রবিবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ৬ মাঘ ১৪৩১

বিকল্পধারাই কি বিএনপির মূলধারা হতে যাচ্ছে?

| প্রকাশিতঃ ৩০ অক্টোবর ২০১৮ | ১:০১ অপরাহ্ন

ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া : সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বিএনপির চেয়ে ঐক্যফ্রন্টের আলোচনাই বেশি হচ্ছে। ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে ‌’একদল, একনেতা’ সর্বস্ব কিছু দল আর সঙ্গে রয়েছে বিএনপি।

ঐক্যফ্রন্টে বিকল্পধারা বাংলাদেশ-এর সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী যোগদান করার কথা থাকলেও নানা নাটকীয়তায় শেষপর্যন্ত তিনি যুক্ত হননি।

ঐক্যফ্রন্টের প্রথম সমাবেশে ড. কামাল হোসেন, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নাম প্রশংসার সঙ্গে উচ্চারণ ছাড়াও জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলেছেন। কিন্তু শহীদ জিয়া বা খালেদা জিয়ার নাম ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল উল্লেখ করেননি।

বিষয়গুলো বিএনপির লোকজন ভালোভাবে নিতে পারেননি। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের সমাবেশেও খালেদা জিয়ার মুক্তি বা তারেক রহমান বিষয়ে কোনো কথা বলেননি কামাল হোসেন। তার বক্তব্যের শেষ দিকে পাশ থেকে বিএনপির এক নেতা খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই-এ দাবিতে তাকে কিছু বলার অনুরোধ করেন। এসময় তিনি কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, মুক্তি চাওয়ার তো কিছু নেই৷ মুক্ত করতে হবে। এটা তো মুক্তি দেয়ার বিষয়।

আবার ১৭ অক্টবর ২০১৮ ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন জাতীয় প্রেসক্লাবে গণফোরামের সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে তারেক বা জামাতের কোনো সম্পর্ক নেই।

বিএনপি বা ২০ দল, যাদের আদর্শিক শক্তি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং শহীদ জিয়ার আদর্শকে বাস্তবায়ন করা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দণ্ডিত হয়েছেন। তাদের বাদ দিয়ে বিএনপির অন্যান্য নেতৃবৃন্দ মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।

ঐক্যফ্রন্টের আরেক নেতা সুলতান মনসুর বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে দেশ পরিচালিত হবে ‘৭২-এর সংবিধানের আলোকে, যা কিনা বিএনপির মূল গঠনতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সেক্ষেত্রে শহীদ জিয়ার আদর্শের কট্টর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী মানুষরা বর্তমান বিএনপি নেতৃত্বের প্রতি কতটুকু আস্থা রাখতে পারেন তা সময়ই বলে দেবে। এছাড়া কট্টরপন্থী বিএনপি নেতৃবৃন্দ এবং ২০ দলীয় জোটের অনেকেই ড. কামালের কার্যকলাপে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না তা বিভিন্নভাবে বোঝা যাচ্ছে।

ঠিক এই বিষয়গুলোর নিয়ে বিকল্পধারা বাংলাদেশ-এর সভাপতি ডা. বি. চৌধুরী অাঙুল উচিয়ে বলেছেন, শহীদ জিয়ার নাম নেয়া হয়নি ঐক্যফ্রন্টের সভায়। এই বিএনপি শহীদ জিয়ার আদর্শ ধারণ করে না। এই কথাগুলো বলে তিনি শহীদ জিয়ার আদর্শিক এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদীর মানুষদের আকৃষ্ট করতে চেয়েছেন।
বিকল্পধারা বার বার বলছে, শহীদ জিয়ার আদর্শকে ধারণ করে আগামির বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে চান।

সুনির্দিষ্ট এই কথাগুলো বলে বিএনপির ঘরানার মানুষদের তিনি বিকল্পধারার পতাকাতলে আবদ্ধ করতে যাচ্ছেন তা বোঝা যায়। ইতিমধ্যে বিএনপি সরকারের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও পরবর্তীতে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এবং একসময় রাজনীতি থেকে অবসর নেয়া ড. শমসের মবিন চৌধুরী এবং ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি গোলাম সারোয়ার মিলন বিকল্পধারায় যোগদান করেছেন। এছাড়া নিষ্ক্রিয় ও সংস্কারপন্থী বিএনপির নেতৃবৃন্দও ক্রমান্বয়ে যোগদান করবেন বলে আশা করছেন বিকল্পধারা নেতৃবৃন্দ।

আরেকটি বিষয় বিএনপি প্রায় সময় বলে থাকে, তারা মুক্তিযুদ্ধের দল। কিন্তু দলটি জন্মলগ্ন থেকে মুক্তিযোদ্ধার দল কিনা তা নিয়ে নানাভাবে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা গোলাম আজমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া, মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকায় অবতীর্ণ আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপতি বানানো এবং সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও মুজাহিদকে বিএনপি সরকারের মন্ত্রী বানিয়েছিল তারা। সেক্ষেত্রে সত্যিকার মুক্তিযুদ্ধ সমর্থিত বিএনপির নেতৃবৃন্দ মনে মনে ক্ষুব্ধ থাকলেও খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকার করতে পারেননি তারা। আজকে বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়া দুজনই দুই মামলায় দণ্ডিত আসামি।

মুক্তিযুদ্ধের সমর্থিত সত্যিকার বিএনপির নেতৃবৃন্দের মনোজ্বালা টের পেয়ে বি চৌধুরী অতীতে তার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির যোগাযোগের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। বলেছেন বিকল্পধারা আগামি দিনে স্বাধীনতাবিরোধী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো শক্তির সঙ্গে যুক্ত হবে না।

তাছাড়া ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বারবার বলেছেন, বিএনপিকে পরিস্কার করতে হবে স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। বিষয়গুলো পরিস্কার না হওয়াও ঐক্যফ্রন্টে বিকল্পধারা যোগ না দেয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে। বিএনপি ঐক্যফ্রন্টে থাকলেও ২০ দলীয় জোটে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত রয়েছে। ঐক্যফ্রন্টের অনেক নেতা মুখে এক কথা বলে কার্যত স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে জনগণের সঙ্গে ভাওতাবাজি করছে।

ইতোমধ্যে বিকল্পধারার অন্যতম নীতিনির্ধারক মাহি বি চোধুরী ঐক্যফ্রন্টের নেতা মান্নাকে বলেছেন, ঐক্যফ্রন্টের নেতারা জনগণকে ধোঁকা দিয়েছে। এই সবের মাধ্যমে বিকল্পধারা জিয়ার আদর্শের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিএনপির একটি ঠিকানা হতে পারে এবং আগামিতে বিএনপির অনেকেই তাতে যোগ দিতে পারে এমনটাই ধারণা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

বাংলাদেশে সবসময় মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির রাজনীতিই প্রাধান্য থাকুক-এটাই প্রগতিশীল সচেতন জনগণ মনে করেন। সে ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দল শক্তিশালী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিশালী বিরোধীদল দরকার। কেননা এধরনের শক্তিশালী বিরোধীদল একটা দেশের গণতন্ত্র সুসংহতকরণ, সুশাসন ও জবাবদিহিতার জন্য অত্যাবশ্যক।

বিকল্পধারা সেক্ষেত্রে তাদের বর্তমান অবস্থান ধরে রাখতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একটি বিরোধীদল হতে পারবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ও শহীদ জিয়ার আদর্শিকদের এবং আওয়ামী বিরোধীদের ঠিকানা হতে পারে এই বিকল্পধারা।

এছাড়া জাতীয়পার্টির এরশাদ না থাকলে জাতীয়পার্টির অনেকেই যারা আওয়ামীবিরোধী তারাও বিকল্পধারায় সামিল হতে পারে। তাই ভবিষতই বলে দিবে বিকল্পধারা সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দল হিসেবে গড়ে উঠছে কিনা!

লেখক : সাবেক ভিপি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রসংসদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।