চট্টগ্রাম : আবুল কাশেম চৌধুরী ট্রাফিক বিভাগের একজন কর্মকর্তা। বর্তমানে বন্দর জোনের টিআই (প্রশাসন) হিসেবে কর্মরত। সরকারি এই দায়িত্বের বাইরেও তিনি পরিচালনা করেন একাধিক ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান।
মেসার্স চৌধুরী কন্টেইনার (রিকন্ডিশন কন্টেইনার বিক্রয় প্রতিষ্ঠান), মেসার্স চৌধুরী এন্ড মা রিজিয়া ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি (পরিবহন ঠিকাদার) নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের ভিজিটিং কার্ড আছে আবুল কাশেম চৌধুরীর নামে। বন্দরের নিউমুরিং এমপিবি গেইটের কাছে মাদ্রাসা বিল্ডিংয়ের ৪র্থ তলায় এই দুটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা উল্লেখ আছে ভিজিটিং কার্ডে।
সম্প্রতি এই ঠিকানা ধরে অনুসন্ধান চালায় একুশে পত্রিকা। প্রতিবেদক কথা বলেন স্থানীয়দের সঙ্গে। স্থানীয় একজন পানদোকানি জানান, বন্দর এলাকায় দায়িত্ব পালনের সময় টিআই আবুল কাশেম এ দুটি প্রতিষ্ঠান চালু করেন। স্টাফ রেখে সেগুলো চালাতেন। কিন্তু কিছুদিন হয়, অফিস দুটি এখান থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। সে থেকে টিআই কাশেমের এই দুটি প্রতিষ্ঠানের অফিস কোথায় স্থানান্তরিত হয়েছে তারা জানে না।
সরকারি চাকরির বাইরে ব্যবসা করছেন ভালো কথা-কিন্তু ঢাউস সাইজের ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে, সবাইকে জানান দিয়ে ব্যবসা করার দরকার কী? একজন সরকারি কর্মকর্তা এমন করতে পারেন কিনা- জানতে চাইলে ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) আবুল কাশেম চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার নামে ভিজিটিং কার্ড ছাপানোর প্রশ্নই আসে না। আমি ব্যবসাই করি না, আপনি বলছেন ভিজিটিং কার্ড!’
তাহলে মানুষের পকেটে পকেটে শোভা পাওয়া ভিজিটিং কার্ডগুলো আসল কোত্থেকে- এমন প্রশ্নে আবুল কাশেম চৌধুরী বলেন, আমার নামে এ কার্ড ছাপিয়ে কেউ হয়তো ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছে। কে করছে এই কাজ তাকে আমি খুঁজে বের করবোই, তাকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে।’ এসময় নিজেকে পুলিশের সৎ ও কর্তব্যপরায়ন কর্মকর্তা এবং চাকরি ছাড়া আর কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয় বলে দাবি করেন টিআই কাশেম চৌধুরী।
এরপর কিছুক্ষণ না যেতেই (৭ জুলাই, সন্ধ্যা) আবুল কাশেম চৌধুরীর ড্রাইভার পরিচয়ে আচমকা একুশে পত্রিকা কার্যালয়ে হাজির হন এক যুবক; নাম শাখাওয়াত, বাড়ি ফটিকছড়ি জানিয়ে যুবকটি বলেন, তাকে কাশেম সাহেব পাঠিয়েছেন। কাশেম সাহেবকে নিয়ে লেখালেখি না করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি প্রতিবেদককে নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদানের আশ্বাস দেন। বলেন, তাকে (কাশেম) নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করলে যে কোনো ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
কোনো ধরনের অনিয়ম কিংবা ব্যবসার সঙ্গে কাশেম সাহেবের সম্পৃক্ততা না থাকলে অনুনয়-বিনয় কিংবা তদবির করার কী আছে?- এমন প্রশ্নে ওই যুবক বলেন, ‘নিউমুরিং এলাকায় কাশেম সাহেবের ব্যবসা থাকার কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমার কথা বিশ্বাস না হলে আপনি (প্রতিবেদক) তদন্ত করে দেখুন।’ সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারিতে টিআই আবুল কাশেম চৌধুরীর মালিকানাধীন ‘চৌধুরী এগ্রো ফার্মস লি:’ নামে বিশাল খামার (গরু, ছাগল প্রজণন ও দুগ্ধউৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান) থাকার কথাও কি মিথ্যা?
এ প্রশ্নের পর যুবকের আমতা আমতা ভাব। বলেন, ‘এটা কাশেম সাহেবের নয়, তার ছেলে সাগর চৌধুরী এই ফার্মের মালিক।’ ‘চব্বিশ-পঁচিশ বছরের ছেলে এত বড় এগ্রো ফার্ম খোলার টাকা পেলো কই?’ শাখাওয়াতের দাবি, ছেলেটি লন্ডনে পড়াশোনা করেছে, সেখানে টাকা ইনকাম করেছে। সেই টাকায় এই ফার্ম করেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, একুশে পত্রিকা অফিসে এসে নিজেকে শাখাওয়াত পরিচয় দেওয়া যুবকটি মূলত আবুল কাশেম চৌধুরীর ‘টেন্ডল’ হিসেবে কাজ করেন। তার প্রকৃত নাম রাজু। ট্রাফিক সেক্টরে আবুল কাশেম চৌধুরীর হয়ে চাঁদা তোলাই মূলত তার কাজ।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি মহানগর বিএনপির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্করের বাসায় সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র ও নাশকতার পরিকল্পনায় গোপন বৈঠককালে রাজুকে আটক করে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। তিনমাস কারাভোগের পর বেরিয়ে ফের কাশেমের টেন্ডল হিসেবে যোগ দেন রাজু। টেন্ডল রাজু ইংরেজিতে ‘রাজপাখি’ নামে একটি ফেইসবুক আইডি খোলে বিভিন্ন সময় সরকারের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার, বিষোদ্গার এবং বিএনপির গুণকীর্তন গেয়ে ফেইসবুক পোস্ট দেয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
সল্টগোলা পুলিশ বক্সে কাশেমের পাশের চেয়ারে রাজুর বসে থাকার দৃশ্য এবং আগ্রাবাদ ট্রাফিক অফিসে কাশেমের অফিস কক্ষে রাজুর সেলফিসহ একাধিক ছবি তার ফেইসবুক আইডি ‘রাজপাখি’তে পোস্ট রয়েছে।
শুধু তাই নয়, টিআই আবুল কাশেমও বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তার ফেসবুক আইডিতে অপপ্রচার চালানোর তথ্য উঠে এসেছে। ৬ জুলাই ২০১২ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারকে নিয়ে টিআই কাশেমের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক পোস্টের স্ক্রিনশট পাওয়া গেছে একুশে পত্রিকার অনুসন্ধানে।
এদিকে ২০১৭ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে সিএমপির তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) সালেহ মোহাম্মদ তানভীরের একটি প্রতিবেদনে টেন্ডল রাজুর দৌরাত্ম সংক্রান্তে উঠে এসেছে ভয়ঙ্কর তথ্য।
টিআই আবুল কাশেম চৌধুরীর ব্যবসাসম্পৃক্ততা বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে চাননি উপ পুলিশ কমিশনার ট্রাফিক (বন্দর) ফাতিহা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ‘এটা তার (কাশেম) ব্যক্তিগত বিষয়। সুতরাং তাকেই জিজ্ঞেস করুন।’ সরকারের এরকম পদে থেকে ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে ব্যবসা করার নিয়ম আছে কিনা, সরকারি বিধিতে কী বলে- এমন প্রশ্নে ফাতিহা ইয়াসমিন বলেন, ‘সরি, এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারবো না।’
সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) কুসুম দেওয়ান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এমনটা তিনি (কাশেম) কোনোভাবেই করতে পারেন না। এটা স্পষ্টত সরকারি বিধিবিধানের লংঘন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা হতে পারে। এমনকি চাকরিও চলে যেতে পারে।’
একুশে/এটি