শরীফুল রুকন : চট্টগ্রাম নগরে এক প্রকাশনা উৎসবে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুল মান্নানের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘দুইবর্ণ’র মোড়ক উন্মোচন হয়ে গেলো ভালোবাসার দ্যুতি ছড়িয়ে।
সোমবার রাতে নগরীর অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তনে এই প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন লেখক নিজে। বিভিন্ন বিষয়ে মোট ২০টি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ‘দুইবর্ণ’-তে।
প্রকাশনা উৎসবের বক্তব্যে বইটির লেখক চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নানকে ব্যতিক্রম, অনন্য সাধারণ লেখক হিসেবে অভিহিত করেন একুশে পত্রিকার সম্পাদক আজাদ তালুকদার।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আজাদ তালুকদার বলেন, আমি বিস্মিত হই, মুগ্ধ হই- কেমন করে সারাদিন এত গুরুদায়িত্ব পালন করে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়েও তিনি এত সুন্দর সুন্দর লেখা নির্মাণ করতে পারেন, আমি অভিভূত হই, একজন পেশাদার লেখককেও যখন তিনি হার মানান। তিনি শুধু ভালো লিখেন তাই নয়, তিনি চমৎকার বলেন।
‘তাঁর সব লেখায় চমৎকার শব্দের গাঁথুনি, শব্দচয়ন। আমি আরও বেশি অভিভূত হই তাঁর বানান ও ভাষাজ্ঞান দেখে। যখন একুশে পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপতে যাই, আগে আমাকে পড়তে হয়, তখন আমি নতুন কিছু শিখি, নিজেকে সংশোধিত করি এবং আমার জানা ও না জানার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করি।’
বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান তাঁর লেখনি শক্তি দিয়ে জানা ও না জানার মথ্যে পার্থক্য তৈরি করার কাজটি প্রতিনিয়ত করে চলেছেন বলে মন্তব্য জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আজাদ তালুকদারের।
তিনি বলেন, সরকারি বড় কর্মকর্তাদের অনেকেই নানা কর্মব্যস্ততার কারণে লালফিতার ফাইলে নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেন, তাদের মৌলিকত্ব বিসর্জন দেন। কিন্তু জনাব আবদুল মান্নান তাঁর মৌলিকত্ব লালফিতায় বন্দি হতে, মিশে যেতে দেননি। তিনি নিজের স্বকীয়তা ধরে রেখেছেন। স্বতন্ত্রতা বজায় রেখেছেন। এখানেই জনাব আবদুল মান্নান আমার কাছে ব্যতিক্রম, অনন্য সাধারণ।
আবদুল মান্নান প্রশাসন ক্যাডারের একজন বড় কর্মকর্তা হিসেবে যেমন সফল, তেমনি লেখালেখির জগতেও তিনি সফল বলেও মন্তব্য করেন আজাদ তালুকদার।
লেখা দিয়ে তাঁর মনের মধ্যে বিভাগীয় কমিশনার দাগ কেটেছেন জানিয়ে আজাদ তালুকদার বলেন, আমি মনে করি একজন মানুষকেও যদি দাগ কাটতে পারে সেটা অনেক বড় স্বার্থকতা। সততা ও শ্রমে, মেধা ও বিশ্বাসে, মানবিকতা ও বিবেচনাবোধের এক অনুপম সমন্বয় জনাব আবদুল মান্নান। লেখা বেঁচে থাকুক, তাঁর সৃষ্টিশীলতা বেঁচে থাকুক, শিরদাড়া হয়ে থাকুক তাঁর কর্ম-আদর্শ।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা সাংবাদিকতায় একুশে পদক পাওয়া আবুল মোমেনের প্রশংসা করে আজাদ তালুকদার বলেন, এখানে মঞ্চ যারা আলোকিত করে আছেন তাদের মধ্যে আমার অন্যতম শ্রদ্ধাভাজন কবি আবুল মোমেন। তিনি যখন বলেন, বক্তৃতা করেন, তখন আমার মনে হয় আমি প্রার্থনা শুনছি। তাঁর মুখ থেকে আমি বক্তৃতা নয়, শুনতে পাই সুরের ধারা।
অঞ্চলভিত্তিক সাংবাদিকতা করেও আবুল মোমেন সারাদেশে সুস্থ সাংবাদিকতা চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন মন্তব্য করে আজাদ তালুকদার বলেন, ‘চট্টগ্রামে বসে সাংবাদিকতায় তিনি ছিনিয়ে এনেছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি একুশে পদক, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের।’
প্রধান অতিথি দুইবর্ণ’র লেখক আবদুল মান্নানের সঙ্গে ভালোবাসার সুঁতোয় বন্দি হওয়ার গল্পটি টক, ঝাল, মিষ্টিতে ভরা বলেও উল্লেখ করেন আজাদ তালুকদার।
বিভাগীয় কমিশনার যখন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে নতুন দায়িত্ব নেন তখন বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার ধসে পড়ে। সে সময়ের কঠিন পরিস্থিতিতে অত্যন্ত সাহস ও বিচক্ষণতার সঙ্গে আবদুল মান্নানের দায়িত্বপালনের কথা স্মরণ করেন আজাদ তালুকদার।
‘ফ্লাইওভার পুনঃনির্মাণে নিরব ভূমিকা রাখেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবদুল মান্নান। তখন থেকে আমি মানুষটার কাজের প্রতি মুগ্ধ হয়ে পড়ি। ওনার লেখা ছাড়া একুশে পত্রিকা ছাপা হয় না। হয়তো তিনিই আমাকে বন্দি করেন লেখার জন্য, নয়তো আমিই ওনাকে বন্দি করি লেখার জন্য।’ যোগ করেন আজাদ তালুকদার।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে দ্য বেল লেত্-এর লেখক সত্যব্রত বড়ুয়া বলেন, ‘দুইবর্ণ’ বইয়ে আমি দেখেছি বাংলা সাল উল্লেখ আছে। বাংলা তারিখ উল্লেখ করার বিষয়টি আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছে। কারণ আমি নিজেই বাংলা তারিখ উদ্ধার করি, পত্রিকাতে। একজন বাঙালি হয়ে এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু হতে পারে না।
‘দুইবর্ণ বইটি দেখলাম, সেখানে উনিশটি নিবন্ধ দুইবর্ণে গঠিত। এজন্য তিনি বইয়ের নামটা রেখেছেন ‘দুইবর্ণ’।’
এটি একটি ফেসবুকনির্ভর বই মন্তব্য করে সত্যব্রত বড়ুয়া বলেন, ফেসবুকনির্ভর বইয়ের এটি হয়তো প্রথম প্রকাশনা। বাংলাদেশে ফেসবুকনির্ভর বইয়ের পথিকৃত হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। আমিও ফেসবুকনির্ভর বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এসে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলাম।
শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বলেন, ‘দুইবর্ণ’ বইয়ে উনিশটি লেখা দুই বর্ণের, একটি একবর্ণের সেটি- ‘মা’। তিনি এই লেখাগুলোর মধ্যে দিয়ে অনেক কথা বলেছেন।
‘আমি বলবো, এগুলো গল্প না হয়েও এর মধ্যে গল্পের উপাদান আছে। এটি ইতিহাস না হয়েও ইতিহাসের উপাদান আছে। এটি স্মৃতিকথা না হয়েও স্মৃতিকথার উপাদান আছে। এটি দর্শনের বই না হয়েও এতে দর্শনের কথা আছে। এটি কবিতার বই নয়, কিন্তু এতে কাব্যিকতা আছে।’
দৈনিক আমাদের সময়ের উপদেষ্টা সম্পাদক আবুল মোমেন বলেন, ছোট ছোট নানা অভিজ্ঞতা, যা মান্নান সাহেবের জীবনে ঘটেছে, তিনি তা লিখে ফেলেছেন। জীবন সম্পর্কে ভাবনা সেখানে আছে। এই লেখাগুলোর আবেগ আপনাকে ছুঁয়ে যাবে। এটাই হচ্ছে লেখাগুলোর স্বার্থকতা। লেখাগুলো পড়ার পরে আপনাকে স্মৃতিতে ধরে রাখতে সাহায্য করবে।’
কবি আবুল মোমেন বলেন, ‘এই লেখাগুলোতে নানা রেফারেন্স আছে। গল্পের রেফারেন্স আছে, সাহিত্যের রেফারেন্স আছে, সিনেমার রেফারেন্স আছে। এখনকার ছেলে-মেয়েদের আমি দেখছি রেফারেন্সহীন। তারা কোনো রেফারেন্স দিয়ে কথা বলতে পারছে না।’
‘মানুষ এখন ডিগ্রি পাচ্ছে, কিন্তু শিক্ষার মেমোরি নাই। মানুষ কিন্তু বণ্যপ্রাণী থেকে আলাদা সেটা তার মেমোরি আছে বলে, স্মৃতি আছে বলে। তার সংস্কৃতির একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তার অনেক রকম রেফারেন্স তৈরি করা। এই রেফারেন্সগুলো যদি আমি তৈরি না করি, তাহলে আমি সাংস্কৃতিক উদ্বাস্তুতে পরিণত হবো।’ যোগ করেন সাংবাদিকতায় একুশেপদক পাওয়া আবুল মোমেন।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মো. আবদুল মান্নান বলেন, আমার চিন্তা-ভাবনার যে ধারা ছিল সেটি ঘুরিয়ে দিয়েছেন সত্যব্রত বাবু। আবুল মোমেন সাহেব সবসময়ই ভালো বলেন। কারণ বলাটা তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। এই জাতীয় অনুষ্ঠানে, দুই-একটি ভালো কথা শোনার জন্য চট্টগ্রামে যদি কাউকে দাওয়াত করতে হয়, তবে প্রথমেই যার নাম আসে তিনি জনাব আবুল মোমেন।
‘অনুজপ্রতীম আজাদ তালুকদার আমার পক্ষে বললেন, নাকি বিপক্ষে বললেন ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত সে পক্ষেই বলেছে। আজাদ তালুকদারকে আমি ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা জানাই।’
নিজেকে লেখক হিসেবে মনে করেন না জানিয়ে ‘দুইবর্ণ’ বইয়ের লেখক মো. আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমাকে কোনো লেখক বলা যাবে না। সৈয়দ মুজতবা আলী প্রত্যেক ধর্মের প্রবক্তার কসম খেয়ে বলেছেন, আমি জীবনে কোনোদিন লেখক হতে চাইনি।’
‘সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো মানুষ যদি এ কথা বলেন, এখন আপনারা আমাকে লেখক বললে আমি লজ্জিত হবো। আমার মনে হয় এটার দাবিদার আমি এখনো হইনি।’ বলেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার।
অনুষ্ঠানে অতিরক্তি সচিব এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক দীপক চক্রবর্ত্তী, চট্টগ্রাম আর্ট কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ রীতা দত্ত, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন, অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, চট্টগ্রামের পরিচালক ড. সেলভাম থরেজ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) মো. মমিনুর রশিদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. হাবিবুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
একুশে/এসআর/এটি