রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

ধর্ষণ ও ধর্ষণের শাস্তি এবং কিছু বাস্তবতা…

প্রকাশিতঃ ১০ জানুয়ারী ২০২০ | ৯:৩৯ পূর্বাহ্ন


আবু তাহের তাহসান : বর্তমানে দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রথমটা, ধর্ষণের শাস্তি কিভাবে কার্যকর করা উচিত, দ্বিতীয়টি ধর্ষণের শাস্তি কি হওয়া উচিত। কেউ কেউ ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবী করছেন। তাই প্রসঙ্গক্রমে আমার আলোচনা আমি দুটি বাস্তব ঘটনা দিয়ে শুরু করব।

ঘটনা-১ঃ
আমি চট্টগ্রাম কোর্টে একটা ধর্ষণের মামলা সম্পর্কে জেনেছি। মামলাটা বিচারাধীন। ধর্ষক জেল হাজতে আছে। মামলার এফআইআর (এজাহার) পড়ে জানলাম ধর্ষিতার বয়স ১৫ এবং ধর্ষকের বয়স ১৯। দু’জনের মধ্যে ৪ বছর ধরে প্রেমের সম্পর্ক। একদিন ছেলে মেয়েকে নিয়ে শহরে ঘুরতে যায়। তারা একটা আবাসিক হোটেলে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয় এবং পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। পুলিশ তাদেরকে বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়। ৬ দিন পর মেয়ের পক্ষ থেকে ধর্ষণের মামলা দায়ের করা হয়। ৬ দিন দেরি করার কারণ হিসেবে দেখানো হয়, ছেলে প্রথমে বিয়ে করবে বলেছে, তাই মামলা করেনি। যখন বিয়ে করবে না বললো, তখন মামলা করে। ছেলেকে পরদিন গ্রেপ্তার করা হলো। ছেলে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিল এবং মেডিকেল রিপোর্ট চলে আসলো, চার্জশিটও দেয়া হলো।

ঘটনা-২ঃ
সম্প্রতি কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা যেটা সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। তাই বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলাম না।

দুটি ঘটনা আমাদের প্রচলিত আইন অনুসারে ধর্ষণের ঘটনা। আমাদের দেশে বর্তমানে যে আইনে ধর্ষণের মামলা হয় তার নাম “নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০”। এই আইনে বলা আছে ১৬ বছরের কোনো মেয়ের সাথে যদি শারিরীক সম্পর্ক হয়, তাহলে মেয়ের ইচ্ছায় হোক বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে হোক সেটা ধর্ষণ বলে গণ্য করা হবে। দুটি ঘটনার মামলা হবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় এবং এই ধারা অনুসারে ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও জরিমানা।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দুটো ঘটনার যে মাত্রা এবং অবস্থা, তা কি একই?? কিন্তু দুঃখজনকভাবে দুইটার শাস্তি একই। ১ম ঘটনায় আসামীর আজীবন জেল হোক, তা কে কে চান??

কিন্তু ঘটনা-২ এর ক্ষেত্রে অনেকেই ক্রসফায়ার চাচ্ছেন, অনেকেই মৃত্যুদণ্ড চাচ্ছেন। আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমি ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষকের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে না। তার কিছু কারণ আমি ধর্ষণ সংক্রান্ত ধারা ৯ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করছি।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের কয়েক ধরণের শাস্তির ব্যবস্থা আছে।
১। শুধু ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।
২। ধর্ষণের ফলে যদি ধর্ষিতার মৃত্যু হয় তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।
৩। যদি দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয় এবং ধর্ষণের ফলে ধর্ষিতার মৃত্যু হয় কিংবা সে আহত হয়, তাহলে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।
৪। যদি পুলিশ হেফাজতে কেউ ধর্ষণের শিকার হয়, তাহলে যে পুলিশ অফিসার তার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত, তার শাস্তি সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা।

এখন বলি কেন আমি ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে না…

১। ধর্ষণ কোনো ওপেন প্লেস বা সবাইকে দেখিয়ে করা হয় না। ধর্ষণে অপরাধের একমাত্র সাক্ষী ভিকটিম নিজেই। তাই ভিকটিমের এই সাক্ষ্য আইনের চোখে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার ধর্ষণের ঘটনার পর ধর্ষক কে, তা সনাক্তকরণে ভিকটিম খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। এটার বাস্তব উদাহরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উক্ত ছাত্রী দ্বারা ধর্ষককে সনাক্তকরণ। এই অবস্থায় ধর্ষণের শাস্তি যদি মৃত্যুদণ্ড হয়, তাহলে সব আসামি চেষ্টা করবে ভিকটিমকে ধর্ষণের পর হত্যা করতে। ফলে এমন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য শেষ হয়ে যাবে এবং অনেক ধর্ষক শনাক্তকরণের অভাবে এবং সাক্ষীর অভাবে বেঁচে যাবে।
২। এটার মাধ্যমে ভিকটিমকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ফেলে দেয়া হবে।
৩। আমার উপরে উল্লেখিত ঘটনা-১ এর ক্ষেত্রে যে ধর্ষক তার শাস্তিও মৃত্যুদণ্ড হবে, যদি ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হয়।
৪। ভিকটিমের যদি ধর্ষণের ফলে মৃত্যু হয়, তাহলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড আইনে আছেই..।

প্রকৃতপক্ষে ধর্ষণের শাস্তি পরিস্থিতি এবং মাত্রা অনুসারে ক্লাসিফাই করা উচিত। কারণ আইন অনুসারে যেহেতু ধর্ষণ বিভিন্নভাবে হতে পারে। আর এটা সম্ভব না হলে, আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করা দরকার। কারণ ঘটনা-১ এর সুযোগ নিয়ে এবং বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে যদি শারীরিক সম্পর্ক করা হয় সেটা আর কুর্মিটোলার ঘটনার মাত্রা এক না। দুটি ঘটনার শাস্তির মাত্রার তারতম্য থাকা উচিত।

ক্রসফায়ারের বিষয়!
আমার মনে হচ্ছে আপনারা যেটা চাচ্ছেন, সেটা ক্রসফায়ার না। আপনারা চাচ্ছেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেমন পাবলিক প্লেসে ফাঁসি দেয়া, কিংবা পাবলিক দেখে মত করে ফায়ারিং স্কোয়াডে দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যেন সব সম্ভাব্য ধর্ষকরা এই শাস্তি দেখে ভয় পায়। সেটাই করা উচিত। আমাদের ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম এমনভাবে সাজানো, যার সিংহভাগেরই উদ্দেশ্যে হচ্ছে একজনকে শাস্তি দিয়ে আরেকজনকে শিক্ষা দেয়া। শিক্ষা দেয়াই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে শাস্তি দেয়ার প্রক্রিয়া এমন হওয়া উচিত যেন মানুষ আসলেই শিক্ষা পায়। আমাদের বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪- এর ৩৪(অ্যা) ধারায় এরকম বিধান আছে যে বিচারক চাইলে এই আইনের অধীনে মৃত্যুদণ্ড ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কিংবা ফায়ারিং স্কোয়াডে দিয়ে করতে পারে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনেও এমন একটা বিধান যোগ করে তার সাথে বলে দিলেই হয় যে এই শাস্তি কার্যকর পাবলিক প্লেসে করা যাবে।

কিন্তু ক্রসফায়ার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা বিষয়, যেটা আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, রাষ্ট্র পরিচালিত হত্যাকাণ্ড। একজন ব্যক্তি ক্রিমিনাল হতে পারে, কিন্তু একটি রাষ্ট্র নয়। আপনি দোষী ব্যক্তির দোষ প্রমাণ করে তার কল্লা কাটেন, ব্রাশফায়ার করেন, যেভাবে ইচ্ছা শাস্তি কার্যকর করেন কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সে আদৌও দোষী কিনা তা প্রমাণিত হওয়ার আগেই অনুমানের উপর ভিত্তি করে তাকে ফায়ার করার নাম ক্রসফায়ার। এমন কিছু আইনের শাসনের পরিপন্থী। হ্যাঁ, আপনি বলতে পারেন কুর্মিটোলার যে ঘটনা, সে ঘটনায় কে দোষী তা তো সবাই জানে। এখানে আবার প্রমাণের দরকার কি? কোর্টে গেলে ধীরগতির কারণে আসামী ছাড়া পেয়ে যাবে, বের হয়ে আসবে, বিচার বিলম্ব হবে ইত্যাদি….

আমি তাদের বলব, তাহলে আপনার সেই সিস্টেম নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন না কেন? কেন প্রশ্ন তুলছেন না যেখানে আইনেই বলা আছে আসামী যদি ধরা পড়ে তার ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে, সেখানে মাসের পর মাস তদন্ত শেষ হয় না কেন? যেখানে অন্য ক্ষেত্রে ৩০ দিনে তদন্ত শেষ করতে বলে সেখানে বছরের পর বছরে তদন্ত শেষ হয় না? যেখানে আইনে বলা আছে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে, সেখানে ১৮ মাসেও বিচার শেষ হয় না?

বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন, সাথে এই প্রশ্ন কেন তুলছেন না যে যেখানে আমেরিকায় ৩২ কোটি মানুষের জন্য ৮৫ হাজার বিচারক, সেখানে আমাদের ১৭ কোটি মানুষের জন্য মাত্র ১৭০০ বিচারক!

একজন বিচারক বা বিচার বিভাগ ঘটনাস্থলে এসে বিচার করে না, তদন্ত করে না। কোর্ট যদি তার সামনে ডকুমেন্ট না পায়, তাহলে কিছুই করতে পারে না। ডকুমেন্ট সামনে পেলে বিচার করতে ২০ দিনও লাগবে না। যে কারণে বিচারালয় আগাতে পারছে না, আপনাদের মুখে সেই সব নিয়ে কথা নেই কেনো?

যদি আপনারা উপরের প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর বের করতে পারেন, তাহলে প্রতিটা ধর্ষণ, প্রতিটা হত্যাকাণ্ড এবং প্রতিটা জঘন্য অপরাধের বিচার আপনি অটো পাবেন, প্রতিটা ঘটনার জন্য আপনাকে রাস্তায় নামতে হবে না, মিছিল করতে হবে না, কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের ছাত্র/ছাত্রী হতে হবে না। আপনি যেমন এদেশের নাগরিক, বোবা, অন্ধ, ভিক্ষুকও এদেশের নাগরিক। সবাই বিচার পাবে, এটাই আইনের শাসন। এগুলো সব ঠিক থাকলে, আপনি এত ধৈর্য্যশীল হয়ে ৫০-৬০ দিন ধৈর্য্য ধরতে পারবেন না ন্যায়বিচারের জন্য? নইলে তো বিচার হবে না। বরং ক্রসফায়ারের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে খুনী বানাবেন। আপনি কি সেটা চান, নাকি ন্যায়বিচার চান, সেটা ডিসাইড করেন।

“justice hurried is justice buried”।

লেখক: প্রভাষক, আইন বিভাগ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।