে হেনস্তার শিকার হয়েছেন। সাংগঠনিক সম্পাদক পদে মনোনীতদের মধ্যে মো. কলিমুল্লাহ সাতকানিয়া থানায় নাশকতা মামলার আসামি, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করায় বাঁশখালী থানায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন হামিদ হোসাইন, শিবিরের সক্রিয় কর্মী ছিল তসলিম উল্লাহ চৌধুরী ও সিয়াম চৌধুরী নগরের ডিসি হিল এলাকায় ড্রামে ফেলে দেয়ার মামলায় অমিত মুহুরীর সহযোগী হিসেবে দুই নম্বর আসামি। প্রথম দফায় ঘোষিত ৫১ জনের কমিটির তালিকায় নাম ছিল তার, সে সময় সিয়াম কারাগারে ছিল।

তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক পদ পাওয়া সুমি আক্তার রাইসা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের শীর্ষ নেত্রী ও ছাত্র ইউনিয়নের ব্যানারে বিভিন্ন মিছিল মিটিংয়েও তাকে দেখা গেছে। গ্রন্থনা ও প্রকাশনা উপ-সম্পাদক পদে মনোনীত গাজী আমিনুর রশিদ বিবাহিত, ধর্ম বিষয়ক উপ-সম্পাদক এস এম সাইফুল্লাহ রাহাত ফোর এইচ গ্রুপের হিসাব রক্ষক, সাংস্কৃতিক উপ-সম্পাদক মানিকের ছাত্রত্ব নেই।

এদিকে গণশিক্ষা বিষয়ক উপ-সম্পাদক হয়েছেন ইকবাল হোসেন মোর্শেদ খান। এখানে দুইজনের নাম একসাথে থাকায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। ইকবাল হোসেন (পটিয়া), মোর্শেদ খান (আনোয়ারা) এরা দুইজন পৃথক ব্যক্তি। তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপ-সম্পাদক মোহাম্মদ এনাম বনফুলে চাকরি করেন পটিয়ায়। মো. রায়হান রেলের খালাসি পদে কর্মরত আছেন পটিয়ায়। সদস্য মিজানুর রহমান মিনহাজ লোহাগাড়া পূর্ব পুটিবিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি পদে চাকরি করেও তিনি এবার দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে স্থান পেয়েছে।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগ কমিটির সহ-সভাপতি তানিম মান্নান একুশে পত্রিকাকে বলেন, অপকর্মে জড়িতরা যদি কমিটিতে পদ বাগিয়ে নেয় তাহলে সংগঠনের নীতি-আদর্শ ধুলায় মিশে যাবে। আমিও চাই বিতর্কিতদের দল থেকে বাদ দেওয়া হোক। বিতর্কিতদের পদ দিলে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি বা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ বা মারামারির ঘটে। সংঘর্ষে দলীয় কর্মী মারা যাওয়ার ঘটনাও দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগে ঘটেছে। আমি হয়তো বেশি দিন ছাত্রলীগে থাকবো না। তাই ছাত্রলীগের নেতৃত্বে যারা আসবে তাদের পরিচ্ছন্ন হওয়া উচিত।

নতুন কমিটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের এক নেতা একুশে পত্রিকাকে বলেন, এ কমিটিতে এমন অনেক নাম এসেছে যারা এক সময় শিবিরের ক্যাডার ছিল। অনেকে বিবাহিত, চাকরিজীবী ও হত্যা মামলার আসামি। বিশাল অঙ্কের টাকার বাণিজ্যের মাধ্যমে এ ধরনের বিতর্কিতদের কমিটিতে ঠাঁই দিয়ে পুরো কমিটিকে বিতর্কিত করা হয়েছে।

এসব বিষয়ে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এস এম বোরহান উদ্দিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, যেহেতু দীর্ঘদিন কমিটি হয়নি সেহেতু অনেকে সুপারিশের মাধ্যমে ঢুকতেই পারে, এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রমাণ সাপেক্ষে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নির্দেশনা অনুযায়ী সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

২৭৮ জনের কমিটি দেওয়া ছাত্রলীগের গঠতন্ত্র বহির্ভূত কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মহানগর, ঢাকা দক্ষিণের মত চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলাও একটি বড় ইউনিট। তাছাড়া ২২ বছর পর কমিটি দেওয়ার কারণে অনেক বেশি পদপ্রত্যাশী ছিলো, যার কারণে কমিটি বড় করতে বাধ্য হয়েছে। কমিটি নিয়ে যেন ব্যাঘাত না ঘটে, সবার সুপারিশে বড় কমিটি দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচর্যের নাম্বারে একাধিক বার যোগাযোগ করা হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। আবদুল কাদের সুজনকে সভাপতি ও আ ম ম টিপু সুলতান চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত ওই কমিটি ২০০৩ সাল পর্যন্ত বহাল থাকে। ২০০৩ সালে এ কমিটি ভেঙে দিয়ে মোহাম্মদ ফারুককে আহ্বায়ক করে তিন মাসের জন্য কমিটি গঠন করা হয়। তিন মাসের এ কমিটি বহাল থাকে ২০১১ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৮ বছর। ২০১১ সালে মোহাম্মদ ফারুকের নেতৃত্বাধীন এ কমিটি ভেঙে দিয়ে আবদুল মালেক জনিকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি গঠনের নিজেদের কর্মীদের হাতে খুন হন কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মালেক জনি।

এরপর ২০১৪ সালের ৩০ আগস্ট ঢাকায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ছাত্র সমাবেশ থেকে ফেরার পথে দুই পক্ষের মারামারিরতে ট্রেন থেকে ফেলে দেয়া হয় দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগ নেতা ও লোহাগাড়ার বার আউলিয়া ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি তৌহিদুল ইসলাম তকিকে। এ সময় তকি ঘটনাস্থলেই মারা যান। তকির মৃত্যুর পর সালাহ উদ্দিন সাকিবের নেতৃত্বাধীন কমিটির কার্যক্রম ২০১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ করে দেয়া হয় কেন্দ্র থেকে। তখন থেকে নেতৃত্বশূন্য ছিল চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগ। পরে ২০১৭ সালে এসএম বোরহান উদ্দিনকে সভাপতি এবং আবু তাহেরকে সাধারণ সম্পাদক করে ৫১ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সেই কমিটিই এবার বর্ধিত আকারে ঘোষণা করা হলো।