রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

চবি সিনেটের উপর ২৮ হাজার শিক্ষার্থীর দীর্ঘশ্বাস

প্রকাশিতঃ ২৬ জুলাই ২০১৯ | ৮:৪৮ অপরাহ্ন


ইফতেখার উদ্দিন আয়াজ : আগামীকাল ২৭ জুলাই ২০১৯ সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, যে শিক্ষার্থীদের জন্য রাষ্ট্র এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে, সে শিক্ষার্থীদের অধিকার, সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলার মত কেউ কাল থাকবেনা এই অধিবেশনে।

অথচ প্রতিষ্ঠার ৫৩ বছর পরও এই বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়নি, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের এখনো প্রাণ হাতে চড়তে হয় ঝুঁকিপূর্ণ শাটলট্রেনে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এখনো শতভাগ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানী স্বরুপ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের এখনো রাজাকারদের প্রেতাত্মারা বিশেষ ব্যবস্থায় উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার সুযোগ পায়।

এখনো এ বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকদের অসম্মানিত হতে হয় স্বাধীনতার বিরোধী অপশক্তির দোসরদের মুখে, বিভাগগুলোতে শিক্ষকদের বানানো নিয়মে বলি হয়ে শিক্ষার্থীদের অবৈধ ফি দিতে হয়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো সুপেয় পানির কোনো ব্যবস্থা নেই, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি বছরের পর বছর আটকে থাকে অথচ শিক্ষকদের পদোন্নতি যথাসময়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিজলিবাতির গতিতে হয়ে থাকে।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের এখনো গণরুমে মানবেতর জীবন পার করতে হয়, এখনো এক বিছানায় দুই-তিনজন করে আমার বোনেরা পড়ে থাকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের আশায়! ছাত্রী হলগুলো যেন একেকটি কারাগার! এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আজ প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা অনিয়ম করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য কেউ করেনা। গণমাধ্যমে তথা পত্রপত্রিকায় চোখ বুলালে দেখা মিলছে কিছু শিক্ষকের অনৈতিক ক্ষমতা চর্চার নজিরবিহীন গল্প!

শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের বেলায় নিয়মকানুন আর কালক্ষেপণ করা হয়েছে বারেবারে। অথচ শিক্ষকদের কোনো কাজ থেমে থাকেনি। সময়মত পদোন্নতি, বর্ধিত আর্থিক সুযোগ-সুবিধা এমনকি কোটি টাকা দামি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে চড়ে আমাদের শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্য করা গেছে, ক’দিন পরপর শহরের অভিজাত রেস্টুরেন্টে প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকবৃন্দ, প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ কিন্তু রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডে অভিযুক্ত শিক্ষক এবং নির্দিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় ডিনার করছেন।

সম্মানিত শিক্ষকদের জন্য অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান বিষয়ে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু প্রশাসন যদি দশটি হলের ডাইনিং এর খাবারে যদি বছরে দশ লাখ টাকাও ভর্তুকি দিত তাহলে শিক্ষার্থীদের মানহীন খাবার গ্রহণ করতে হতো না। অথচ ছাত্রসংসদ ফি বাবদ কোটি কোটি টাকা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে। উপাচার্য এবং উপ উপাচার্যের আপ্যায়ন ব্যয় বাবদ যে অর্থ বরাদ্দ থাকে তার অর্ধেকও যদি দশটা হলের ডাইনিং এ ভর্তুকি দিত প্রশাসন তাহলে শিক্ষার্থীদের মানবেতর পরিস্থিতি অনেকটা কাটিয়ে উঠতো।

আজ এ টাকার হিসেব চাওয়ার কেউ নেই। যে শিক্ষার্থীদের টাকায় শিক্ষকরা অতিরিক্ত সুবিধা নিচ্ছেন সে শিক্ষার্থীদের অবস্থা আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে দুর্বিষহ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গত ২৮টি সিনেট অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে ছাত্র প্রতিনিধি ছাড়াই। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ অনুষ্ঠিত না হওয়ায় যে ৫ জন প্রতিনিধি থাকার কথা সে ৫ জন প্রতিনিধি সিনেটে শিক্ষার্থী অধিকারের কথা বলতে পারছেনা। শিক্ষকরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট ১৯৭৩ এর বদৌলতে তাদের ক্ষমতা চর্চা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু এই এ্যাক্টে উল্লিখিত শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের সিনেটে অংশগ্রহণের আয়োজন বন্ধ করে রেখেছে।

বিগত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাকসু নির্বাচন দেয়ার আয়োজন শুরুর গল্প শুনিয়ে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে। তারা গঠনতন্ত্র যুগোপযোগী করার ধোঁয়া তুলে একটি কমিটি করে দিয়েছে। সেই কমিটির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ হাজার শিক্ষার্থীকে আজ পর্যন্ত চাঁদ-সূর্য কিছুই দেখাতে পারেনি। তবুও আমরা আশাহত নই। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সম্মুখ সমরে থেকে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়ে জীবন দিয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রয়েছে অধিকার আদায়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। চাকসু আমাদের অধিকার আদায়ের সূতিকাগার। শিক্ষার্থীদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলে পরিণতির কথা বৃটিশ-বেনিয়া আর সামরিক শাসকদের দিকে তাকালেই দৃশ্যমান হয়ে যাবে। আজকের এই দিনে অবিলম্বে আমি চাকসু নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানাচ্ছি।

সম্মানিত সিনেট সদস্যদের অনুরোধ করবো, সিনেটে অংশগ্রহণ করে ভাল মানের খাবার গ্রহণ এবং তিন হাজার টাকা করে ‘সিনেট সিটিং এলাউন্স’ নিয়েই আপনারা আপনাদের দায় সারবেন না। রাষ্ট্র আপনাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্যই, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই। আপনারা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকটগুলো তুলে ধরুন। চাকসু নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে সিনেটে ছাত্রপ্রতিনিধির অংশ নিশ্চিতের দাবি তুলুন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট ১৯৭৩ এর আলোকে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করুন। না হয় মহাকালের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আপনাদের একদিন জবাবদিহিতা করতে হবে। অধিকার বঞ্চিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ হাজার শিক্ষার্থীর দীর্ঘশ্বাস যেন এই সিনেটের উপরই পড়ছে।

লেখক: সাবেক কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা
ও শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ।