রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

স্বায়ত্তশাসনের সংজ্ঞা বদলে গেলে বিপদ

প্রকাশিতঃ ২০ অগাস্ট ২০১৯ | ১০:২২ অপরাহ্ন


মাসুদ ফরহান অভি : যারা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) অধীনে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেন তাদের প্রত্যেকেই কেউ শিক্ষা, কেউ এডমিন, কেউ পুলিশ কেউ বা ফরেন এফেয়ার্স এভাবে নিজেদের পছন্দের বিষয় সিলেক্ট করে দেন ফরম পূরণের সময়েই। পরীক্ষার সকল স্তর পার করে রেজাল্ট পাবলিশ হওয়ার পর জানা যায় কে কোন পদের উপযুক্ত ক্যাডার হিসেবে সুপারিশ প্রাপ্ত৷

এরপর আবার নন-ক্যাডার হিসেবেও কিন্তু অনেককে সুপারিশ করা হয়। যেমন প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার ব্লা ব্লা ব্লা। প্রার্থীরা কিন্তু এই পদে যেতে বিসিএস এর ফরম পূরণ করেনি তখন। ফরমের কোথাও প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার পদে পূরণ না করলেও পিএসসি প্রার্থীদের যোগ্যতা অনুযায়ী ওই সকল পদে নিয়োগের সুপারিশ করে। যার ইচ্ছে সে যোগদান করে, যার ইচ্ছে সে যোগদান করে না।

অতএব পিএসসি একটা আইন, বিধি বা সরকারি প্রজ্ঞাপনের ভিত্তিতেই বিসিএস ক্যাডারের পাশাপাশি নন-ক্যাডার পদেও সুপারিশ করে থাকে। পিএসসি’র কাজ প্রার্থীদের যোগ্যতা অনুযায়ী প্যানেল করে দেয়া৷ চাকরিটা অনুমোদন দেয় সংস্থাপন মন্ত্রনালয়৷ যাবতীয় ক্ষমতা জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের। এক্ষেত্রে পিএসসি’র সুপারিশ প্রাপ্ত ক্যাডারের চাকরি হয় মন্ত্রনালয় চায় না বলে।

প্রার্থী যদি রাষ্ট্রবিরোধী কাজে সম্পৃক্ত থাকে, তার ব্যাপারে যদি রাজনৈতিক নেতিবাচক কোনো প্রতিষ্ঠিত থাকে সেক্ষেত্রেও কিন্তু চাকরি হয় না। এটিও কিন্তু বিধি’র মধ্যেই আছে। মানে মন্ত্রণালয়ের এখতেয়ারের মধ্যেই এ বিষয়গুলো পড়ে যায়। এটি নৈতিক নাকি অনৈতিক তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে কিন্তু অবৈধ যে নয় তা নিশ্চিত। আইন বা বিধি তাকে এই ক্ষমতা দিয়েছে বলেই এটি অবৈধ নয়।

ঠিক একইভাবে যেকোনো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানও একটা নীতি, বিধি, প্রজ্ঞাপন তথা আইনের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়৷ নিয়োগ, পপদোন্নতিসহ পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান নিজেদের পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করে থাকে৷ এবং এসব প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতার কেন্দ্র কখনোই বিকেন্দ্রীকরণ হয় না। আইনও এটিকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে দেয় না।

আমি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের খবর জানি, যেখানে একটি কক্ষের সামনে দশটি গাছের চারা রোপণের অর্থ ছাড়ের সিদ্ধান্তও প্রতিষ্ঠান প্রধানকে দিতে হয়! হোক না সে অর্থের পরিমাণ চার-পাঁচ ‘শ বা হাজার পাঁচেক টাকা। কিন্তু আইনের কারণে পরিচালনা পদ্ধতির কারণে ছোটখাটো সিদ্ধান্ত থেকে সর্বোচ্চ সিদ্ধান্তের কেন্দ্রবিন্দু প্রতিষ্ঠান প্রধানই।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাংবাদিকতা চর্চা করতে গিয়ে দেখেছি নানা কিছু। যেমন শিক্ষকদের পদোন্নতির জন্য প্রবন্ধ লিখা বাধ্যতামূলক। এই প্রবন্ধগুলো নির্দিষ্ট মানদণ্ডে উন্নীত ও গ্রহনযোগ্য হতে হবে। মানদণ্ড আবার একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেকরকম৷ যেমন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যে জার্নালটিতে প্রবন্ধ প্রকাশ হলে শিক্ষকের পদোন্নতির জন্য গ্রহনযোগ্য হবে না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তা গ্রহনযোগ্য। নিয়োগের বিষয়ও একই। একই বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে যোগ্যতার পয়েন্ট স্নাতকে ৩ দশমিক ৫০, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে ওই বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে প্রার্থীর স্নাতকে থাকতে হবে ৩ দশমিক ৬০!

অর্থাৎ প্রতিটা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার রীতি, নীতি স্বতন্ত্র। কেউ যদি এসে বলে এটা বৈষম্য, এটা অনিয়ম অথবা যদি বলে এটা দুর্নীতি তাহলে তা গ্রহনযোগ্য হবে না। এক্ষেতে যা ঘটতে পারে তা হল, স্বায়ত্তশাসনের সংজ্ঞা বদলে ফেলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় যদি স্বায়ত্তশাসিত হয়, তাহলে হস্তক্ষেপ বাইরের হস্তক্ষেপ অগ্রহণযোগ্য। কারণ এটি রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি রাষ্ট্র। এখানে পার্লামেন্ট আছে, যেটাকে সিনেট বলা হয়। এখানে আছে মন্ত্রীসভা, যেটা কে বলা হয় সিন্ডিকেট। এখানে জবাবদিহিতা আছে। এই জবাবদিহিতা অবশ্যই আভ্যন্তরীণ। এই পর্ষদগুলোই একমাত্র নীতি, রীতি, বিধি, নিয়ম, নৈতিকতা নির্ধারণ ও মনিটর করার এখতেয়ার রাখে। প্রয়োজনে আপত্তিও তুলতে পারে৷

এখানে দাবি উঠে। আন্দোলন হয়। এখানে সংগ্রাম হয়। এখানে অনশন চলে। এখানে ঘটে শ্লোগান- মিছিলের অন্যরকম এক সমীকরণ। আবার সবকিছুর সমাধানও এখানেই ঘটে। বাইরের কেউ এসে এখানে সমাধান দিতে পারে না। সুযোগ নেই। সম্পুর্ন গণতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসন এটাকেই বলে।

আবার ১৯৭৩ এর এক্ট অনুযায়ী পরিচালিত চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের উপর যে ক্ষমতা অর্পন করা হয়েছে তা আকাশচুম্বী। প্রচলিত আছে, ‘তারা শুধু দিনকে রাত, রাতকে দিন করতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে আর সবই করতে পারেন’। রাষ্ট্রের আইনই তাদের এই ক্ষমতা দিয়েছে৷ তাদের ক্ষমতা অসীম। কারণ এই এক্ট বলছে, উপাচার্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সিদ্ধান্ত গ্রহনের প্রধান নিয়ামক। এর উপর আছেন চ্যান্সেলর বা রাষ্ট্রপতি। আবার যদি এই ক্ষমতা দেয়া না থাকতো তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনাও কঠিন হয়ে যেত। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। প্রতিনিয়ত জরুরি কিংবা তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নেয়ার মত প্রতিষ্ঠান এটি।

এখানেই স্বায়ত্তশাসনের ফ্যাক্ট নিহিত। রাষ্ট্রীয় আইন, এক্ট বা অধ্যাদেশ বলে পরিচালিত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনার প্রত্যেকটা স্তর সুক্ষ্ম। বিশদ পরিসরে অধ্যয়নের দাবিও রাখে।

এখন শুরু হয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা প্রনয়ণের কাজ। এ নীতিমালা স্বায়ত্তশাসনের সংজ্ঞার পরিপন্থী কি-না তা একটি প্রশ্ন। যদি স্বায়ত্তশাসন বলবৎ থাকে তাহলে কেন কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা করতে হবে? তাহলে কেন কর্মকর্তা, কর্মচারীও অভিন্ন নীতিমালার মাধ্যমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ হবে না? সর্বপরি স্বায়ত্তশাসনের দরকার কি- একসময় এই প্রশ্নই বা কেন উঠবে না? যারা এসব নিয়ে ভাবছেন, ভেবে থাকেন তাদের পাশাপাশি যারা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদেরও এমন হাজারো প্রশ্নের উত্তর ভাবা উচিত।

এবার একটু অন্যদিকের কথা ভিন্নভাবে বলি। ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ’ এই কথার সঙ্গে আমরা পরিচিত। কিন্তু আমরাও এই কথাও বলে বেড়াই তথা বিশ্বাস করি, ‘অন্যের জন্য গর্ত খোড়া হলে, প্রকৃতি সেই গর্তে নিজেকেই টেনে ফেলে’। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কয়েকটিতে এখন যা অবস্থা তা হল, একজন প্রতিষ্ঠান প্রধানের প্রতিষ্ঠান পরিচালনার পদ্ধতি বা গৃহীত সিদ্ধান্তকে বিতর্কিত করার আয়োজনের আসর বসিয়ে, সামিয়ানা টাঙিয়ে তার নিচে সুখ নিচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানগুলোরই অংশীদাররা। কিন্তু বিপরীতে নিজের উপর যখন প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কাজটি বর্তাবে তখন যে তা কঠিন হয়ে যাবে সে খেয়াল নেই।

আইন-আদালত পর্যন্ত গড়িয়ে যখন কাদামাখা জল শুকিয়ে যাবে তখন বদলে যাবে হয়তো স্বায়ত্তশাসনের সংজ্ঞা।

সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ আদালতের একটা ঐতিহাসিক রায় দিয়েই লিখার ইতি টানবো।

পুরনো ঢাকার ওয়াইজঘাটে মুন সিনেমা হলের মালিক ছিলো ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এটিকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয় যা পরে শিল্প মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে ন্যস্ত করে। যদিও ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লিমিটেডের মালিক মাকসুদুল আলম এর মালিকানা দাবি করেছিলেন।

পরে ১৯৭৭ সালে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের সামরিক ফরমানে বলা হয় সরকার কোন সম্পত্তিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করলে তা আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবেনা।

এর প্রেক্ষাপটে ২০০০ সালে এসে ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লিমিটেড হাইকোর্টে একটি রিট করে পঞ্চম সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে এবং এর ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালের অগাস্টে হাইকোর্ট ১৯৭৫ এর পনেরই অগাস্টের পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ, বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ও মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণকে অসাংবিধানিক ও বেআইনি ঘোষণা করে। সুপ্রিম কোর্টও পরে ২০১০ সালে এ রায় বহাল রাখে।

এই রায়ের ঘটনা এই কারণেই টানলাম, মুন সিনেমার মালিক শুধুমাত্র তার মালিকার স্বত্ত্ব ফিরে পেতে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিল। কিন্তু তার এই শরণাপন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে পালটে গেল দেশের সংবিধান, ঐতিহাসিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট! তাই স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান পরিচালনার নীতি, বিধি বা সিদ্ধান্ত ইস্যুতে ‘খেলতে’ নামার আগে অবশ্যই তার পরিণতি আন্দাজ করেই নামা উচিত। না হয় মুন সিনেমা মামলার শেষ পরিণতির মত কোন স্বায়ত্তশাসনের সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়ে নিয়ন্ত্রিত স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা পায় কি-না তাও ভেবে দেখা উচিত। কারণ আদালতের কাছে সবাই যেতে পারে। দেশের নাগরিক মাত্রই আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার এখতেয়ার রাখে। দেশের উচ্চ আদালত এখনো স্বাধীন।

এসব মেনে নিয়ে মনে মনে সুখ নিলে নিজের গায়েই আসবে। নগর পুড়লে যে দেবালয় এড়ায় না! স্বায়ত্তশাসনই যদি শেষ পর্যন্ত বেলাভূমিতে আছাড়া খেয়ে আহত হয়ে পড়ে থাকে, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের ভবিষ্যতই নিশ্চিত তলাবিহীন ঝুড়িতেই পরিণত হবে।

লেখক: সাবেক সহ সভাপতি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি