সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

রেজাউল করিম মেয়র পদে মনোনয়ন পেলেন যেভাবে

প্রকাশিতঃ ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২০ | ৪:৩৮ অপরাহ্ন


চট্টগ্রাম : তৃণমূল থেকে উঠে এসে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর চট্টগ্রামের মেয়র পদে রেজাউল করিম চৌধুরীর মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি রীতিমতো চমকের পাশাপাশি তৃণমূলকর্মীদের জন্য আশাজাগানিয়া, উদ্দীপনার এক বড় উপাখ্যান। রাজনীতি সচেতনদের কেউ কেউ বিষয়টিকে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ভূমিকম্প বলতেও দ্বিধা করছেন না।

রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ও বণিকায়ন যুগে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন কর্মীর হঠাৎই রাজনীতির আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে ওঠা নিয়ে কী জনগণ, কী রাজনীতি-সবখানেই এখনো কৌতূহল আর বিস্ময়ের অন্ত নেই। সেই বিস্ময়ভরা গল্পটি পাঠকদের জানাতে অনুসন্ধান করেছে একুশে পত্রিকা। কথা বলেছে নীতিনির্ধারণী ফোরাম থেকে মনোনয়ন সংশ্লিষ্ট, প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের সাথে।

জানা যায়, জাতীয় নির্বাচন, উপ নির্বাচন এবং মেয়র নির্বাচনে গত প্রায় সাড়ে তিন দশক থেকে মনোনয়ন চেয়ে বার বার ব্যর্থ হওয়া রেজাউল করিম চৌধুরী এবারের মেয়র পদে মনোনয়ন ফরমও কিনতে ইচ্ছুক ছিলেন না। স্ত্রীরও অনাগ্রহ ছিল এই বলে, তোমার টাকা সততার, শুদ্ধতার- শুধু শুধু মনোনয়ন কিনে ২৫-৩০ হাজার টাকা নষ্ট করে লাভ কী? স্ত্রীর কথাটি অযৌক্তিক মনে হয়নি রেজাউল করিমের। তাই ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু হলেও চট্টগ্রামের বহদ্দারবাড়িতে ঠাঁই বসেছিলেন রেজাউল।

১১ ফেব্রুয়ারি ওমরগণি এমইএস কলেজভিত্তিক প্রাক্তন এক ছাত্রনেতা রেজাউল করিমের বাড়িতে হাজির হয়ে বললেন, রেজাউল ভাই আপনি এখনো ঘরে বসে আছেন? ঢাকা যাবেন না, ফরম কিনবেন না? রেজাউলের জবাব- ইচ্ছে নেই। না, না তা করবেন না, ফরম একটা নিয়ে নিন। মনোনয়ন না পেলেও কথা তৈরি হবে, নেত্রী অন্যভাবেও হয়তো মূল্যায়ন করতে পারেন। বিষয়টি ভাবতে ভাবতে রেজাউলের কাছে সিটি করপোরেশনের প্রাক্তন এক ওয়ার্ড কমিশনারের ফোন। তিনিও জানতে চাইলেন মনোনয়ন নিচ্ছেন কিনা। ভাবছি নিবো কিনা-রেজাউলের এমন উত্তরে ওইপ্রান্ত থেকে কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন-প্রত্যাশী ওই লোক বললেন, আমিও যাচ্ছি ঢাকায়, যদি বলেন আপনার জন্যও বিমানের টিকেট একটা নিয়ে নিতে পারি।

মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে ওই লোকসহ সেদিনই বিমানে চড়লেন রেজাউল করিম। ১২ ফেব্রুয়ারি মনোনয়ন ফরম কিনে ১৩ ফেব্রুয়ারি দলীয় কার্যালয়ে সেটা জমা দিয়ে দৈনিক ৩ হাজার টাকা দামের হোটেল ক্যাপিটাল-এ এসে ভাবছিলেন চট্টগ্রাম ফিরে যাবেন। কাউন্সিলর মনোনয়ন-প্রত্যাশী ওই লোক একা হয়ে যাবেন, সঙ্গহীন হবেন ভেবে রেজাউল করিমকে অনুরোধ করলেন- থাকুন দু-একটা দিন। অনুরোধ রক্ষার্থে হোটেলে আরো একদিন পার করলেন রেজাউল। ভাবছেন আর নয়, এবার সত্যিই ফিরবেন চট্টগ্রাম।

এমন সময় (১৪ ফেব্রুয়ারি) রেজাউলের মোবাইল ফোনে চট্টগ্রামের এক আওয়ামী লীগ নেতা ফোন দিয়ে বললেন, আপনাকে নিয়ে হাইকমান্ডে ইতিবাচক আলোচনা হচ্ছে, চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে আপনার ১৯৭০-৭২ এর রাজনৈতিক ভূমিকাও। কাজেই ঢাকা ছেড়ে এ মুহূর্তে কোথাও যাবেন না। কিন্তু এসব বিশ্বাস হয় না রেজাউলের। বরং অলৌকিক, অমূলক মনে হয়।

আরো দুদিন হোটেলে পার করে দিলেন রেজাউল। দলীয় অফিসে যাওয়া, কোনো নেতার কাছে গিয়ে তদবির কিংবা ধর্ণা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না তিনি। বিশ্বাস- নেত্রী তাকে চিনেন। কিছু যদি হয় নেত্রীর ইচ্ছাতে, তাঁর হাত ধরেই হবে।

১৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় গণভবনে ডাক পড়লো মনোয়ন-প্রত্যাশী ১৯ জনের। তাদের একজন রেজাউল করিম চৌধুরী। গণভবনের সামিয়ানা টাঙানো মাঠে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য অন্যদের মতো অপেক্ষা রেজাউলের। সেখানে খবর রটে যায় জহুর আহমদ চৌধুরীর ছেলে হেলাল উদ্দিন চৌধুরী তুফান মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন। শুনে তুফানের সঙ্গে ঠাট্টাও করলেন রেজাউল-তুমি তো মনোনয়ন পেয়ে যাচ্ছো, মেয়র হলে আমাদের একটু দেইখো, একটা কাজ দিও-এই বলে।

যাই হোক রাত ৮টায় ডাক পড়লো মনোনয়ন বোর্ডে। মনোনয়ন বোর্ডের সামনে ১৯ প্রার্থী বসলেন লাইন ধরে। রেজাউল যে চেয়ারে বসার সুযোগ পান অলৌকিভাবে সেই চেয়ারের বিপরীতে মুখোমুখি বসা প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর দুই পাশে মনোনয়ন বোর্ডের বাকি সদস্যরা।

প্রধানমন্ত্রী কারো সাথে ওয়ান টু ওয়ান কথা বললেন না। শুধু বললেন, প্রার্থী করবো একজনকে। অন্যদের সেটা মেনে নিয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। বলেই প্রধানমন্ত্রীর উঠে যাচ্ছিলেন।

তখনই ফ্লোরটা নিলেন রেজাউল করিম। বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার অনুমতি পেলে দুটা মিনিট বলতে চাই। হ্যাঁ, বলুন-শুনতে চাইলেন প্রধানমন্ত্রী।

শুরু করলেন এভাবে, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে সংগঠনের অবস্থা খুব খারাপ। অধিকাংশ থানা-ওয়ার্ডে কমিটি নেই। কোনো কোনো ওয়ার্ডে দুইজন করে সভাপতি-সেক্রেটারি, মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি হয়েছে প্রায় ৮ বছর। আমরা টানা ক্ষমতায় আছি বলে লোকজনের অভাব হয় না। সভা আহ্বান করলে লোকজনে ভর্তি হয়ে যায়। দুঃসময়ে কাউকে পাওয়া যাবে না। প্রকৃতপক্ষে দলের সাংগঠনিক অবস্থা খুব খারাপ। মেয়র পদে আপনি কাকে মনোনয়ন দেবেন সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু দয়া করে দলটা নিয়ে একটু ভাবুন, আপনি একটু নজরপাত করুন।’

প্রধানমন্ত্রী হুম, হুম করে রেজাউলের সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, কিন্তু কোনো জবাব দিলেন না। এর পরপরই প্রধানমন্ত্রী উঠে গেলেন। কিন্তু পরক্ষণেই রেজাউলকে ঘিরে ধরেন কয়েকজন মনোনয়ন-প্রত্যাশী- ‘কেউ কিছু বললেন না। আপনি কেন আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গেলেন।’ আগ বাড়িয়ে কথা বলা অনেক সময় বুমেরাং হয় বলে কেউ কেউ উষ্মাও প্রকাশ করলেন।

রেজাউল বললেন, আমার হারাবার কিছু নেই। যা সত্যি তাই বললাম- বলেই গণভবন থেকে বেরিয়ে গেইটের কাছে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। ভাবছিলেন আর ঘোরাফেরা না করে হোটেলে চলে যাওয়াই শ্রেয়। এমন সময় চট্টগ্রামের এক এমপি রেজাউলকে দেখে এগিয়ে এলেন। বললেন, এখন দফারফা হচ্ছে আপনি আর একজন ব্যবসায়ী নেতার মধ্যে। রেজাউলের বিশ্বাস হয় না এসব। ফুটপাথ ধরে হেঁটে হেঁটে সিএনজি খুঁজছিলেন হোটেলে যাবার জন্য। তখনই ওই ব্যবসায়ী নেতার ফোন- রেজাউলের মোবাইলে। আপনাকে অভিনন্দন। কেন অভিনন্দন-আপনি পেয়েছেন সেজন্য? বললেন, না আপনি মনোনয়ন পেয়েছেন। তখনো রেজাউলের কাছে ঠাট্টা কিংবা দুষ্টুমি মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা! এবার ফোন এলো সরকারের এক দায়িত্বশীল জায়গা থেকে।

রেজাউল করিম চৌধুরী স্যার বলছেন? জ্বি বলছি। পরিচয় দিয়ে বললেন, স্যার আপনাকে অভিনন্দন। চট্টগ্রামের মেয়র পদে আপনিই মনোনয়ন পেয়েছেন। ঘোর কাটতে না কাটতেই পঙ্গপালের মতো চট্টগ্রাম থেকে গণভবনে যাওয়া মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সমর্থকরা রেজাউল করিমকে ঘিরে ধরলেন। কেউ কেউ কাঁধে তুলে নেওয়ার উপক্রম। শুরু হলো মিছিল-উৎসব।

এর মধ্যেই চট্টগ্রাম থেকে রেজাউল করিমের চবি শিক্ষক মেয়ের ফোন। বাবা, বাবা- শত শত মানুষ আমাদের বাড়ির আঙিনায় ঢুকে পড়েছে। গেট ভেঙে ফেলতে চাইছে কেউ কেউ। রেজাউল বললেন, কেন, আমাদের বাড়ির গেইট ভাঙবে কেন? তারা কারা? পরক্ষণে খবর নিয়ে জানলেন, তারা কেউ গেইট ভাঙতে আসেনি। টিভি-স্ক্রলে মনোনয়ন-প্রাপ্তির খবরে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে এসেছেন রেজাউলের বাড়িতে।

মেয়র পদে মনোনয়ন-প্রাপ্তির ঐতিহাসিক এই গল্পের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বৃহস্পতিবার রাতে এম রেজাউল করিম চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সত্যি বলতে কী,মনোনয়নের জন্য আমি কারো কাছে ধর্ণা দিইনি। স্বাভাবিকভাবেই মনোনয়ন-ফরম কিনে জমা দিয়েছিলাম। নেত্রী নিজ থেকেই আমার মতো একজন ক্ষুদ্র কর্মীকে এক টানে প্রাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছেন। আমি কথা দিচ্ছি, আমার প্রতি নেত্রীর এই আস্থা-বিশ্বাস আমি জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করবো।’

‘নির্বাচিত হতে পারলে লোভ-হিংসা-বিদ্বেষ-এর ঊর্ধ্বে উঠে সিটি করপোরেশন পরিচালনা করবো। দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো জীবন-যাপন করবো।’ যোগ করেন রেজাউল করিম চৌধুরী।