নাসির উদ্দিন তোতা : একত্রিশ জুলাই, রোববার (২০১৬) সকালের আকাশটা যতটুকু পরিস্কার ঠিক ততটা মলিন ছিল আমার পরিবারের জন্য। আকাশের সমস্ত নীল বেদনা গাঢ় নীল হয়ে এসেছিল আামার কাছে। আমার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী মোসাম্মৎ সামিনা আক্তারের প্রসব বেদনা দিয়েই শুরু হয় দিনটি। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই সকালের আলোয় আমার চারপাশে অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করে। কিন্তু চাপা স্বভাবের সামিনা সেই কষ্টের কথা আমাকে বুঝতে দেয়নি। যাতে আমার দৈনন্দিন কাজের কোনো ব্যাঘাত না ঘটে।
আমাকে তার কষ্টের কথাটি না বলে কন্যাসহ আমাকে স্কুলে পাঠান। মেয়েকে স্কুলে দিয়ে বাসায় ফিরে দেখি তার কষ্ট আরও বেড়েছে। সাথে সাথে চিকিৎসক শ্যালিকাকে ফোন দিয়ে বাসায় আনি। শ্যালিকার পরামর্শে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। ওই হাসপাতালেরই চিকিৎসক তার ছোট বোন। তাই আশ্বস্ত ছিলাম দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে সামিনা। তাই হাসপাতাল ছেড়ে আসি কন্যাকে স্কুল থেকে বাসায় নিতে। এই সময়ে আবার সেলফোন বেজে ওঠায় মন ভারি হয়ে ওঠে।
অপর প্রান্ত থেকে যা জানানো হলো, সকাল নয়টায় সিজার হয়েছে, শিশু ও তার মা কেউ ভাল নেই। শিশুটিকে নিউনেটাল আইসিইউতে স্থানান্তর করা গেলেও, আইসিইউতে বেড খালি না থাকায় নেওয়া যায়নি মাকে। এমন খবর পেয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। তা কন্যাকে বুঝতে না দিয়ে স্কুল থেকে তাকে বাসায় পাঠিয়ে দ্রুত আবার ফিরে আসি হাসপাতালে।
হাসপাতালে একাধিক চিকিৎসক, আত্নীয়স্বজনসহ অনেকের উপস্থিতি ভাবিয়ে তুলল আমাকে। একাধিক চিকিৎসক সভা করছেন মা ও তার নবজাতক সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে। দুপুরের মধ্যে আইসিইউ’র বেড পাওয়া গেল। মা ও তার সন্তান কাউকে দেখার উপায় নেই। আমাকে স্ত্রীর এবং শ্যালককে শিশুর ওষুধ আনার জন্য বিরামহীনভাবে ছুটতে হলো হাসপাতাল থেকে ফার্মেসিতে কিংবা ওষুধ কোম্পানীর অফিসে। এইসব মানসিক উদ্বেগের মধ্যে চিকিৎসকেরা বললেন, রক্ত লাগবে। এক সাথে সাত/আট ব্যাগ। শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের কাছ থেকেই জোগাড় হলো রক্ত। দ্বিতীয় দিনে লাগল আরও সাত ব্যাগ। এবার এগিয়ে এলেন সাংবাদিক বন্ধু ও কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তা।
এভাবে আমার দিন যাচ্ছে দুঃস্বপ্নের মতো নিউনেটাল আইসিইউ আর আইসিইউতে ঘুরে ঘুরে। আমার ঘুম ও খাবার দাবার সব হারাম হয়ে গেছে। রাত কেটেছে হাসপাতালের করিডোরে। রোগীদের গোঙানি আর সদ্য মারা যাওয়া কোনো রোগীর স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশটা কেমন ভয়ংকর হয়ে উঠত। অজানা আশঙ্কায় আমি ছটফট করতাম। আমি মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতাম। বলতাম এই দুঃসহ দিনগুলো থেকে আমাকে মুক্তি দাও। আমার স্ত্রী সন্তানকে তুমি সুস্থ করে দাও। কী একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। নিজেকে বড়ই অভাগা মনে হতো আমার। ভাবতাম কেমন ভাগ্য আমার।
আমার রক্ত যে নবজাতকের দেহে বইছে সে কি ছেলে না মেয়ে তাও তো জানতে পারলাম না এই দুদিনে। দুদিন পর আমার মাথায় একটা আঘাত আসলো। যে এসেছিল পৃথিবীতে। যার আগমনের জন্য আমার স্ত্রী আজ জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, যার জন্য আমার জীবন আজ দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে গেছে, সেই আর নেই। মাত্র দুদিনের জন্য পৃথিবীতে এসে আমাকে নিঃস্ব করে চলে গেল।
রাত বারোটায় তাকে শেষবারের মতো দু’চোখে আমার দিকে ফিট ফিট করে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। দুর্বল শরীরের উপর তখন আকাশ ভেঙে পড়লো। পরে ভাবলাম ভেঙে পড়লে চলবে না। তার নাম রাখলাম সামিউল নাসির। দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করলাম। কিন্তু আমি একনজর দেখার সুযোগ পেলেও তার মা তাও পেলেন না।
সামিনা তখনো আইসিইউতে। তার জ্ঞান ফেরেনি। ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত দিয়ে যাচ্ছি আমরা। চিকিৎসকরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাকে সারিয়ে তুলতে। তৃতীয় দিনের মাথায় তার জ্ঞান ফেরার সুসংবাদ পেলাম। পাশাপাশি আরেকটা সংবাদ পেলাম তার কিডনি কাজ করছে না। এ খবরে আমরা দারুণভাবে ভেঙে পড়ি। চিকিৎসকরা জানালেন, অতিরিক্ত রক্ষক্ষরণের কারণে কিডনির সমস্যা হয়েছে।
তারা আশ্বস্ত করলেন হেমোডায়ালাইসিসের পর তা কাজ করতে শুরু করবে। তাই শুরু করতে হয় ডায়ালাইসিস। সে যে কী কস্ট তা না দেখে বোঝার উপায় নেই। এক একদিন মনে হতো মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলো। পনেরো দিনের মাথায় তার অবস্থার আরো উন্নতি হয়। তখন সবার সাথে কথা বলতে শুরু করে এবং নরম খাবার গ্রহণ করে। তাই কেবিনে নিয়ে আসি।
এক মাসের মাথায় সিদ্ধান্ত হলো বাইরে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করার। তৈরী হলো অফিসিয়াল পাসপোর্ট। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। বহি:বাংলাদেশ ছুটি অনুমোদনের অপেক্ষায় সবাই। এই সময়ে তার শরীরে নতুন উপসর্গ দেখা দিল। জ্বর আসতে শুরু করল। কোনো ওষুধে কাজ হচ্ছে না। একাধিক চিকিৎসক সভায় বসে ওষুধ পরিবর্তন করেও জ্বর সারাতে পারেননি। তাদের অসহায়ত্বের কথা স্বীকার করে জানালেন, শতাধিক পরীক্ষা করেও তারা জ্বরের সোর্স বা সূত্র বের করতে পারেননি। দেশীয় ওষুধের পাশাপাশি বিদেশী নামি দামি ওষুধও কোনে কাজে আসছে না। কিডনির সমস্যার পাশাপাশি জ্বরেই কাবু করে ফেলে সামিনাকে। তাই ৪৫ ব্যাগ রক্তও তাকে সুস্থ করে তুলতে পারেনি। শেষদিকে অকার্যকর হয়ে যায় ওষুধ।
এক অক্টোবর হঠাৎ করে তার শারিরীক অবস্থার অবনতি। কথা বলা ও সামান্য তরল খাবারও বন্ধ হয়ে গেলো। চিকিৎসকদের ওষুধ পরিবর্তনও কোনো কাজে আসেনি। অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাওয়ায় তিন অক্টোবর কেবিন থেকে আবার নেয়া হলো আইসিইউতে। অবস্থা অবনতির দিকে। কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। একদিন পর মঙ্গলবার সকাল সোয়া দশটায় আমাদের সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। দুইদিন বয়সী সামিউলকে নিয়ে তিনি আজ পরপারে। মহান আল্লাহ তাদের বেহেস্ত নসিব করুক।
একদিকে প্রাণপ্রিয় স্ত্রী ও সন্তানকে হারানোর শোক অপরদিকে একমাত্র কন্যার বার বার মাকে দেখার ইচ্ছা। আমার মেয়েটি এখনো জানে না তার মা আর এই পৃথিবীতে নেই। সে জানে তার মা তারাদের দেশে। বাপ-বেটি দু’জনে মিলে তারাদের দেশে খুঁজি তারে। মাঝে মধ্যে সেল ফোন চেয়ে বসে মায়ের সাথে কথা বলার জন্য। মহান আল্লাহর নিকট আর্জি তার সুস্থ অবস্থায় মাকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। সে এখনো আশায় আছে তার মা ফিরে আসবে। মাঝে মধ্যে এমন প্রশ্ন করে বসে যার উত্তর কারো জানা নেই। কল্পনায় মা-ছোট ভাই সাজিয়ে নিজে নিজে অভিনয় করে। অসহনীয় এসব কষ্ট। [ফেসবুকের পাতা থেকে]
লেখক : চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান, বাংলাভিশন