মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১

অপচিকিৎসার বিরুদ্ধে এক সংগ্রামী মায়ের লড়াই, নাকফুলটিও অবশিষ্ট নেই

প্রকাশিতঃ ৫ জুলাই ২০১৮ | ৮:০২ অপরাহ্ন

চট্টগ্রাম : পায়ুপথে আঁচিল নিয়ে ডাক্তার লিয়াকত আলী খানের পরামর্শে পাইলস চিকিৎসক ডা. সুরমান আলীর শরণাপন্ন হন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমিনুল ইসলাম মিঠু। সুরমান আলী পরামর্শ দেন অস্ত্রোপচারের। বলেন, ‘ওষুধ খেলেই এ রোগ ভালো হয়। তবে ছোট্ট অপারেশন করলে স্থায়ীভাবে ভালো হয়ে যাবে।’

সময়টা ২০১২ সালের ৩০ মে। ডাক্তারের আশ্বাসে চট্টগ্রাম নগরের রয়েল হাসপাতালে ভর্তি হন মিঠু। ডাক্তার প্রথমে বলেছিলেন, ১৫ মিনিটের অপারেশন। অপারেশনের আধঘণ্টা পরেই ঢাকায় ফিরতে পারবে। মমতাময়ী মায়ের প্রশ্ন, আমার ছেলে ব্যথা পাবে না তো! ব্যথা একটু তো পাবেই। ব্যথামুক্ত অপারেশন করতে হলে লংগো অপারেশন করতে হবে। আর সেটা করতে হলে অতিরিক্ত ২০ হাজার টাকা লাগবে। জানান ডাক্তার সুরমান আলী। মা দেলোয়ারা বেগম সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন; বলেন সন্তানের কষ্টের চেয়ে টাকা আমার কাছে বড় নয়, তাই করুন।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক ডিগ্রি পাইলস খাদ্যাভ্যাস বদলিয়ে, মল নরমের ওষুধ ও ডেফলন জাতীয় ওষুধ প্রয়োগে ভালো হয়ে যায়। দুই ডিগ্রি পাইলসে ব্যান্ড লাইগেশন খুবই কার্যকরী অপারেশন। তিন ডিগ্রি ও চার ডিগ্রি পাইলসে পাইলসগুলো বেঁধে কেটে ফেলার অপারেশন, তবে অপারেশনের পর কিছুটা ব্যথা হয়। এক্ষেত্রে ব্যথামুক্ত অথচ ব্যয়বহুল ও কার্যকর অপারেশন হলো লংগো।

বলাবাহুল্য, চার ডিগ্রি পাইলসের কোনো স্তরেরই রোগী নন মিঠু। এ অবস্থায়ই ডা. সুরমান আলী বাড়তি ২০ হাজার টাকা নিয়ে মিঠুকে ব্যথামুক্ত লংগো অপারেশনের (কাঁটাছেঁড়াবিহনী অস্ত্রোপচার) উদ্যোগ নেন। ১৫ মিনিটের অপারেশন ৩ ঘণ্টায় শেষ করেন সুরমান আলী। কাঁটাছেঁড়াবিহীন লংগো অপারেশনের (রাবারযুক্ত পিস্তলের মতো একটি যন্ত্র) কথা থাকলেও তিনি তা ব্যবহার না করে মলদ্বার কেটেই অস্ত্রোপচার করেন। অপারেশনের পর ব্যথায় কাতরাতে থাকেন মিঠু।

সুরমান আলী বললেন, ও কিছু না। দুয়েকদিনের মধ্যে ব্যথা কেটে যাবে। ব্যথার উপশম হয়ই না। বরং দিন দিন বাড়তে থাকে। ভেতরে সুঁই জাতীয় কিছুর অস্তিত্ব টের পান মিঠু। সেই কারণেই তার এত ব্যথা, যন্ত্রণা। অসহ্য যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত শিশুর মতো কাঁদতে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেটি। একদিন বাথরুমে ঢোকে নিজের মাথা নিজেই ফাটিয়ে ফেলেন।

নাড়িছেঁড়া ধনের এই অবস্থা দেখে উন্মাদের মতো হয়ে যান মা দেলোয়ারা বেগম। পুনরায় তিনি ডা. সুরমান আলীর কাছে নিয়ে যান ছেলেকে। সুরমান আলী উল্টো চার্জ করে বসেন মিঠুকে। আপনার ছেলে মিথ্যা বলছে-বলেই চেকআপের জন্য খোলা মিঠুর পরনের প্যান্টটি মার দিকে ছুড়ে মারেন। এভাবে অপমানিত হওয়ার পর কিছু ওষুধ সঙ্গী করে মুমূর্ষু সন্তানকে নিয়ে বাসায় ফিরেন মা। কিন্তু সেই ওষুধে কোনো কাজ হয় না। বরং পাল্লা দিয়ে বাড়ে ব্যথা। আবারো নিয়ে যাওয়া হয় ডা. সুরমান আলীর কাছে। সুরমান আলী সুঁই জাতীয় কিছুর অস্তিত্ব মানতে চান না। সুরমান আলীর লাঞ্ছনা সইতে না পেরে এবার অসুস্থ সন্তানের উপর চড়াও হন মা। ডাক্তারের সামনেই এলোপাথাড়ি থাপড়াতে থাকেন মিঠুকে; ডাক্তার বলছেন কিছুই না, আর তুই বলছিস ব্যথা। এবারও সমাধান ছাড়া বাড়ি ফেরেন মা-ছেলে। কিন্তু তাদের কষ্ট, যন্ত্রণার পাহাড় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হতে থাকে। কোথাও আলো নেই। ব্যথার সঙ্গে এবার যুক্ত হলো নতুন উপসর্গ। পঁচন ধরে মাংসে। মাংস খসে পড়তে থাকে শরীর থেকে।

ভয়ানক এ পরিস্থিতিতে মিঠুর মা এবার যোগাযোগ করেন ডা. সুরমান আলীকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যেই ডাক্তার, সেই লিয়াকত আলী খানের সঙ্গে। তার পরামর্শে ছেলেকে ভর্তি করান রয়েল হসপিটালে। লিয়াকত আলী খান হাসপাতালে ডাকলেন সুরমান আলীকে। সুরমান আলী নিয়ে এলেন ডা. এসএম জাকির হোসেনকে। তিনজন বসে গবেষণা করলেন। তারপর জানালেন- ‘সুঁই নয়, সুতা জাতীয় কিছু রয়ে গেছে, ও তেমন কিছু না।’ এটা চিকিৎসারই অংশ। সিদ্ধান্ত হলো রাতেই ন্যাশনাল হাসপাতালে ফের অস্ত্রোপচার হবে। আর সেটি করবেন ডা. এসএম জাকির হোসেন। রাত ১০ টায় অস্ত্রোপাচার করতে গিয়ে এবার রোগীর মলদ্বারই কেটে ফেললেন।

অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে ডাক্তার জাকির জানান, অপারেশন সাকসেস। কিন্তু দেলোয়ারা বেগম গিয়ে দেখলেন ছেলের আরো করুণ অবস্থা। মাংস খসে পড়ার সঙ্গে পায়ুপথে অনবরত রক্তক্ষরণ। নেতিয়ে পড়লো ছেলে, প্রাণ যায় যায় অবস্থা। দেলোয়ারা বেগম বললেন, যে সুতা বের করার জন্য অপারেশন করলেন সেটা কই? আমাকে দেখান। দেলোয়ারা বেগমকে ডাক্তার জবাব দেন, অপারেশনের স্বার্থে মাংস কাটতে হয়েছে। মাংসগুলো ভরাট হয়ে আসলে দু-তিন মাস পর পুনরায় অপারেশন করে সুতোটা বের করতে হবে।

চিকিৎসকদের অসহযোগিতার মুখে বাসায় নিয়ে আসার পর রোগীর অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকে। অনবরত মল ঝরা ঠেকাতে নিয়মিত পাম্পাস পড়তে হচ্ছে রোগীকে। একপর্যায়ে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। ততক্ষণে রোগীর যা হবার হয়ে গেছে। নানা হাসপাতাল, নানা ডাক্তারের কাছে ঘুরে বেড়ান তারা। কিন্তু কেউ ঝুঁকি নিতে রাজি নন। সবারই এককথা- রোগীকে মৃতপ্রায় বানিয়ে এনেছেন। শেষমেষ কোলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে রেডিওলজিস্ট দেবাশীষ রায় অস্ত্রোপচার করে আমিনুলের শরীর থেকে সুঁই বের করে আনেন। এ অবস্থা দেখে সেখানেই স্ট্রোক করেন আমিনুলের বাবা বাচ্চু। সেই থেকে তিনিও এখন শয্যাশায়ী, মুমূর্ষু দিনাতিপাত করেন।

এদিকে, চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে ৩০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ চেয়ে সংশ্লিষ্ট দুই চিকিৎসক, বিএমএ’র তৎকালীন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বরাবরে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান আমিনুলের মা। তারা দুই লাখ টাকায় তার সঙ্গে দফারফা করতে চান। কিন্তু তাতে তিনি রাজি হননি।

২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ডা. সুরমান আলী ও জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন ভুক্তভোগী দেলোয়ারা বেগম। দুই ডাক্তারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে পাঁচলাইশ থানাকে মামলাটি এএফআইআর হিসেবে গণ্য করতে নির্দেশ দেন আদালত।

ডা. সুরমান আলী ও এসএম জাকির হোসেন হাইকোর্ট থেকে পাওয়া ১০ দিনের অন্তর্বর্তী জামিন শেষে নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে পুনরায় জামিনের আবেদন করেন। আদালত জামিন না মঞ্জুর করে সুরমান আলীকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে সেসময় অবস্থান নেন একদল চিকিৎসক। প্রতিবাদে বিএমএ’র ব্যানারে তারা ৫ দিনের লাগাতর ধর্মঘট কর্মসূচি পালন করেন। বিএমএ নেতা ডা. ফয়সাল ইকবাল আদালতে মুচলেকা দিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন।

এদিকে, দুই ডাক্তারের বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ আদালতে চার্জশিট দিলে বিএমএ’র পক্ষ থেকে মামলার বাদি দেলোয়ারা বেগমের সঙ্গে ৬ লাখ টাকার বিনিময়ে সমঝোতার চেষ্টা করেন ডা. সুরমান ও জাকির হোসেনের লোকজন। এ প্রসঙ্গে দেলোয়ারা বেগম বৃহস্পতিবার বিকেলে একুশে পত্রিকাকে জানান, একপর্যায়ে সমঝোতার কথা বলে বিএমএ ভবনে আমাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। দুঃসময়ে সবসময় আমার পরিবারের পাশে থাকা একাত্তর টিভির তৎকালীন সিনিয়র রিপোর্টার আজাদ তালুকদার ও এনটিভির আরিচ আহমেদ শাহকে অনুরোধ করে এসময় সমঝোতা মিটিংয়ে নিয়ে যাই। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন ডা. ফয়সাল ইকবাল। ডা. ফয়সাল আমাকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেন। আমি তাতে অপারগতা প্রকাশ করলে ফয়সাল নিজেকে তিনটি হত্যা মামলার আসামি দাবি করে মামলা তুলে না নেয়ার পরিণতি খুব খারাপ হবে বলে শাসিয়ে দেন। পরে এই দুই সাংবাদিকের প্রতিবাদের মুখে তিনি অবশ্য কিছুটা নমনীয় হন। ডা. ফয়সালের যে রূপ সেদিন দেখেছি, সাংবাদিকরা সাথে না থাকলে তিনি মনে হয় সেদিন আমাকে মেরেই ফেলতেন। বলেন দেলোয়ারা বেগম।

দেলোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমার সন্তানের সুস্থতার জন্য ৫০ বারের বেশি ভারত যেতে হয়েছে। অপারেশনই করেছি কেবল ১১ বার। সঙ্গে স্ট্রোক আক্রান্ত স্বামীর ব্যয়বহুল চিকিৎসা। সব বিক্রি ও ধারদেনা করে সর্বশান্ত হয়েছি। জীবনে কল্পনা করিনি এমন মানুষের কাছ থেকেও টাকা ধার নিতে হয়েছে। একবার নিলে লজ্জায় দ্বিতীয়বার তার কাছে যেতে পারিনি। ফলে কাজীর দেউড়ির দুই গণ্ডা জমি বিক্রি করে দিয়েছি মাত্র ২৩ লাখ টাকায়। জায়গার ক্রেতা সেই ২৩ লাখ টাকা আমাকে শোধ করেছেন ৫ হাজার, ১০ হাজার টাকা করে। দেড় লাখ টাকার গলার হার বিক্রি করে করেছি মাত্র ৫ হাজার টাকায়। বিক্রি করেছি বাসার হাড়িপাতিল পর্যন্ত।
চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে এমনও দিন গেছে ভারতে অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেছি। বহুসময় ছেলের মুখে খাবার তুলে দিতে পারিনি। না খেতে পেরে আমার ছেলে বমি করেছে অসংখ্যবার। নাকফুল বিক্রি করে পর্যন্ত ভারতে হোটেলভাড়া মিটিয়েছি। এসব পরিস্থিতি ফ্যাল ফ্যাল করে দেখেছি, নিরবে চোখের পানি ঝরিয়েছি। আর বলেছি, আল্লাহ তুমি যদি থেকে থাকো তাহলে যারা আমার সাজানো পরিবারের এ অবস্থা করেছে, তাদের বিচার করো।’

দেলোয়ারা বেগম জানান, একদিকে নিয়মিত চিকিৎসা, অন্যদিকে মামলাব্যয়-দুদিক সামলাতে গিয়ে রীতিমতো হাফিয়ে উঠি। এই ডাক্তার, এই আদালত এভাবে বছরের পর বছর কেটেছে আমার। কত শত দিন আদালতের বারান্দায় পড়েছিলাম তার কোনো হিসাব নেই। আমার হারাবার কিছু নেই। তাই লক্ষ্য ছিলো একটাই- আমার মামলার মধ্যদিয়ে দোষী ডাক্তারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। কিন্তু চার্জ গঠনের দিন আকস্মিক মামলাটি খারিজ করে দেন সিএমএম আদালত। জজকোর্টের দ্বারস্থ হলে সেখানেও নিম্ন আদালতের আদেশ বহাল থাকে।

২০১৬ সালের মাঝামাঝিতে এ আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে ঢাকায় পড়েছিলাম দুইবছর। পড়ে থাকার ফল আমি পেয়েছি। বিচারপতি আব্দুল হাকিম ও এসএম মুজিবুর রহমানের দ্বৈত বেঞ্চ সম্প্রতি মামলাটির অভিযোগ গঠনের জন্য নিম্ন আদালতকে নির্দেশ দিয়েছেন। ডা. সুরমান আলী ও জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে মামলাটি চলতে আর কোনো বাধা নেই। সারাজীবনের শক্তি-অর্থ, সঞ্চয় শেষ করে দিয়েছি। এখনো প্রতিদিন দেনার গ্লানি টানতে হয়। তাই আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। দুই ডাক্তারের শাস্তি দেখে মরতে পারলে আমার আত্মা শান্তি পাবে। বলেন দেলোয়ারা বেগম।

এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য ডা. সুরমান আলী, এসএম জাকির হোসেন কাউকেই ফোনো পাওয়া যায়নি।

একুশে/এটি