রবিবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ৬ মাঘ ১৪৩১

ওষুধের নামে যথেচ্ছাচার

| প্রকাশিতঃ ৪ মে ২০১৬ | ৪:৫২ অপরাহ্ন

:: খন রঞ্জন রায় ::

ওষুধসময়ের ব্যবধানে নতুন নতুন ওষুধের উদ্ভাবন ও ব্যবহার রোগব্যাধি নিরাময়ে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনছে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী অগণিত রোগাক্রান্ত মানুষ সফলভাবে চিকিৎসা নিয়ে নতুন জীবন লাভ করছে। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই সাফল্যকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ম্লান করে দিচ্ছে সমাজশত্রুদের ষড়যন্ত্র, অনৈতিক কার্যকলাপ। বিশেষ করে উন্নতমানের দামী ওষুধগুলো নকল করে বাজারজাত করা হয়। রোগীদের স্বাস্থ্যহানি এবং প্রাণহাণির বিনিময়ে হলেও অর্থ লুটে নেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশের জন্য এটা একটা বিভীষিকাময় ঘটনা। মানুষের অত্যাবশ্যক আইটেমের অন্যতম ওষুধ। রোগ-ব্যাধি মানুষের নিত্যসঙ্গী। প্রতি বছরই নতুন নতুন রোগ-ব্যাধি বাড়ছে। মানুষ ভেজাল, নি¤œমান ও কেমিক্যাল মিশ্রিত খাবার খেয়ে নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম হলো স্বাস্থ্য। কিন্তু মানহীন, ভেজাল ওষুধ সাধারণ মানুষকে চরম বিপাকে ফেলেছে।

এরপর অপ্রয়োজনীয় ওষুধে সয়লাব হয়ে গেছে বাজার। ফলে অতিরিক্ত টাকা খরচ করেও কাক্সিক্ষত সুফল পচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। ওষুধ অধিদপ্তরকে না জানিয়েই কোম্পানিগুলো ওষুধের মূল্য ইচ্ছামতো বাড়িয়ে দিচ্ছে বিষয়টি আরো উদ্বেগের। ওষুধের ব্যাপারটি দেখার জন্য আলাদা একটি অধিদপ্তর রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাদের তদারকির বিষয়টি খুবই দুর্বল। এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে ওষুধ কোম্পানিগুলো। আমাদের ধারণা, শুধু ছোট কোম্পানি ভেজাল ও নি¤œমানের ওষুধের প্রস্তুত ও বিপণন করে। কিন্তু ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত বৃহৎ কোম্পানির ওষুধ কোনো প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই বিপণন করে মাসে কোটি কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে নিচ্ছে। দেশের অনেক নামকরা ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে ভেজাল ও নি¤œমানের ওষুধ বাজারে সরবরাহের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও রহস্যজনক কারণে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছিল না। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের যে অভিযান চলে, তাতে এমন কিছু অনুমোদনহীন ওষুধ কারখানাও আবিস্কৃত হয়, যেখানে ওষুধের কোনো উপাদান নয়, বরং ইটের গুঁড়া, ময়দা, রং ইত্যাদি মিশিয়ে ওষুধ বানানো হয়। এসব ওষুধে রোগ সারার প্রশ্নই ওঠে না, বরং রোগী মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রায় এক হাজার ৩০০ আইটেমের ২৫ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ আছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার চাপে ২০০৮ সালের ২২ মে বংংবহঃরধষ ২০৯টি আইটেমের তালিকা করে। এই ২০৯টির বাইরে দাম নিয়ন্ত্রণ বা মান নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নেই তদারকি প্রতিষ্ঠান ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের। ফলে মালিকপক্ষ তাদের সুবিধামতো দাম বাড়িয়ে নি¤œমানের ওষুধ বাজারজাত করে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকা লুটে নিচ্ছে। ওষুধ অধিদপ্তরের হিসাব মতে দেশে বর্তমানে ২৫৮টি অ্যালোপ্যাথিক, ২২৪টি আর্য়ুবেদিক, ২৯৫টি ইউনানি ও ৭৭টি হোমিওপ্যাথিসহ ৮৫৪টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বছরে ওষুধ বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার। এরমধ্যে আড়াইশ কোটি টাকার ভেজাল ওষুধ তৈরি হচ্ছে। ২৫৮টি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৪০টি কোম্পানির ওষুধ মানসম্পন্ন বলে মনে করছেন ওষুধ বিশেষজ্ঞরা। বাকি কোম্পানির ওষুধগুলো মানসম্মত না হওয়ার কারণে রোগ সারাতে কার্যকর কোনো ভূমিকাই রাখছে না বরং তা রোগীর মৃত্যুকে ‘নিশ্চিত’ করার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকাই নির্মাণ করছে।

পাবলিক ড্রাগস টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে ২০১০ সালে দেশে উৎপাদিত পাঁচ হাজার ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এতে তারা ৩০০টি ওষুধ মানহীন ও ভেজাল বলে শণাক্ত করে। ২০১২ সালে একই প্রতিষ্ঠান আড়াই হাজার নমুনা পরীক্ষা করে শতকরা ১২ ভাগ ওষুধই মানহীন ও ভেজাল বলে মত দেয়। তবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে নকল ও নি¤œমানের ওষুধের সংখ্যা আরো বেশি। পত্রিকায় প্রকাশ, নকল ওষুধ প্রস্তুতে জড়িত থাকায় ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের এক কর্মকর্তা কিছুদিন আগে গ্রেফতার হয়েছিল। বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠানের

সঙ্গে অনেক কর্মকর্তার অসাধু সম্পর্ক রয়েছে। জানুয়ারি ২০১৫ সালের টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৩টি খাতে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ ৫০০ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেন।

চারদিকে ভেজালের ছড়াছড়ির মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি) নীতিমালা অনুসরণ করে মানসম্পন্ন উপায়ে ওষুধ প্রস্তুত না করাসহ আরো কিছু অভিযোগে ৩২টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন সাময়িক বাতিল করেছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এছাড়া আর মাত্র একটি প্রতিষ্ঠানের ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ স্থগিত করা হয়েছে। এর আগে সংসদীয় কমিটির তদন্তপূর্বক সুপারিশের ভিত্তিতে ৬২টি প্রতিষ্ঠানের ওষুধ উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এরমধ্যে নিবন্ধন সাময়িক বাতিল হয়েছে মাত্র ১২টি প্রতিষ্ঠানের। আর ২০টি কোম্পানির উৎপাদন সনদ বাতিলের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। সম্প্রতি ভেজাল ওষুধ প্রতিরোধে পর্যবেক্ষণ সেল গঠনসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ কেন নেয়া হচ্ছে না- তা জানতে চেয়ে সরকারের প্রতি রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। লোভ মানুষকে কতটা নিচে নামিয়ে ফেলেছে যে সেটা আর নতুন করে বয়ানের প্রয়োজন নেই। আলফ্রেড নোবেল অ্যাটম আবিষ্কার করেছিলেন মানবজাতির কল্যাণের জন্য। আর লোভী মানুষেরা সেই অ্যাটম ব্যবহার করেছে মানুষ মারার মহাশক্তিধর অস্ত্র হিসেবে। ভেজাল ওষুধ যে পরিমাণ ক্ষতি

করছে আমাদের, সেটা অ্যাটম বোমার চেয়ে কম ক্ষতিকর ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে এই নির্মম ক্ষতির মধ্যেও এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ভাবছেন তাঁরাই বিষের বাইরে রয়েছে। শুধু তাঁরাই নন, আমাদের প্রশাসনের লোকেরাও ভাবেন, তাঁরা বিষের বাইরে। কিন্তু তারাও বিষাক্ত এই বৃত্তের মধ্যে নিষ্পেশিত হচ্ছেন।

এতো কিছু ত্রুটি বিচ্যুতির পরও দেশে প্রথমবারের মতো স্থাপিত হচ্ছে ওষুধ শিল্প পার্ক। এর ফলে তৈরি ওষুধের পাশাপাশি বিশ্বের ৪৯ দেশে পাঁচ হাজার কোটি টাকার পেটেন্ট ওষুধ রফতানি করা যাবে। মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার বাউশিয়া মৌজায় ২০০ একর জায়গায় স্থাপিত হবে এ পার্ক। শিল্প মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোররেশন (বিসিক)। এর কাজও দ্রুত গতিতে চলছে।

সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে ওষুধ বিজ্ঞানও উন্নত হচ্ছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশে ওষুধ বিজ্ঞানকে উন্নত করতে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। উন্নত বিশ্বে ওষুধ প্রস্তুত রক্ষনাবেক্ষণ ও সরবরাহের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। তাদের মেধা ও শ্রমের বিনিময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান দ্রুত অগ্রগতি লাভ করছে। ১৯৯০ সালে ডিসেম্বর মাসে জেনেভায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার বিশেষজ্ঞ কমিটি সভায় ওষুধ শিল্পে গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিসের উপর গৃহীত ৩২ তম রিপোর্ট ওষুধ উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণের তত্ত্বাবধায়ক বিশেষজ্ঞ হিসাবে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ড্রাগ অ্যাক্ট ১৯৪০ ও ড্রাগ রুলস ১৯৪৫ অনুযায়ী ড্রাগ ম্যানুফ্যাকচারিং লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হিসাবে ফার্মেসি প্রযুক্তিবিদ্যায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টদের কথা গুরুত্বের সাথে বলা

হয়েছে। যা বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার সুপারিশের সাথে সংগতিপূর্ণ এবং এই নীতিমালাই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। ওষুধ উৎপাদন, ক্রিয়া, বিক্রিয়া, ধর্ম, কর্ম, গুণাগুণ এবং ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণের সুক্ষ্ম জ্ঞান ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টদের দ্বারাই সম্ভব। কারণ ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টদের শিক্ষাক্রমে ওষুধ বিজ্ঞান বিষয়ের সব সূক্ষ্ম জ্ঞান দেওয়া হয়। অথচ ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টদের অভাবে এই সব ওষুধ শিল্পে সাধারণ শিক্ষিতদের নিয়োগ দান করা হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে ওষুধ শিল্প ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি আর ভেজালের সমারোহ ঘটছে।

ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টদের শিক্ষানিয়ন্ত্রণকারী ফার্মেসি কাউন্সিল এখন পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারিভাবে ১টিও ‘ফার্মাসিস্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। উপরন্তু আশির দশকে ১৩শত কোটি টাকা ব্যায়ে প্রতিষ্ঠিত মেডিকেল কলেজ ও মেডিকেল স্কুলে পরিচালিত ৫১টি ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে শুধুমাত্র ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বগুড়া ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট কোর্সে প্রতি বছর স্বল্প সংখ্যক ছাত্র ভর্তি করা হয়। ফার্মেসি কাউন্সিলের এই ব্যর্থতা স্বাস্থ্যব্যবস্থা কলঙ্কজনক পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে।

দেশে ভেজাল নকল ওষুধের রমরমা বাণিজ্য, আর চিকিৎসার নামে যথেচ্ছাচার বন্ধ করতে প্রয়োজন প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ডিৃেপ্লামা ফার্মাসিস্ট। এক্ষেত্রে ফার্মেসি কাউন্সিল চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। প্রয়োজন ফার্মাসিস্ট শিক্ষার আলাদা স্বতন্ত্র শিক্ষা বোর্ড। এক্ষেত্রে সম্মিলিত ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট প্রশিক্ষণ নীতিমালা প্রণয়নই স্বাস্থ্যখাতের নৈরাজ্য আর ভেজাল ওষুধ থেকে জাতি কলঙ্কমুক্ত হতে পারে।