হিমাদ্রী রাহা : বঙ্গবন্ধুর একটা কথা আছে, ‘যে গাছে ফল ধরে সে গাছে মানুষ ঢিল ছুঁড়ে। যে গাছে ফল নেই সে গাছে মানুষ ঢিল ছুঁড়েনা’। জলাবদ্ধতা একটি কঠিন সমস্যা। এটা আমাদের একটি অভিশাপ বলতে পারি। কেন এই সমস্যা সৃষ্টি, কখন থেকে এই সমস্যা সৃষ্টি এগুলো আলোচনা করলে অনেক লম্বা ইতিহাস হয়ে যাবে।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগাপ্রকল্পের ইস্যুতে একুশে পত্রিকাকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সিডিএ’এর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম।
জলাবদ্ধতা ৪০ বছরের পুরনো সমস্যা উল্লেখ করে আবদুচ ছালাম বলেন, জলাবদ্ধতা সমস্যা আজকের না। দীর্ঘদিনের সমস্যা ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে তা প্রকট আকার ধারণ করেছে। যা এখন আসলেই অভিশাপ। ফলে প্রশ্ন উঠতে লাগলো চট্টগ্রাম আসলে বাসযোগ্য থাকবে কি না। ঠিক তখনই এগিয়ে আসলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা।
অতীতের কোনো সরকার জলাবদ্ধতা নিরসনে এগিয়ে আসেনি জানিয়ে ছালাম বলেন, এত বছর অনেক সরকার আসলো- গেলো। কিন্তু শেখ হাসিনার মতো এভাবে কোনো সরকার এগিয়ে আসেনি। এর একটি কারণ জননেত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের মানুষদের ভীষণ ভালোবাসেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুও উনার আস্থার মানুষগুলো পেয়েছেন চট্টগ্রামে। জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম এ আজিজ, এম এ হান্নান, এম আর সিদ্দিকী, আতাউর রহমান খান কায়সার, আমাদের মহিউদ্দিন ভাই, বাবু ভাই, মান্নান ভাই এদের উপর একটা আস্থার জায়গা ছিলো এই চট্টগ্রামে। আর ব্যক্তিগত জীবনেও জননেত্রী শেখ হাসিনার অনেক স্মৃতি আছে এই চট্টগ্রামকে ঘিরে। তাই উনি এগিয়ে আসলেন। এগিয়ে এসে সরাসরি নির্দেশ দিলেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিতে। উনার নির্দেশ পেয়ে সিডিএ উদ্যোগ নিলো। উদ্যোগ নেয়ার আগে সিডিএ কারণ উদঘাটন করলো কি কি কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।
জলাদ্ধতার কারণ উদঘাটন প্রসঙ্গে আবদুচ ছালাম বলেন, আমরা জলাবদ্ধতার ৬টি কারণ উদঘাটন করলাম। প্রথম কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানির উচ্চতা বেড়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় কারণ, নিয়মিত ক্যাপিটাল ড্রেজিং না হওয়ার কারণে নদীর গভীরতা কমে গিয়েছে। তৃতীয় কারণ, খাল ও নালা দখল হয়ে গিয়েছে। চতুর্থ কারণ, খাল নালা ভরাট হয়ে গিয়েছে। পঞ্চম কারণ, নগরায়ণের কারণে জলাধারগুলো বিলীন হয়ে গিয়েছে। ষষ্ঠ কারণ, যেসব খালের উপর পারাপারের ব্রিজ আছে সেসব অনেক পুরনো হওয়ায় তা নিচু হয়ে গেছে এবং ব্রিজের নিচে ইউটিলিটি পাইপগুলো নিচু হয়ে পানিপ্রবাহে বাঁধার সৃষ্টি করছে।
তিনি বলেন, কারণ চিহ্নিত করার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সিডিএ ২টি প্রকল্প গ্রহণ করলো। একটি হলো, জোয়ারের পানি যাতে নগরীতে ঢুকতে না পারে সেজন্য স্লুইচ গেইট নির্মাণ করা। তার অংশ হিসেবে চাক্তাই থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত সাড়ে ৮ কিলোমিটার পর্যন্ত ৩০ ফিট উঁচু বাঁধ কাম রাস্তা নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই সাড়ে ৮ কিলোমিটারের মধ্যেই ১২টি খাল বিদ্যমান। এই ১২ খালের মুখে স্লুইচ গেইট ও জলাধার নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্প দিয়ে তো শুধু নদীর পানি নগরীতে ঢোকা বন্ধ হলো। কিন্তু নিষ্কাশন ব্যবস্থা? এই নিষ্কাশন ব্যবস্থার জন্য সিডিএ দ্বিতীয় প্রকল্প গ্রহন করলো।
সিডিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, নগরীতে বিদ্যমান ৫৭টি খালের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ৩৬টি খালকে কেন্দ্র করে প্রকল্প তৈরি করলো। প্রকল্পের মধ্যে খাল খনন করা, দখলমুক্ত করা, প্রশস্থ করা, খালের দুই পাশে রিটেইনিং ওয়াল দেয়া ও রাস্তা নির্মাণ করা, নিচু ব্রিজ ভেঙে উঁচু করা, ইউটিলিটি পাইপ গুলো কেটে উঁচু করা, পাহাড়ের বালি যাতে শহরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সিলটেপ তৈরি করা এবং জলাধার নির্মাণ করা।
‘এখন আমরা তো করছি চাক্তাই খাল থেকে কালুরঘাট ব্রিজ পর্যন্ত। কিন্তু শহর তো পতেঙ্গা থেকে মদুনাঘাট। বাকি কাজগুলো করবে কে? তাই বাকি কাজের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড উদ্যোগ নিলো। তারা পতেঙ্গা থেকে সদরঘাট ও কালুরঘাট থেকে মদুনাঘাট এই অংশে ৮টি প্রকল্প নিলো। এখানে ২৩টি স্লুইচ গেইট আছে।’
‘এরপর নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর প্রকল্প নেয়া হলো। এরজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পোর্টকে নির্দেশ দিলেন। পোর্ট মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়ে নেভীর মাধ্যমে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু করে দিলো। এরপর এলো নতুন খাল খননের বিষয়। নতুন খাল খননের জন্য সিটি কর্পোরেশন ৬-৭ সাত বছর পূর্বে খাল খনন কর্মসুচি হাতে নিয়েছিলো মেয়র মঞ্জু সাহেব। সেই প্রকল্প পরিবর্তন ও পরিবর্ধিত হয়ে কিছুদিন আগে একনেকে অনুমোদিত হলো।’
আবদুচ ছালাম আরো বলেন, জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের জন্য যে প্রতিষ্ঠান যে প্রকল্প নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছেন তিনি সেসবের অনুমোদন দিয়ে আমাদের চিন্তামুক্ত করেছেন। এর মধ্যে সিডিএ দুইটি প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়। একটি হলো চাকতাই থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত প্রকল্প ও আরেকটি হলো খাল খনন। এই খাল খনন খুব জটিল ও সময়সাপেক্ষ একটি কাজ।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে থেকে মুক্তি দিতে খাল খনন যথাসময়ে শেষ করতে হবে। তাই আমি চিন্তা করলাম সিডিএ তো অনেক বড় বড় কাজ করছে তাই এই জটিল কাজটি এমন কাউকে দিয়ে করা হোক যাদের উপর জনগণের আস্থা আছে। তাই আমি খালখননের কাজটি বড় অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান করে মেয়র মহোদয়ের উপস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে বুঝিয়ে দিলাম। তারা এই প্রকল্পের আওতায় ৩৬টি খাল খনন, রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, খালের পাশে রাস্তা নির্মাণ ও ৫টি স্লুইচ গেইট নির্মাণ করবে।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালের এপ্রিলে সেনাবাহিনী কাজ বুঝে পাওয়ার পর তারা কাজ শুরু করে। কিন্তু এরপরই চলে আসে বর্ষা মৌসুম। কিন্তু তার আগে যেসব স্থানে কাজ করতে পেরেছিলো সেসব স্থানে তেমন জলাবদ্ধতা হয়নি। এরপর বর্ষা মৌসুম শেষে সেনাবাহিনী কনসালটেন্ট নিয়োগ করে। কারণ ৩৬ খালের ক্যাচমেন্ট এরিয়া নির্ধারণ করা অনেক বড় ব্যাপার। খালের ড্রইং, গভীরতা কত হবে, উচ্চতা কত হবে, ২০০ বছর আগে খালগুলো কেমন ছিলো, ২০০ বছর পর কেমন হবে এসব ডাটা সংগ্রহ করতে করতেই ৬-৭ মাস চলে যায়। মাস তিনেক আগে সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় যেহেতু কনসালটেন্সি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার তাই এই বর্ষা মৌসুমের আগে অন্তত খালগুলো পরিষ্কার করে কিছুটা হলেও পানি নিষ্কাশনের উপযোগী করা প্রয়োজন। তাই তারা খাল পরিষ্কার ও অবৈধ দখলমুক্তের জন্য ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিলো।
জনগণকে ধৈর্য্য ধরার আহ্বান জানিয়ে আবদুচ ছালাম বলেন, দেখুন একটা কথা মনে রাখতে হবে, এই জলাবদ্ধতা ৪০ বছরের পুরানো সমস্যা। এই ৪০ বছরের সমস্যা ৮ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে দেড় বছরের মধ্যেই সুফল আশা করাটা বোকামি। এটা একটু সময়সাপেক্ষ বিষয়। জনগণকে একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, জনগণকে অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। যত্রতত্র ময়লা ফেলা, খালকে ডাস্টবিন বানানো, খাল দখল করে দোকানপাট ও ঘর নির্মাণ করা এসব থেকে দূরে থাকতে হবে। যারা খাল দখল করেছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ আল্লার ওয়াস্তে খালের জায়গা ছেড়ে দেন। মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন না করে আপনি যত কোটি টাকার প্রকল্পই হাতে নেন না কেন তার সুফল হবে সাময়িক।
একটি কথা মনে রাখা দরকার, যখন কোন উন্নয়ন কাজ চলমান থাকে তখন সুফল পাওয়া তো দূরের কথা অনেক ক্ষেত্রে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। দীর্ঘমেয়াদী সুফলের জন্য তাই চলমান প্রকল্পের সাময়িক দুর্ভোগ জনগণকে একটু মেনে নিতে হবে। জনগণকে ধৈর্য্য ধরতে হবে।
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের গর্বের ধন। তারা কাজ শেষ না করে ব্যারাকে ফিরে যাবে না। আশাকরছি এই সরকারের মেয়াদেই জলাবদ্ধতা নিরসন হবে।
সম্প্রতি ফেসবুকে মেগা প্রকল্প নিয়ে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের বক্তব্যকে উদ্দেশ্য করে আবদুচ ছালাম বলেন, মেগাপ্রকল্প মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রকল্প। তাই মেগা প্রকল্পের বিরোধিতা করা মানে প্রধানমন্ত্রীর বিরোধিতা করা। মাননীয় মেয়র ৬০ লাখ নগরবাসির প্রতিনিধিত্ব করেন। তাই তাকে বুঝেশুনে বলতে হবে।
একুশে/এইসআর/এসসি