মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী : বাংলাদেশের মানুষের কাছে একখণ্ড ভূমি এখন সাত রাজার ধন। ভূমি মানুষের জীবন-জীবিকার কেন্দ্রবিন্দু, মানুষের স্বপ্ন দেখার একমাত্র সম্বল। বাংলাদেশের আয়তন ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গ কি.মি.। এর মধ্যে স্থলভাগ বা ভূমির পরিমাণ ১লাখ ৩৩ হাজার বর্গ কি.মি.। একখণ্ড ভুমিতে মানুষের অনেক রক্ত, শ্রম ও ঘাম মিশে আছে। মানুষের প্রাণের চেয়েও প্রিয় তার ভূমি। ১৯৫২ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল যেখানে ৪.৫ কোটি, ১৯৭১ সালে তা দাঁড়ায় ৭.৫ কোটিতে। বর্তমানে তা প্রায় ১৬ কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। ৪২ বছরে দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হলেও আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে এক তৃতীয়াংশ। ১৯৮৮ সালে যেখানে দেশে জনপ্রতি আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ০.৮৭ হেক্টর, ২২ বছর পর ২০১২ সালে তার পরিমাণ অর্ধেকে হ্রাস পেয়েছে। ফলে ভূমি ও জনসংখ্যার মধ্যে ভয়ানক এক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। জনসংখ্যার চাপে গ্রামগুলো শহরে পরিণত হচ্ছে, বড় শহরগুলো আরো বড় হচ্ছে এবং ছোট শহরগুলোও বাড়ছে আয়তনে।
ভূমি অফিসের সঙ্গে জনগণের যোগসূত্র অত্যন্ত নিবিড়। ভূমি অফিসে কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, বিচারক, প্রশাসক সবাইকে আসতে হয়। ভূমি অফিসকে ঘিরে হয়রানি, ভোগান্তি ও স্বপ্নভঙ্গের অজস্র ঘটনা মানুষের মুখে মুখে সতত উচ্চারিত হয়। মানুষের প্রিয় অবলম্বন একখণ্ড ভূমির সঠিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ভূমি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের। বাংলাদেশের ভূমি প্রশাসন ব্রিটিশ আমল থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। সে সময় থেকেই ভূমি অফিস নিয়ে মানুষের অভিযোগের শেষ নেই। ভূমি অফিসে নামজারির জন্য কত মাস অপেক্ষা করতে হবে, নামজারির কাগজটুকু কখন হাতের মুঠোয় আসবে, ভূমি রাজস্বের সঠিক পরিমাণ কত- এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব ভূমি কর্মকর্তারা দিতে পারেন না। রেকর্ডপত্র নিজের কাছে সযত্নে সংরক্ষণের পরেও মানুষ শংকায় থাকে, তার ভূমি মালিকানা ঠিকঠাক থাকবে তো!
অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ন ও উন্নয়ন ভূমির উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে। তাই ভূমি নিয়ে বিরোধ বাড়ছে দিনদিন। ভূমিদস্যু ও টাউট বাটপারদের কাছে অনেকে ভূমির মালিকানা হারাচ্ছে। ভূমি আইন ও বিধি-বিধান সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার ফলে মানুষ সংকটে পড়ছে। নানা কায়দা কৌশল কিংবা জোর জবরদস্তি করে ভূমি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। বৈধ মলিকানা থেকেও অনেকে জমির দখল হারাচ্ছে। ভূমি অফিস থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ড হারিয়ে যাওয়ায় অসাধু লোকজন মূল্যবান সরকারী জমির মালিক হয়েছে। ভূমি নিয়ে এসব সংকট আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে।
ভূমি প্রশাসন সংক্রান্ত আইনকানুন ও বিধি-বিধান মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদের ক্যাডার কর্মকর্তারা। তাঁদের চেতনায় সততা ও নৈতিকতা থাকা অপরিহার্য, নচেৎ দুর্নীতি ও হয়রানিমুক্ত ভূমি প্রশাসন নিশ্চিত করা অসম্ভব। শুধু রাজস্ব আদায়ই সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর একমাত্র দায়িত্ব নয়। তার চেয়েও কয়েকটি মৌলিক দায়িত্ব হলো- ভূমি মালিকানা সময়মতো পরিবর্তন, মালিকানা পরিবর্তনের পর রেকর্ড সংশোধন ও হালনাগাদকরণ এবং যথাসময়ে নামজারি কার্যক্রম সম্পাদন। ভূমির সদ্ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণে সতর্ক ভূমিকা পালন, ভূমির ইজারা প্রদানে নিয়ম কানুন প্রতিপালন, খাসজমি ও অর্পিত সম্পত্তির দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ, সততার সঙ্গে ভূমিহীন বাছাইকরণ, রেকর্ড রেজিস্টার নির্ভুলভাবে সংরক্ষণ এবং সরকারি জমি রক্ষায় সাহসী ভূমিকা পালন।
দেশের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের ভূমি অফিসগুলো অধিকাংশই মাটির ঘর, টিনের ঘর কিংবা সেমি পাকা ঘর। এসব অফিসে নেই জৌলুস বা চাকচিক্য। অফিসগুলো শ্যামল ছায়ায় ঘেরা, গ্রামীণ ঐতিহ্য এবং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম, কিন্তু মিশে আছে মানুষের দুঃখ ও কান্না। এককথায় সুশাসনের প্রকট সংকট। ভূমি কর্মকর্তাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি, রীতিনীতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে খাপখাওয়ানোর একটি মানসিক সমঝোতা থাকতে হবে। অনেক দুর্ভোগের মধ্যেও কাক্ষিত সেবা পাওয়ার জন্য মানুষের আকুতি রয়েছে। দুর্নীতি ও হয়রানিমুক্তভাবে কাজ সমাধা হলে মানুষের অন্তরের আশীর্বাদ পড়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপর। এর ব্যত্যয় ঘটলে দিয়ে যায় অশ্রুমাখা অভিশাপ।
ভূমি নিয়ে মানুষের ভোগান্তির মূল ক্ষেত্রগুলো হলো : রেকর্ডিং ব্যবস্থায় অস্বচ্ছতা, নামজারিতে হয়রানি, খাসজমি বন্দোবস্ত প্রদানে অনিয়ম, খাস ও অর্পিত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় অবহেলা, ভূমি রাজস্বের দাবি নির্ধারণে গড়মিল এবং আদায়ে ফাঁকি, খতিয়ানে বেআইনি সংশোধনী, মূল খতিয়ানের পাতা বিনষ্ট করে ফেলা, আদালতে সরকারপক্ষে দুর্বলভাবে যুক্তি ও তথ্য উপস্থাপন, বেআইনিভাবে জমির শ্রেণী পরিবর্তন, অকৃষি জমিকে কৃষিজমি দেখানো, একজনের জমি অন্যের নামে রেকর্ড করা, সরেজমিনে তদন্ত ছাড়াই নামজারির প্রতিবেদন তৈরি, নামজারির পর নতুন মালিকের নামের রেকর্ড সংশোধন না করে পূর্বের মালিকের নামে রেকর্ড বহাল রাখা।
ভূমি মালিকদের যন্ত্রণা উপলব্ধি করার মানসিকতা কর্মকর্তাদের থাকতে হবে, এ মানসিকতা সৃষ্টির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নেই। ভূমির মালিকদের মুখে হাসি ফোটানো তাদের নৈতিক দায়িত্ব। ভূমি প্রশাসনে দুর্নীতি নির্মূলে যে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা, তা ভাঙতে এগিয়ে আসতে হবে সহকারী কমিশনারদের (ভূমি)।
জনগণের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে উদাসীন থাকা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার মতো সমান অপরাধ। অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার ঘোর অন্ধকার দূর করতে কর্মকর্তাদের দৃঢ় পায়ে এগিয়ে আসতে হবে। এ অন্ধকারেই জ্বালাতে হবে সেবার প্রদীপশিখা। সেবার স্পর্শে মুছে দিতে হবে মানুষের ভোগান্তির যন্ত্রণা।
ভূমি অফিসে এসে অনেকক্ষেত্রে মানুষ দুর্ব্যবহারের শিকার হয়। তারপরেও ভূমি অফিসে জনগণকে আসতে হয়। এ বৈরী আচরণ সুশাসনের পথে অন্তরায়। অথচ ভূমি প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভূমির মালিক হিসেবে নিজেরাই যখন ভুক্তভোগী কিংবা হয়রানির শিকার হন, তখন তারা বুঝতে পারেন, এ কষ্টের মাত্রা। সুতরাং সাধারণ মানুষের কষ্টের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতে সক্ষম হলে মানুষের দুঃখের বোঝা লাঘব করা এবং হয়রানির বৃত্তে বন্দী ভূমি মালিকদের উদ্ধার করা সম্ভব হবে। অসীম ধৈর্য ও নিবিড় পরিচর্যায় গড়ে তুলতে হবে সেবামুখী ভূমি প্রশাসন। নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষা করেই ভূমি অফিসে মানুষের প্রবেশ সহজ করে দিতে হবে। এখন উপনিবেশ নেই। জমিদারি নেই। দুর্নীতি ও হয়রানির ঘটনা সরাসরি শ্রবণ করে তাৎক্ষণিক প্রতিকার দিতে হবে ভুক্তভোগীদের।
ভূমি প্রশাসনকে দুর্নীতির জাল থেকে বের করে আনতে হলে অফিস প্রধান তথা কর্মকর্তা হিসেবে সবার আগে নিজের চিন্তা চেতনাকে শুদ্ধ এবং দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। একবার দুর্নীতির দুর্গ ভেঙে দিতে পারলে সৎ প্রশাসনের প্রতি মানুষের আস্থা তৈরি হয়ে যাবে, অধীনস্তরাও বড় কর্তার সততার সঙ্গে নিজেদের অভিযোজন করে নিতে সক্ষম হবে। ন্যায়ের দণ্ড সমুন্নত রেখে ভূমি প্রশাসন থেকে চিরদিনের জন্য মুছে ফেলতে হবে দুর্নীতির কলঙ্ক। ভূমি প্রশাসনে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের মিশন হোক জনসেবা ও ভিশন হোক ভূমি ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা। জীবনের শেষ অবলম্বন ভূমি নিয়ে মানুষ সুস্থ ও সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে চায়- ভূমি অফিসকে ভূমি মালিকানা রক্ষার নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত করতে হবে।
লেখক : সাবেক এডিসি (রাজস্ব), বগুড়া;
বর্তমানে মহাপরিচালক, দুদক