সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

ভ্রমণ | আমার ইউরোপ দেখা

প্রকাশিতঃ ৪ মে ২০১৬ | ৫:১৩ অপরাহ্ন

 

:: আজাদ তালুকদার ::

Screenshot_1১.

বিমান থেকে নেমেই প্যারিস-এর চার্লস দো গোলে এয়ারপোর্ট-এ পুলিশের পাসপোর্ট তল্লাশি। দ্রুততার সঙ্গে এক এক করে পাসপোর্ট দেখছেন আর যাত্রীদের ছেড়ে দিচ্ছেন তারা। কিন্তু যেই আমার পাসপোর্টটি হাতে, ছানাবড়া পুলিশের চোখ! অমনি একবার আমার দিকে, আরেকবার পাসপোর্ট-এর দিকে তাকিয়ে রীতিমতো ভাবনায় পড়ে গেলেন তিনি। না জানি আবার কোন বিপদে না পড়লাম! অজানা এক শংকা! এর মাঝেই ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ বলে পাশের এক নারী পুলিশের দ্বারস্থ হলেন তিনি। দুজনেই মেগনিফাইট গ্লাস দিয়ে ভিসাটির আসল-নকল পরীক্ষা করলেন দীর্ঘসময়। সন্দেহের ঘোর কাটে না তাদের। ততক্ষণে যা বোঝার বুঝে নিলাম, আমি বাংলাদেশি বলে কথা! অগত্যা ছেড়ে দিলাম কপালের উপর যা হবার হবে।

অবশেষে ‘নো প্রবলেম, হি হ্যাজ এন ইউএস ভিসা অলসো’ বলেই ছাড়লেন আমাকে। ভাবছি আমেরিকার ভিসাটি না থাকলে আজ কী হতো আমার! একবুক কষ্ট নিয়ে ইমিগ্রেশন পার হয়ে লাগেজ কর্নারে গিয়ে দেখি ওয়াকিটকি হাতে এক সুদর্শনা আমার সামনে ‘আর ইউ তালুকদার মোহাম্মদ আজাদ?

ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম! ফাইনাল বিপদটা কি তাহলে এখানে? শংকা নিয়ে বললাম ইয়েস! তিনি আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন- বিনয়ের সঙ্গে বললেন, আবুধাবি থেকে আমার লাগেজটা আসেনি। আমার একটা ঠিকানা দিলে তারাই সেখানে রাতের মধ্যে পৌঁছে দেবেন! তাদেরই ফোন থেকে মিলিয়ে দিলাম সন্তান-বন্ধু নিয়ে এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করতে আসা পারিবারিক সম্পর্কের মানুষ রাঙ্গুনিয়ার রূপক কুমার বড়ুয়া। ফোনে রূপকদা ও তার মেয়ে দোলা তাদের বাসার ঠিকানা দিলেন, নোট করলেন সুদর্শনা। এরপর জানালেন আমার জন্য কিছু কম্পেনসেশন অপেক্ষা করছে। হ্যাঁ, লাগেজ পেতে দেরি হলে তারা কিছু কম্পেনসেশন দিয়ে থাকেন নিয়ামানুযায়ী। এক্সিট পয়েন্টের কাছে ইতিহাদ কাউন্টারে মহিলাটির দেয়া কাগজ নিয়ে যেতেই নিমিশে হাতে চলে এলো ৩৬ ইউরো বাংলাদেশি ৩ হাজার ৬শ টাকা।

এই দায়িত্বশীলতা দেখে মুহূর্তেই আগের সব কষ্ট যেন ভুলে গেলাম। অন্যরকম এক ভালোলাগা নিয়ে প্রবেশ করি সুন্দরের রাণীখ্যাত প্যারিস শহরে। সেই থেকে ঘুরছি প্যারিসের পথে-প্রান্তরে। মানুষ প্রেমে পড়লে নাকি কিছুটা ‘পাগল’ হয়। আমি নিশ্চিত, প্যারিসের সুন্দর, প্যারিসের প্রেম পুরোপুরি ‘পাগল’ করবে আপনাকে! সেই প্রেমে পাগল হয়েই মুলত দ্বিতীয়বার প্যারিস আসা আমার…।

সোমবারের প্যারিসটা দারুণ মেঘাচ্ছন্ন। থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছে। বাংলাদেশ হলে মনে পড়তো ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’। কিন্তু এটা প্যারিস। মনে পড়ে গেলো ‘মনে করো বারবারা, সেদিন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল, আর তুমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিলে হাসিমুখে…।’

বারবারার কথা মনে করেই বৃষ্টিস্নাত প্যারিসের হাইস্পিড থ্যালিস ট্রেনে চড়ে মনে হলো অন্য ব্যাপার, অন্য বাতাবরণ। সুন্দর সাজানো ট্রেন, বসার সিটে লাল-নীল সজ্জা। সেই ট্রেনে ঘুরছি পথ থেকে পথে। সঙ্গী রূপকদা, হীরকদা! পরে নিজেদের ছিমছাম গাড়ি নিয়ে আমাদের প্যারিস দেখার সারথি হলেন এখানকার বুড্ডিস্ট কমিউনিটির নেতা সুমন বড়ুয়া, সেবক বড়ুয়া, সুজয় বড়ুয়া। তাদের যোগে অনুভবের জায়গাটা আরো পোক্ত হলো। মনে হলো প্যারিস শহরটা কেবল দেখার জন্য নয়, অনুভবেরও! প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, বাস্তিল দুর্গ, প্যারিস গেট, সেইন নদী, রাজবাড়ি, লুভ্যর মিউজিয়াম, ডিসনিল্যান্ড সর্বোপরি রেস্তোরাঁ, ফ্যাশন

সবকিছুই অন্য এক জগতের। সবকিছুতেই অনন্য এক আর্টিস্টিক, ক্রিয়েটিভ, রোমান্টিক মনের ছাপ পাওয়া যায়। ১৮শ’ শতকে শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা আর রাস্তায় বৈদ্যুতিক বাতি লাগানোর ক্ষেত্রে পৃথিবীর প্রথম শহর হওয়ায় প্যারিসকে বলা হয় ‘সিটি অব লাইট’। সিটি অব লাইটের ফরাসিরা শিল্প-সংস্কৃতির মহান পৃষ্ঠপোষক- কবিতা ভালোবাসে, একটু ভাবুক, খামখেয়ালিও বটে।

Screenshot_2২.

ডিজনিল্যান্ড ও ৪০

ইউরো ফাইনের গল্প!

আমেরিকার ডিজনিল্যান্ডের কথা শুনেছিলাম। কিন্তু প্যারিসের ডিজনিল্যান্ড নিয়ে ভাবিনি। প্যারিস আসার খবরে এক এফবি ফ্রেন্ড ডিজনিল্যান্ডের ছবি ট্যাগ করে বললেন, তা যেন মিস না করি। সিদ্ধান্ত নিলাম আর কোথাও নয় পরদিন মঙ্গলবার ডিজনিল্যান্ডই যাবো। যথারীতি সঙ্গী রূপকদা ও হীরকদা। নতুন করে যুক্ত হলেন রূপকদার মেয়ে দোলা এবং রাঙ্গুনিয়ার সঞ্জীব বড়ুয়া। ট্রামে চড়ে সোজা রেলস্টেশন। সঙ্গে সবার পাঞ্চকার্ড। আমার কাছে টিকেট। আর সে টিকেট কিনতে রূপকদা পাঠালেন ফরাসী ভাষায় পারদর্শী তার কিশোরী মেয়ে দোলাকে। সেই টিকেটে ট্রেনে চেপে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম ওয়ার্ল্ড ডিজনির কল্পনার প্রতিচ্ছবি ডিজনিল্যান্ডে। বিস্ময়ের ঘোর কাটে না! গোটা সৃষ্টির পরতে পরতে যেন বিস্ময়! টিভির বিশ্বখ্যাত কার্টুন চরিত্রগুলো সব সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। নানান রাইড। কোনটা ছেড়ে কোনটায় উঠি এই অবস্থা। এরাবিয়ান নাইটস, পাইরেট অব দ্যা ক্যারিবিয়ান, টারজান এনকাউন্টার, ইন্ডিয়ান ভিলেজ এমনই হরেক রকম জোন। একদিনে সব দেখা সম্ভব নয় বলে সম্প্রতি সৌদি যুবরাজ তার ৪০ জনের টিম নিয়ে সেখানকার দামি সব রিসোর্ট ভাড়া করে নিয়েছিলেন। ডিজনিল্যান্ডের নান্দনিকত্ব উপভোগ করতে ব্যয় করেছেন ১৫ মিলিয়ন ইউরো।

আর সেই বিস্ময়-এর ডিজনিল্যান্ড মাত্র ২ ঘণ্টায়

দেখার চেষ্টা (গন্ধ নেয়া) করে আমরা ফিরছিলাম। ট্রেন-ট্রাম শেষে ফাইনাল গন্তব্যের ট্রামে আমরা। মাত্র ৫ মিনিটের পথ। সিটে বসেই রূপকদা-হীরকদাকে বললাম টিকেট পাঞ্চিং-এর ব্যাপার আছে কি না! বললেন প্রয়োজন নেই, দু মিনিট পরেই তো নামছি। বলতে না বলতেই সঞ্জীব আওয়াজ দিলেন, চেকার, চেকার। তখনই রূপকদা আমার টিকেটটি পাঞ্চ করতে চেষ্টা করলেন। সাথে সাথে মহিলা চেকার চ্যালেঞ্জ করলেন রূপকদাকে। বললেন, তার কার্ডটি পাঞ্চ করা হয়নি। দাদা মেশিনে লাগিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু পাঞ্চ হবার আগেই অসাবধানতাবশত সরিয়ে ফেলেছেন। এ নিয়ে রূপকদাকে ৭ ইউরো জরিমানা তো করলেনই, আর আমার টিকেটের জন্য জরিমানা করলেন ৩৩ ইউরো (বাংলাদেশি ৩৩শ টাকা)। আমি এডাল্ট! কিন্তু আমার টিকেটটি দোলা কিনেছিল বলে তারা তার উপযোগী টিকেট দিয়েছে, অর্থাৎ চাইল্ড ।

বাস, যাই কোথায়! ৪০ ইউরো জরিমানা (সঞ্জীব আগ বাড়িয়ে পরিশোধ করলেন আমার ৩৩ ইউরো) গুণতেই হলো। বাংলাদেশ হলে হয়তো নেতা কিংবা সাংবাদিক বলে রক্ষা পাওয়া যেতো। অথবা চেকারকে গোপনে কিছু ধরিয়ে দিলে হতো! কিন্তু এটা প্যারিস। এখানকার প্রধানমন্ত্রীর জন্য যে আইন, একজন সাধারণ নাগরিকের জন্যও তা। আর সেই সমতা আছে বলেই তারা এত উন্নত, অগ্রসরমান জাতি।

Screenshot_3৩.

এই বুঝি রাজ্যের সমস্ত

পুলিশ ঘিরে ধরবে!

ইজি জেড এয়ারের বিমান ধরতে বুধবার সকাল সকাল উঠি ঘুম থেকে! ১০ টা ৫০ এর ফ্লাইট। গন্তব্য কোপেনহেগেন, ডেনমার্ক। প্যারিস থেকে যথারীতি রূপকদা আর হীরকদাই এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেন আমাকে। বোডিং পাস নিয়ে চেক ইন হতেই মেটাল ডিটেক্টরের সংকেত। মানে আমার শরীরে অবৈধ কিছু আছে! মানিব্যাগ,

ঘড়ি, বেল্ট খুলে দেবার পরও এমন সংকেতে আমি হতবাক! দৌড়ে এলেন এক পুলিশ। এবার

সিরিয়াস তল্লাশি। কিন্তু এবারও একই অবস্থা! ভেবে কূল পাই না এ কেমন কথা! আমার সাথে অবৈধ কী থাকবে! অদৃশ্য কিছু কেউ যুক্ত করে দিল নাকি তাহলে! মনে হচ্ছে এই বুঝি চার্লস দো গোলে এয়ারপোর্টের সমস্ত পুলিশ এসে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়বে আমায় নিয়ে। ঠিক তখনই মনে পড়লো জিন্স প্যান্টের ছোট পকেটে একটা পেনড্রাইভ আছে। সেটি বের করে ফেলার পর দেখি সব ঠিক। যাক বাবা, শেষমেষ রূদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির অবসান হলো।

আরও কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে নির্ধারিত সময়ে আমাদের বিমান ছাড়লো গন্তব্যের উদ্দেশে। সাদামেঘ ভেদ করে চলছে বিমান। তখনো আমার ভাবনাজুড়ে পেনড্রাইভ বিড়ম্বনা। ছোট একটি পেনড্রাইভও কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে! এসব ভাবতে ভাবতে এক ঘণ্টা ৫০ মিনিটে বিমান কোপেনহেগেন এয়ারপোর্টের কাছাকাছি। সবাই নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ সময় বিমানক্রু হাফ গ্লাস পানি বাড়িয়ে দিলেন আমার পাশের সুদর্শনাকে। হকচকিয়ে গেলেন সুদর্শনা। কারণ তিনি পানি চাননি। আমতা আমতা করতেই ক্রু ব্যাপারটা বুঝতে পেরে প্রত্যাশিত জনের কাছেই নিয়ে গেলেন সেই পানি। হাস্যরসের এই দ্যোতনায় চোখোচুখি হলো আমাদের। তিনিই জানতে চাইলেন কোত্থেকে এসেছি, কোথায় যাচ্ছি। তিনি কিন্তু আন্না লেইক। পাশের ইয়াং স্মার্ট লেডি তার মা। কানাডার স্থায়ী অধিবাসী তারা। আলোচনা জমে উঠতেই বিদায়ের সুর বাজিয়ে দিতে হলো।

এয়ারপোর্টে নেমে বিদ্যুতদাকে খুঁজে পাই না! ফোন দিলাম। দাদা বললেন, গেটে দাঁড়ান, ৫ মিনিট লাগবে। পার্কিং জটিলতায় পড়ে দাদা এলেন অন্তত ৩০ মিনিট বিলম্বে। কোপেনহেগেনের সেদিনের আকাশটা অনেক ভারি। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। প্রচুর ঠান্ডা। ড্রাইভিং সিটের পাশে আমি। পেছনের সিটে হিল্লোলদা। দুর্দান্ত ড্রাইভিং বিদ্যুতদার। বিশ্বের অন্যতম

পরিবেশবান্ধব শহর ডেনমার্ক-এর চোখ ধাঁধানো সুন্দর দেখতে দেখতে নিমিশে পৌঁছে গেলাম

বিদ্যুতদার বাসায়। দিলদরিয়া এই মানুষটি স্ত্রী, দুই বাচ্চা নিয়ে থাকেন এখানে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রাক্তন ভিপি এবং সভাপতি ডা. বিদ্যুত বড়ুয়া চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার সন্তান। ডেনমার্ক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তার ডেনমার্কের বাসাতে সারাক্ষণ আড্ডাবাজি। চলে হই হুল্লোড়। এখানকার বাঙালি ছাড়াও সাহিত্য, রাজনীতি ও ‘সুন্দর’-এর যারাই আসুক তার কাছে আসেন, গ্রহণ করেন বিদ্যুতীয় আতিথ্য-ভালোবাসা।

বিদ্যুতদা আমাকে নিয়ে গেলেন কোপেনহেগেনের মৎস্যকন্যার কাছে। মৎস্যকন্যার গল্পটি অনেকের হয়তো মনে আছে। সেই মৎস্যকন্যা এক রাজপুত্রকে ভালবেসে তাকে পাবার জন্য মানবে রূপান্তর হন। কিন্তু রাজপুত্রকে পান না। একপর্যায়ে রাজপুত্রের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দেন। এটিই মুলত ডেনিস লেখক হ্যান্স ক্রিস্টিয়েন আনারসেন-এর লেখা দ্য লিটল মারমেইড। এটি লিখে জগতবিখ্যাত হয়েছিলেন তিনি। ১৮৩৭ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এছাড়া তিনি অসংখ্য রূপকথার গল্প লিখে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। তার স্মৃতির উদ্দ্যেশেই বাল্টিক সাগরের বুকে মূলত এই মৎস্যকন্যার মূর্তিটি নির্মাণ করা হয়। এটি দেখতে দেশ বিদেশের হাজারো পযটক ভিড় করেন। মূর্তিটি দেখলে মনে হবে এখনো মৎস্যকন্যাটি তার রাজপুত্রের আশায় বিষন্ন মনে অপেক্ষা করছে।

এর আশপাশেই বিশ্বখ্যাত মার্ক্স শিপিং লাইনের হেড অফিস, কিং হাউজ, পাশেই রাজার জন্য ক্যাপ্টেন মাক্সের নির্মিত অপেরা হাউজ, ডেনিশ পার্লামেন্ট, রাজা প্রেড্রিক্সের (১৮৪৭-১৯৭২) এর ভাস্কর্য! একে একে এসবের দেখা ও ছবি তুলতে তুলতে অন্য এক জগতে হারিয়ে গেলাম আমি…।
Screenshot_7৪.

ডেনমার্ক সাম্রাজ্যের টোটাল স্থাপনাটিকে জাতিসংঘের ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার ঘোষণা করেছে বহু আগে। কেন এটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত তা কাছে গেলেই বোঝা যায়। সাম্রাজ্যের পুরো স্থাপনাজুড়ে অপেক্ষা করছে বিস্ময় আর বিস্ময়! বাল্টিক সাগরের পাড় ঘেঁষে প্রিন্স অব ডেনমার্ক-এর বাড়ির সামনে এখনো অটুট রেখেছে সেই সময়কার ভয়ঙ্কর সব গোলা-কামান। আছে রয়েল গার্ড। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু দেয়ালটিও বোধহয় এখানে। নিরাপত্তার আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকায় হয়তো সুউচ্চ দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছিল সে সময়। রাজাকে গার্ড অব অনার প্রদান, রাজার নিত্য চলাফেরা, প্রবেশ-বাহিরের এডভ্যাঞ্চারাস সাউন্ডগুলো প্রযুক্তির সাহায্যে এখনো ধরে রাখা হয়েছে। থেমে থেমে শব্দগুলো যখন কানে বাজে তখন অন্যরকম শিহরণ জাগে মনে।

ডেনমার্ক সা¤্রাজ্যের পটভুমিতে সেক্সপীয়র রচনা করেন কালজয়ী নাটক হ্যামলেট প্রিন্স অব ডেনমার্ক। এটি হলো সেক্সপীয়রের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি নাটক। ডেনমার্কের যুবরাজ হ্যামলেট তার পিতা হত্যার প্রতিশোধ নিতে সচেষ্ট হন। তিনি তার পিতার আত্মার কাছে জানতে পারেন তার চাচা ক্লডিয়াসই বিষপানে তাকে হত্যা করে। এই অবস্থায় ক্লডিয়াস ডেনমার্ক-এর সিংহাসনে

আরোহণ করেন এবং হ্যামলেটের মা রাণী গট্রিউটকে বিয়ে করেন। হ্যামলেট ভেবে পান না

এখন তিনি কী করবেন- পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবেন নাকি মার স্বামীকে বাঁচিয়ে রাখবেন- এমনই রগরগে সব কাহিনী ডেনিশ সাম্রাজ্যের পরতে পরতে!

এমনসব কাহিনী মানসপটে সেট করতে একটি নান্দনিক আশ্রয় প্রয়োজন। পাশের বাল্টিক সাগরই মুহূর্ত্বের মাঝে হয়ে উঠলো সেই আশ্রয়, সেই ঠিকানা। মাঝে একটিমাত্র সেতু ডেনমার্ক ও সুইডেনের মধ্যে তৈরি করে দিয়েছে অনন্য বন্ধন। মাত্র আধঘণ্টায় যাওয়া যায় সুইডেন, হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় সুইডেনের কোমল স্পর্শ। মায়াবী এই বাল্টিক সাগরের কিংবদন্তির কথা ভাবতে ভাবতে আমরা চলে আসি ফটিকছড়ির জাহাঙ্গীর ভাইয়ের বাসায়। দেশীয় হরেক রকম মেন্যু দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে ভুলে গিয়েছিলাম আমি দেশে না বিদেশে। টুপিখোলা কৃতজ্ঞতা বিদ্যুতদাকে মনের এমন উদরপূর্তির ব্যবস্থা করার জন্য। ধন্যবাদ সেই সাঈদ ভাইকে, যিনি চমৎকার সঙ্গ দিয়েছেন।


Screenshot_8৫.

বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ বলা হয় ডেনমার্ককে। বলা হয় নারীদের স্বর্গরাজ্য। দ্যা ইউএস রিপোর্ট ও ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট জানাচ্ছে এই তথ্য। এখানে নারী-শিশুর যথেষ্ট অধিকার। পুরুষদের উদ্দেশ্য করে এক মনিষী বলেছিলেন, তুমি কতটা স্মার্ট কিংবা রুচিশীল সেটা নির্ভর করে নারী-শিশুর প্রতি তোমার আচরণ কেমন তার উপর। সম্ভবত নিজেদের সবচেয়ে স্মার্ট প্রমাণের জন্য এখানকার পুরুষেরা নারীদের প্রতি এত উদার, অকৃপণ।

তেমনই কিছু স্মার্ট মানুষের মিলনমেলা বসেছিলো সদ্য প্রতিষ্ঠিত ডেনমার্কস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে বাংলাদেশ-এর ৪৫ তম স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে।

সেই মিলনমেলায় আমন্ত্রিত নগণ্য মানুষটি বোধহয় আমি। এই সুযোগটি অবশ্য করে দিয়েছিলেন আমাদের বিদ্যুতদা, ডা. বিদ্যুত বড়ুয়া। আমি ফ্রান্সে থাকাবস্থায় তিনি এই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। এটি একটি এক্সক্লুসিভ পার্টি, তাই সঙ্গে স্যুট এনেছি কিনা নিশ্চিত হতে চাইলেন বিদ্যুতদা। কিন্তু তা যে আনা হয়নি! দাদা আশ্বস্ত করলেন, ডোন্ট অরি, লাগবে না।

ড্রেস যা আছে তাই পরে যাবেন। আমাদের এই আলাপচারিতার প্রত্যেক্ষদশী প্যারিসের রূপকদা। বিকেল হতেই দেখি আমার সামনে হাজির

ঝকঝকা এক নতুন সুট। চমকে উঠতেই রূপকদা বললেন আমার ভাই ডেনিশ এম্বেসির পার্টিতে যাবে, আর সুট পরবে না তা হয় না, হতে পারে না। সেই মমতামাখা সুট যখন পরতে যাবো তখনই মনে পড়ল প্যান্টটা তো অনেক লম্বা। পরা হবে না ভেবে ফেলে রেখেছিলাম। প্রিয় বিদ্যুতদা নিজের সব কাজ ফেলে ইস্ত্রারির ভাজ আর সুঁই সুতোর কারসাজিতে এক ঘণ্টার চেষ্টায় পরিধান উপযোগী করে তুললেন সুটটি। মনে মনে ভাবি, এমন ভালোবাসা বোধহয় বিদ্যুতদারাই দেখাতে পারেন। এই প্রসঙ্গে তার বিখ্যাত উক্তি, ‘তুমি যদি ফার্স্ট হতে চাও তবে একা যাও, আর যদি অনেকদূর যেতে চাও তাহলে সবাইকে নিয়ে যাও’।

আমি বুঝতে পারি ভালোবাসার অসীম শক্তি। পৃথিবীর সবকিছু নষ্টদের দখলে গেলেও ভালোবাসা কখনো তাদের দখলে যাবে না। সেই ভালোবাসার মানুষদের ভালবাসায় ভর করে ডেনিশে বাংলাদেশ অ্যাম্বেসির প্রোগ্রামে আমাকে যেতেই হলো। দেখা হলো, কথা হলো, সখ্য হলো অনেকের সাথে। ডেনমার্কে নবনিযুক্ত

বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম আব্দুল মুহিত, ডেনিশ এগ্রিকালচার অ্যান্ড ফুড কনসালটেন্ট পিটার মাইকেল হেলার, দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি শাকিল শাহরিয়ার, বাংলাদেশের সমাজকল্যাণ

প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের মেয়ে রুবি, ডেনমার্ক আওয়ামী লীগের সভাপতি আলী মোল্লা লিংকনসহ অনেকের আন্তরিকতা আমাকে খদ্ধ করেছে, সমৃদ্ধ করেছে অশেষ। উষ্ণতার সেই সুঁতো ধরে রাতেই ফের আড্ডাবাজি চললো লিংকন ভাইয়ের ডেনমার্ক এর বাড়িতে (জয় বাংলা হাউস)। বাঙালি স্বাদের নানা খাবার খেয়ে ভুলে যেতে বসেছিলাম আমি বিদেশে। আমার কী দোষ, এখানকার হোমলি এনভায়রনমেন্ট যদি আমাকে সব ভুলিয়ে দেয়!

Screenshot_6৬.

কোপেনহেগেনের মাদকঢেড়ায়…

‘আউট অব ইউরোপ’ ইউরোপের মাঝেই একটি নির্দিষ্ট এলাকার গেইটে এমন লেখা দেখে চমকে উঠবেন যে কেউ। বলছিলাম ইউরোপের মানবিক শহর কোপেনহেগেনের ‘গ্রিনলাইট ডিস্ট্রিক’-এর কথা। এটি এক বিশাল মাদকজোন। হেরোইন, গাঁজা, মদ, বিয়ারসহ যাবতীয় মাদক সেবনের জন্য সরকার ঘোষিত নিরাপদ ও আরামদায়ক ঠিকানা। বিশাল এলাকা নিয়ে মাদকাসক্তদের জন্য নান্দনিক পরিবেশে এই মাদক-আখড়া গড়ে তোলা হয়েছে, যার প্রবেশপথে বড় অক্ষরে লেখা ‘আউট অব ইউরোপ’। রাতদিন ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে এটি। কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক অথবা ভাবুক শ্রেণী যারা সাধারণ অ্যালকোহলের বাইরে একটু অন্যরকম মাদক সেবন চান মূলত তাদের জন্যই এই ‘গ্রিনলাইন ডিস্ট্রিক্ট’। জনশ্রুতি আছে, বহু প-িত আর জ্ঞানী-গুণী এখানে মাদক সেবন করতে এসে সৃষ্টি করেছেন বহু অমর কাব্য, মূল্যবান গবেষণা। তাদের নিরাপত্তার জন্য আছে সব ব্যবস্থা। বিনা অনুমতিতে এখানে

পুলিশ ঢোকা যায় না। একটি নান্দনিক, নিরাপদ, মানবিক শহর কিংবা রাষ্ট্র গঠনের জন্য সদা সচেষ্ট সরকার। তারই অংশ হিসেবে এই নিরাপদ মাদকঢেড়া।

কৌতূহলোদ্দীপক এই ঢেড়ায় ঢু মারতে গিয়েছিলাম একদিন (০১. ০৪. ১৬)। সঙ্গী যথারীতি বিদ্যুতদা। হ্যাঁ, সত্যিই এক অন্য জগত। নানা বয়সী নারী পুরুষের মাদকসেবন আর আড্ডাবাজি চলছে ধুন্ধুমার। এখানে ছবি তোলা নিষেধ। প্রয়োজন হতে পারে ভেবে বিদ্যুতদাকে অনুরোধ করি, মাদকসেবনের দৃশ্য

নয়, ভিউটা তোলা যায় কিনা একটু কৌশল করে। বিদ্যুতদা যেই ক্যামেরাবন্দী করলেন তখনই হাজির একজন- ‘নো ম্যান, প্লিজ ডিলেট ইট’’ বলেই বিনীতভাবে ছবিটি ডিলেট করিয়ে নিলো।

এমনি সব ডিফর‌্যান্ট আয়োজনের মধ্যদিয়ে কোপেনহেগেন হয়ে উঠেছে সব শ্রেণীপেশার মানুষের একটি বাসযোগ্য শহর। এখানকার মানুষের আয়-উপার্জন, জীবনমান ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সুইজারল্যান্ডের পরেই। ডেনমার্কের মানুষ যা উপার্জন করে তা দিয়ে ইচ্ছা করলে ২-৩ মাস পর পর গাড়ি বদলাতে পারে। এছাড়া রাষ্ট্র তার নাগরিকদের গাড়ি কিনে দেবার জন্য সহজ শর্তে ঋণ নিয়ে বসে আছে। এরপরও সহজে তারা গাড়ি কিনেন না। শহরকে ক্লিন ও পরিবেশবান্ধব রাখতে এখানকার বেশিরভাগ নারী-পুরুষ বাই সাইকেলে অভ্যস্ত। বাই সাইকেলে করে অফিসে আসা-যাওয়াসহ নিত্য কাজ সারেন তারা। দূরের পথ হলে ট্রাম কিংবা ট্রেনে চড়েন। মূলত শহরকে দূষণমুক্ত রাখতেই তাদের এই সেকরিফাইস। এজন্য সাইকেলের এই শহরকে বিশ্বের অন্যতম পরিবেশবান্ধব শহরও বলা হয়।

৭.

ইউরোপ-আমেরিকা ট্যুরের শুরু থেকে বিদেশি এয়ারপোর্টগুলোতে ‘বাংলাদেশ বিড়ম্বনা’ লেগেই আছে! সোমবার কোপেনহেগেন এয়ারপোর্টে ফাইনাল পাসপোর্ট-টিকেট চেকিং-এর পর ইজি জেড এয়ারের বিমানে চড়ার জন্য সবার মতো লাইনে দাঁড়িয়েছি। মাত্র ১০-১৫ সেকেন্ডের চেকিং। দেখেই দ্রুততার সঙ্গে ছাড়ছেন সবাইকে। যেই আমার পাসপোর্টে বাংলাদেশ দেখলো অমনি আঁতকে উঠলো তারা! কম করে হলেও অন্তত ৫ বার আমার চেহারা আর পাসপোর্টের দিকে তাকালো তারা। ফোন লাগালো উপর মহলে! ডেনিশ ভাষায় ৫

মিনিটের মতো আলাপচারিতার পর ছাড়লো আমায়!

মঙ্গলবার তারকিশ এয়ারলাইন্সে ইস্তাম্বুল হয়ে নিউইয়র্ক যাবার পথে প্যারিসের চার্লস দ্যা গোলে এয়ারপোর্টে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখে যথারীতি ভ্রু কুচকানো, বিশদ গবেষণা সবই হলো। তারও আগের অভিজ্ঞতা তো জানিয়েছি!

নিত্য এই অভিজ্ঞতা নিয়ে নিউইয়র্ক-এর উদ্দেশে বিমানে চাপলাম। তখনো ভাবছিলাম বাংলাদেশ বিষয়ে তাদের আন্ডারস্টিমিটের কথা! তাহলে কি তারা জানে না বাংলাদেশ আগের মতো নেই! এখানে জাতির জনকের হত্যার বিচার হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে।

এক দার্শনিক বলেছিলেন, কলঙ্ক আর পাপের বোঝা নিয়ে, চরম অন্যায় মেনে নিয়ে কোনো জাতি এগোতে পারে না। বলা বাহুল্য, দেরিতে হলেও জাতির জনকের খুনী এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে এখন পাপমুক্ত হচ্ছে। আর সেই ‘পাপমুক্তি’ বাংলাদেশ এগিয়ে যাবার প্রথম সোপান। আমি বিশ্বাস করি আগামীর মেধাবী ও তরুণ নেতত্বে বাংলাদেশের ঈর্ষন্বীয় অগ্রগতি হবে। সেদিন খুব বেশি দুরে নয়, এই বিদেশিরাই বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখলে সহাস্যে হাত বাড়িয়ে দেবে। অভ্যর্থনা জানাবে।

আশা জাগানিয়া মন নিয়ে বুধবার (৬ এপ্রিল ২০১৬) বাংলাদেশ সময় সকাল ৯ টায় অবতরণ করি আমেরিকার জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে। এখানে স্ক্যানার মেশিনে নিজেই অপারেট করে পাসপোর্ট, ভিসা স্ক্যান করার পর নানা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে হয়, সাক্সেসফুলি সেগুলো করার পর যথাযথ প্রক্রিয়ায় আঙুলের ছাপ দিতে পারলে ফাইনালি ছবি, ডিটেইলসহ একটি প্রিন্ট বের হয়, সেই প্রিন্টটি নিয়েই কাস্টম অফিসারের কাছে বাকি ফর্মালিটিস সারতে হয়। নতুন এই অভিজ্ঞতা ও অপারেটিংয়ে আমাকে তেমন বেগ পেতে হয়নি। বরং একজন তার্কিশকেও এই কাজে সহযোগিতা করেছি। বাংলাদেশি বলে কাস্টম অফিসারের কাছে আবারও নানা জেরার মুখোমুখি হয়ে বেরিয়ে দেখি কক্সবাজারের উখিয়ার শিপন ও অনুতোষ গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছেন। রাঙ্গুনিয়ার ইছামতির মেধাবী সন্তান ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাসরত রতন জ্যোতি থেরো পাঠিয়েছেন আমাকে রিসিভ করতে। অশেষ কতজ্ঞতা রতনদা, শিপন ও তার বন্ধুর জন্য, যারা ভিনদেশে আমার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন।