রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

মানবিক পুলিশিং

প্রকাশিতঃ ২৪ মার্চ ২০১৯ | ৮:৫৭ অপরাহ্ন


বিজয় বসাক : তোমার রক্তে বাঁচবো আমি, আমার রক্তে তুমি, জীবনের এই সত্যটাকে যেন আমরা মানি- অমিতাভ ঘোষের গানের এই কথাগুলো সত্যিই হৃদয়স্পর্শী। ভালোবেসে মানুষের জন্য যতগুলো কাজ করা যায় তার মধ্যে একটি স্বেচ্ছায় রক্তদান। পুলিশসেবা সপ্তাহে সেই কাজটিই করেছি আমরা। চেনাজানা নেই, কিন্তু একজনের বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে যখন রক্তের জন্য আকুতি; তখন পাশে দাঁড়িয়েছি আমরা। তৈরি হয়েছে রক্তের সম্পর্ক!

যদিও রক্তদান পুলিশের জন্য নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সবার আগে রক্ত দিয়েছে পুলিশ। জাতির যে কোনো ক্রান্তিলগ্নেও পুলিশ সবার আগে রক্ত দিতে ছুটে গেছে। সেই রক্তদানকে আরো উৎসাহিত করার জন্য পুলিশসেবা সপ্তাহের পঞ্চম দিন ৩১ জানুয়ারি পাঁচলাইশ থানায় রক্তদান কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।

অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান মহোদয়। এরপর পাঁচলাইশ থানা প্রাঙ্গণ থেকে শিক্ষার্থী ও কমিউনিটি পুলিশের সদস্যদের নিয়ে বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের করা হয়। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উত্তর বিভাগের এই কর্মসূচিতে বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি সহযোগিতা দিয়েছে; তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। দিনব্যাপী এই কর্মসূচিতে আমি, পাঁচলাইশ জোনের সহকারী কমিশনার দেবদূত মজুমদার, পাঁচলাইশ থানার ওসি আবুল কাশেম ভুঁইয়াসহ অন্তত ৩০ পুলিশ সদস্য রক্ত দিয়েছেন। কমিউনিটি পুলিশের সাথে সম্পৃক্ত আরো অন্তত ২০ জন স্বেচ্ছায় রক্তদান করেছিলেন সেদিন।

ওই দিন রক্তের জন্য হাসপাতাল, ব্লাড ব্যাংকে ছুটোছুটি না করে পাঁচলাইশ থানায় আসেন বেশ কয়েকজন রোগীর স্বজন। তাঁদের প্রতি আমরা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। আমাদের রক্তে বেশ কিছু মানুষ নতুন জীবন পেয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন, আবার হাসবেন- এর চেয়ে বড় শান্তি, সুখ আর কী হতে পারে?

পুলিশ সেবা সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনে প্রবর্তক স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়েছি আমরা। শিক্ষার্থীদের মাঝে তুলে ধরেছি, যৌননিপীড়ন, মাদক ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের কঠোর অবস্থানের কথা। কীভাবে মাদক ও জঙ্গিবাদ একটা ব্যাধির মতো সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, একেকটি পরিবারকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তাও বুঝিয়েছি ছাত্রছাত্রীদের। পুলিশকে সবসময় তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে অনুরোধ করেছি। সন্ত্রাস, মাদক, জঙ্গিবাদের হাত থেকে জাতিকে রক্ষায় তাঁরাও পুলিশের পাশে থাকবেন বলে কথা দিয়েছেন।

একইদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও আশপাশের এলাকা সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনার কার্যক্রম উদ্বোধন করেন সিএমপি কমিশনার মহোদয়। সেদিন প্রবর্তক মোড়ে আয়োজিত উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত জনতাকে আমরা জানিয়েছি, চট্টগ্রাম শহরের মানুষ যাতে নিরাপদে ঘরে ঘুমাতে পারে, সেজন্য সিএমপি অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। জনগণকে সাথে নিয়ে আমরা মহানগরী থেকে সন্ত্রাস, জঙ্গিকার্যক্রম, মাদক, চাঁদাবাজদের সমূলে উৎপাটন করবো। প্রতিটি জায়গায় নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যবহার হচ্ছে সিসিটিভি ক্যামেরা। কেউ অপরাধ করে পার পাবে না।

সেদিন উপস্থিত সুধীজনরা বলেছেন, পুলিশ সদস্যরা দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাসহ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছে। জঙ্গিবাদ দমন ও মাদক নির্মূলে বাংলাদেশ পুলিশের ভূমিকা দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে। সেবা দিতে গিয়ে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে পুলিশ বাহিনীকে যে কষ্ট স্বীকার করতে হয়, সে কথাও জনপ্রতিনিধি ও সুধীজনরা বলেছেন। জনগণ যে আমাদের ত্যাগ, পরিশ্রমের বিষয়টি বুঝতে পারছে, প্রশংসা করছে- এটাই বড় পাওনা।

সেদিন সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন কার্যক্রম উদ্বোধন শেষে পাঁচলাইশ থানার কার্যক্রম পরিদর্শনে আসেন সিএমপি কমিশনার মহোদয়। পুলিশসেবা সপ্তাহ উপলক্ষে থানা প্রাঙ্গণে স্থাপিত সেবা প্রদানের বিভিন্ন বুথ তিনি পরিদর্শন করেন এবং সন্তোষ প্রকাশ করেন।

এরপর পুলিশসেবা সপ্তাহের তৃতীয় দিন ২৯ জানুয়ারি উত্তর বিভাগের পক্ষ থেকে হামজারবাগ এলাকার একটি কমিউনিটি সেন্টারে দু:স্থদের মাঝে শীতবস্ত্র ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের মাঝে নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়। উক্ত কার্যক্রমে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিএমপি কমিশনার মহোদয়। সেদিন প্রায় ৬শ’ জনকে আমরা শীতবস্ত্র ও আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতে পেরেছি।

এদিকে গত ২২ জানুয়ারি কোতোয়ালী মোড়ে ট্রাকচাপায় নিহত সরকারি সিটি কলেজের মেধাবী ছাত্রী সোমা বড়ুয়ার পরিবারকে সান্ত্বনা দেয়ার কোনো ভাষা আমাদের নেই। তবে দরিদ্র পরিবারটির পাশে দাঁড়াতে আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। পুলিশ সেবা সপ্তাহের চতুর্থ দিন ৩০ জানুয়ারি চান্দগাঁও থানার বাহির সিগন্যাল এলাকার বড়ুয়া পাড়ায় সোমার বাসায় গিয়েছি আমরা। তাঁর বাবা রূপায়ন বড়ুয়া ও মা কুমকুম বড়ুয়ার হাতে ১ লাখ টাকার অনুদান, জামা-কাপড় ও খাবার সামগ্রী তুলে দিয়েছেন সিএমপি কমিশনার স্যার।

এটা সত্যি যে অন্য পেশাজীবীদের চেয়ে বেশি কষ্ট পুলিশকেই করতে হয়। পুলিশের কোনো কর্মঘণ্টা নেই। মানুষ যখনই চায় তখনই পুলিশকে ছুটে যেতে হয়, জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। কাজের এমন চাপ থেকে পুলিশ সদস্যদেরকে মানসিকভাবে প্রফুল্ল রাখতে পুলিশ সপ্তাহের ৬ষ্ঠ দিন ‘ফ্যামেলি ডে’ আয়োজন করা হয়। সিএমপির উত্তর বিভাগের অধীনে থাকা চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, বায়েজিদ বোস্তামী ও খুলশী থানার সর্বস্তরের পুলিশ সদস্যরা এতে অংশ নিয়েছেন। উক্ত অনুষ্ঠানে কমিউনিটি পুলিশের সাথে সম্পৃক্তরাও আমন্ত্রিত ছিলেন।

এদিকে পুলিশসেবা সপ্তাহের শেষ দিন নগরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা উত্তর বিভাগের অধীনে থাকা চারটি থানার কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। তাঁদের সাথে শিক্ষকরাও ছিলেন। পুলিশ কর্মকর্তারা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে থানায় স্বাগত জানান। তাঁরা সবাই সেবা সপ্তাহ উপলক্ষে থানা প্রাঙ্গণে স্থাপিত বুথগুলো, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও অন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের অফিস কক্ষ ঘুরে ঘুরে দেখেন। এ ছাড়া ধরার পর আসামিকে থানার যে অংশে রাখা হয়, সেই হাজতখানাও দেখেছেন শিক্ষার্থীরা। এক কথায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং জননিরাপত্তা বিধানে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পুলিশ কীভাবে কাজ করে, কীভাবে দেশকে নিরাপদ রাখে, সে বিষয়ে প্রায় সব ধরনের ধারণা নিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

পুলিশসেবা সপ্তাহে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমরা করেছি। সেটি হচ্ছে- উন্নত দেশগুলোর মত নাগরিকদের জরুরি প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক সেবা দিতে চালু করা ‘ন্যাশনাল হেল্পডেস্ক ৯৯৯’ এর প্রচারণায় ২৫ হাজার লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে উত্তর বিভাগের পক্ষ থেকে। এর ফলে অনেকেই হয়ত প্রথমবারের মত জানতে পেরেছেন, তাঁদের একটি ফোনকল পেয়েই পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে ছুটে যাবে।

পুলিশসেবা সপ্তাহে উত্তর বিভাগের অধীন চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, বায়েজিদ বোস্তামী ও খুলশী থানা প্রাঙ্গণে আসা মায়েদের জন্য জন্য ‘ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার’ চালু করা হয়। এতে অনেক মা তাঁর শিশুসন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সুযোগ পেয়েছেন। হয়তো পুরো বাংলাদেশে আমরাই এ ধরনের নারীবান্ধব পুলিশিং চালু করেছি। এছাড়া সেবা সপ্তাহে নারী ও শিশুদের সেবা দিতে নারী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে আলাদা বুথ খোলা হয়। সেখান থেকে সহজেই প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা ও পরামর্শ নিতে পেরেছেন অসংখ্য নারী-শিশু।

পুলিশসেবা সপ্তাহ-২০১৯ উপলক্ষে চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, বায়েজিদ বোস্তামী ও খুলশী থানা প্রাঙ্গণে ‘আপনার ওসি’ নামে বুথ খোলা হয়েছিল। পুরো সপ্তাহ সেখানে বসে সরাসরি ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেছেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাবৃন্দ (ওসি)। তাৎক্ষণিকভাবে সমাধানও দিয়েছেন তাঁরা। ফলে মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ গড়ে তুলতে আমাদের উক্ত পদক্ষেপ অত্যন্ত সফল হয়েছে, মানুষের সঙ্গে পুলিশের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

অনলাইন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট বিষয়ে সেবা দিতে সেবা সপ্তাহে প্রতিটি থানা প্রাঙ্গণে ছিল পৃথক বুথ। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট পেতে হলে যে সব নিয়মকানুন মেনে আবেদন করতে হয়, সেসব বিষয় দর্শনার্থীদের কাছে তুলে ধরেন পুলিশ সদস্যরা। এ ছাড়া বুথে বসেই অনেকে তাৎক্ষণিক পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট পেতে আবেদন করেছেন। আর কেউ কেউ বুথ থেকেই হাতে পেয়েছেন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট।

ন্যাশনাল হেল্পডেস্ক-৯৯৯ ও বিডি পুলিশ হেল্পলাইন অ্যাপের কার্যক্রম অবহিত করার জন্য সেবা সপ্তাহে থানা প্রাঙ্গণে বুথ ছিল। ৯৯৯ কলসেন্টারের মাধ্যমে দ্রুত জরুরি সেবা পাওয়া যে সম্ভব, সেটা একেবারে উদাহরণ দিয়ে দর্শনার্থীদের কাছে তুলে ধরেন পুলিশ সদস্যরা। এ ছাড়া নাগরিক তথ্য ফরম পূরণ, বিট পুলিশিং ও কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে সেবা সপ্তাহে।

সবাই একমত হবেন যে, দেশের সকল প্রয়োজন ও সঙ্কটকালে বাংলাদেশ পুলিশ জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধানে নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করছে। তবে কিছু সংখ্যক পুলিশ সদস্যের অপেশাদার কর্মকাণ্ডের কারণে পুলিশকে মাঝে মাঝে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। এমন অবস্থায় পুলিশ সেবা সপ্তাহে সবার মাঝে আমরা বার্তা দিয়েছি, জনহয়রানিমূলক যে কোনো তৎপরতার বিরুদ্ধে পুলিশ ‘জিরো টলারেন্সে’ থাকবে। অপকর্মে লিপ্ত কেউ পুলিশের পোশাকে থাকতে পারবে না। জনগণ ও পুলিশ এক হয়ে কাজ করবে। জনসম্পৃক্ততা সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল করবে বাংলাদেশ পুলিশ।

পুলিশ সেবা সপ্তাহে আমাদের এই বার্তা সর্বত্র পৌঁছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি। এতে জনগণের কাছ থেকে আমরা অকল্পনীয় সহযোগিতা পাচ্ছি। একই কারণে পুলিশ সদস্যদের আচরণেও বদল আসছে। আমি মনে করি, পুলিশ সেবা সপ্তাহে মানবিক আচরণ, সহযোগিতা ও ভালোবাসা দিয়ে আমরা জনগণের আরো কাছাকাছি যেতে পেরেছি, আস্থা অর্জন করতে পেরেছি। যেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর), চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ।
একুশে/বিবি/এসআর