চট্টগ্রাম : একুশে পত্রিকা প্রিন্ট ও অনলাইন ভার্সন নিয়মিত পড়ার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো: আবদুল মান্নান।
একুশে পত্রিকা সম্পাদক আজাদ তালুকদারের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, খুব যত্ন করে সে পত্রিকাটা বের করে। আজাদ তালুকদারকে আমি একেবারে নিখুঁত একজন সম্পাদক বলতে চাই, তরুণদের মধ্যে।
‘একুশে পত্রিকা আমি নিয়মিত পড়ি। কম, বেশি পৃষ্ঠা রাখে না। পত্রিকাটি পড়ে আমি দেখি যে, কোনো জায়গায় ভুল নেই।’
প্রুফ রিডিংকে কঠিন কাজ উল্লেখ করে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো: আবদুল মান্নান বলেন, ‘অসাধারণভাবে সে (আজাদ তালুকদার) কঠিন কাজটি করে। আমি দেখেছি যে, আজাদ তালুকদার এটা পারে। আমি অ্যাপ্রিশিয়েট করছি তাকে আজকে।’
সোমবার রাতে নগরের আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তনে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুল মান্নানের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘দুইবর্ণ’র প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন লেখক নিজে।
এ সময় বক্তব্য দিতে গিয়ে একুশে পত্রিকা ও সম্পাদক আজাদ তালুকদারকে নিয়ে এভাবেই মূল্যায়ন করেন বিভাগীয় কমিশনার মো: আবদুল মান্নান। সে সময় মঞ্চে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আজাদ তালুকদার।
‘দুইবর্ণ’র লেখক মো: আবদুল মান্নান বলেন, ‘সমস্ত লেখকরাই ভালো স্মৃতি-লেখক। তাদের স্মৃতিশক্তি খুবই প্রখর। এই রুমটাতে কী কী আছে আবুল মোমেন সাহেব যত ভালো বলতে পারবেন, এখানে যারা শ্রোতা আছেন তাদের অনেকেই বলতে পারবেন না। আপনারা হয়তো বলবেন, ফ্যান ঘুরছে। এতটুকুতেই শেষ। কিন্তু আবুল মোমেন সাহেব, সত্যব্রত বাবু বা আজাদ তালুকদার, তাদের কিন্তু চর্তুদিকে চোখ আছে। তারা বুঝবেন যে, এখানে অনেককিছু ছিল। লেখক ঠিক সে রকম।’
‘লেখকের কাছ থেকে কোনো কিছু এড়াতে পারে না। এখানে একটা পিন পড়ে ছিল, সেটাও কিন্তু তাঁর লেখায় চলে আসতে পারে। সাধারণ মানুষ যারা, শ্রোতা যারা তাদের সে সুযোগ নেই। এজন্যই লেখক ও পাঠকের মধ্যে পার্থক্য।’ বলেন বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান।
নিজেকে লেখক হিসেবে মনে করেন না জানিয়ে ‘দুইবর্ণ’ বইয়ের লেখক মো. আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমাকে কোনো লেখক বলা যাবে না। সৈয়দ মুজতবা আলী প্রত্যেক ধর্মের প্রবক্তার কসম খেয়ে বলেছেন, আমি জীবনে কোনোদিন লেখক হতে চাইনি।
‘সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো মানুষ যদি এ কথা বলেন, এখন আপনারা আমাকে লেখক বললে আমি লজ্জিত হবো। আমার মনে হয় এটার দাবিদার আমি এখনো হইনি।’ বলেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার।
প্রকাশনা উৎসবের বক্তব্যে বইটির লেখক চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো: আব্দুল মান্নানকে ব্যতিক্রম, অনন্য সাধারণ লেখক হিসেবে অভিহিত করেন একুশে পত্রিকার সম্পাদক আজাদ তালুকদার।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আজাদ তালুকদার বলেন, আমি বিস্মিত হই, মুগ্ধ হই- কেমন করে সারাদিন এত গুরুদায়িত্ব পালন করে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়েও তিনি এত সুন্দর সুন্দর লেখা নির্মাণ করতে পারেন, আমি অভিভূত হই, একজন পেশাদার লেখককেও যখন তিনি হার মানান। তিনি শুধু ভালো লিখেন তাই নয়, তিনি চমৎকার বলেন।
‘তাঁর সব লেখায় চমৎকার শব্দের গাঁথুনি, শব্দচয়ন। আমি আরও বেশি অভিভূত হই তাঁর বানান ও ভাষাজ্ঞান দেখে। যখন একুশে পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপতে যাই, আগে আমাকে পড়তে হয়, তখন আমি নতুন কিছু শিখি, নিজেকে সংশোধিত করি এবং আমার জানা ও না জানার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করি।’
বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান তাঁর লেখনি শক্তি দিয়ে জানা ও না জানার মথ্যে পার্থক্য তৈরির কাজটি প্রতিনিয়ত করে চলেছেন বলে মন্তব্য জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আজাদ তালুকদারের।
একুশে পত্রিকাকে সন্তানতু্ল্য উল্লেখ করে আজাদ তালুকদার বলেন, ‘১৪ বছর ধরে আমি একুশে পত্রিকা সম্পাদনা করছি। যেখানেই আমি চাকরি করি, সংবাদ বিকিকিনি করি, কিন্তু সন্তানের মতো একুশে পত্রিকাকে আমি ছাড়িনি।’
‘সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কর্মস্থলের কাজ শেষ করে, অন্যান্য সংবাদকর্মীরা, বন্ধু-স্বজনরা যখন আড্ডায় মেতে উঠতো, তখন সে সময়টাকে আমি বেছে নিতাম পত্রিকার পাতা ভরাটের জন্য। অনেক কষ্ট করে পত্রিকাটা আমি একটা জায়গায় টেনে এনেছিলাম।’- কথাগুলো বলার সময় গলা ধরে আসে একুশে সম্পাদক আজাদ তালুকদারের।
মাসিক একুশে পত্রিকাকে সাপ্তাহিকে রূপান্তরের কাজ এগিয়ে নেওয়ার স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, আমি স্বপ্ন দেখলাম, পত্রিকাটিকে আমি সাপ্তাহিকে রূপান্তরিত করবো, আমার আবেদনের প্রেক্ষিতে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, ডিজিএফআই, এনএসআই সহ নানা জায়গায় যাচাই-বাছাইয়ের পর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের দপ্তরে ফাইলটি জমা হয়। এখন অপেক্ষা শুধু, আইনজীবীর উপস্থিতিতে সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসক মহোদয় ও পত্রিকার পক্ষে আমি স্বাক্ষর করলেই চূড়ান্ত অনুমোদন হয়ে যাবে।
‘সেদিনের জেলা প্রশাসক জনাব মো: আবদুল মান্নান এখন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার। তিনি ফাইলটি দেখলেন, কী যেন ভাবলেন এবং এরপর আমাকে অনেকগুলো কথা শুনিয়ে দিলেন। আমার চক্ষু চড়কগাছ, আমি অবাক। কী ব্যাপার, ওনি আমাকে চিনেন না বলেই কী এমন আচরণ করছেন?’
আজাদ তালুকদার বলেন, ‘সেদিন নিজেই জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে বের হয়ে এসেছিলাম। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, সাপ্তাহিকে রূপান্তরের যে কাজ সেটা করার জন্য আর কখনো জেলা প্রশাসকের দপ্তরে যাবো না। একুশে পত্রিকার পরপর প্রকাশিত ১২টি সংখ্যা সেদিন আমি ডিসি সাহেবের স্টাফ অফিসারের কাছে দিয়ে এসেছিলাম।’
‘এরপর একইদিন রাত ৮টা কি সাড়ে ৮টা। আমি প্রেসক্লাবে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে বসে আছি। ভাবছি, খেয়ে না খেয়ে, তিল তিল করে গড়ে তোলা আমার সন্তানতুল্য পত্রিকাটার বাড়বাড়ন্ত কি এখানেই থেমে যাবে? ঠিক তখনই স্টাফ অফিসারের ফোন; বললেন, ডিসি স্যার আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। আমি ফোন ধরতেই ও পাশ থেকে তীব্র অনুশোচনা, তীব্র দহন; বললেন, আজাদ, আমি অত্যন্ত দুঃখিত আজকের ঘটনার জন্য। আপনার পত্রিকা দেখেছি, প্রতিটি লেখা পড়ার চেষ্টা করেছি। প্রতিটি পৃষ্ঠা উল্টিয়েছি। আমার জানা ছিল না চট্টগ্রাম থেকে এ রকম একটি পত্রিকা বের হয়। আপনি কালকেই আমার অফিসে আসুন, বসে আমরা কাজটি করে ফেলবো, এক সাথে চা খাবো। সুন্দরের প্রতি একজন জেলা প্রশাসকের এমন আত্মসমর্পণ সেদিন আমাকে আরেকবার বিস্মিত করে।’
‘এরপরের গল্পটা শুধুই এগিয়ে যাওয়ার গল্প, ভালোবাসার গল্প। একদিন তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন, আজাদ আমার যাওয়ার সময় হয়েছে, আমি চলে যাবো। আমার ব্যক্তিগত নাম্বারটা আপনি রাখবেন। আমি যেখানেই থাকি, যে প্রান্তেই থাকি, আপনার সাথে আমার যে সেতুবন্ধন তৈরি হয়েছে, সেটা বজায় থাকবে। আমি আপনাকে লেখা দিয়ে সহযোগিতা করবো। প্রয়োজনে এ পত্রিকাটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমার অবস্থান থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো। এবং তিনি কথা রেখেছেন। তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্তি সচিব যখন হয়েছেন, তখনও তিনি আমার পত্রিকায় নিয়মিত লেখা দিতেন।’
‘ওনার একটা লেখা আমার মনে এখনো দাগ কেটে আছে। তিনি একবার ঈদ সংখ্যায় একটি গল্প দিয়েছেন। গল্পটির নাম ’বানরের নাম শামছু’। তিনি অফিসের একজন কর্মকর্তার অনিয়ম, দুর্নীতিগ্রস্ত মানসিকতার বিষয়গুলো তিনি গল্পের ছলে, ব্যঙ্গ বিদ্রুপের সঙ্গে প্রতীকি অর্থে চমৎকার করে তুলে ধরেছেন। এখনো সে গল্পটি সুযোগ পেলে আমি একবার পড়ার চেষ্টা করি।
অনুষ্ঠানে সাংবাদিকতায় একুশে পদক পাওয়া আবুল মোমেন ও দ্য বেল লেত্ এর লেখক সত্যব্রত বড়ুয়া বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন। উপস্থিত ছিলেন সরকারের অতিরিক্ত সচিব ও স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক দীপক চক্রবর্ত্তী, চট্টগ্রাম আর্ট কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ রীতা দত্ত, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, চট্টগ্রামের পরিচালক ড. সেলভাম থরেজ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) মো. মমিনুর রশিদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. হাবিবুর রহমান প্রমুখ।
একুশে/এসআর/এটি