আজাদ তালুকদার, মদিনা থেকে : আপনি ইঞ্জিন বন্ধ করে গাড়িতে বসে আছেন, তারপরও চলছে গাড়ি। চলাটাও স্বাভাবিক নয়, একেবারে উল্টোভাবে! শুধু চলছে বললে ভুল হবে, ধীরে ধীরে গাড়ির গতি বাড়ছে, এখন আপনার কাজ শুধু স্টিয়ারিং ধরে গাড়ির দিকটি ঠিক রাখা। বিষয়টি অলৌকিক মনে হলেও এমনই ঘটনা ঘটে মদিনার রহস্যময় জ্বিনের পাহাড়ের পথে।
সাধারণ মানুষের কাছে এটা জ্বিনের পাহাড় নামে পরিচিত। আরবরা অবশ্য এই পাহাড়কে জ্বিনের পাহাড় বলতে চান না। তাদের কাছে এই পাহাড়ের নাম ওয়াদি আল আবইয়াজ বা ওয়াদি আল বায়জা।
কথিত ওয়াদি আল আবইয়াজ বা জ্বিনের পাহাড়ের অবস্থান মদিনা শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। মদিনা থেকে বের হয়ে কিছু খেঁজুর বাগান পার হয়ে যেতে হয় এলাকাটিতে। খেঁজুর বাগানের পর পাহাড়ি পথ। এই এলাকার পাহাড়গুলোও ব্যতিক্রম। ন্যাড়া পাহাড়, পাহাড়ের ওপর ধারালো সূচের ন্যায় ফলা ফলা মাটি দাঁড়িয়ে আছে। দেখলে মনে হবে, এই তো ভেঙে পড়বে। এমন পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে পিচঢালা সড়ক। আর সেই সড়কেই লুকিয়ে আছে এমন অপার বিস্ময়।
মক্কা থেকে মদিনা আসার পরদিনই সেই বিস্ময়ের খোঁজে ছুটছি আমরা। পরিবারের পাশাপাশি সংগী সৌদি আরবের আবহা প্রদেশে বসবাসকারি সুজন-শুভার্থী জামাল। একশ’ রিয়ালে ভাড়ায় নিয়েছি কার। তিন ঘণ্টায় জ্বিনের পাহাড়, মসজিদে কেবলা তাইন, কুবা মসজিদ, সাবা মসজিদ, ওহুদের পাহাড় দেখব বলে। গাড়ির চালক আনোয়ার; বাড়ি কুমিল্লায়। ফলে বাড়তি সুবিধা। তিনি আমাদের জ্বিনের কারসাজির বিবরণ দিয়ে যাচ্ছেন একে একে।
যেখানে ইঞ্জিন বন্ধ থাকলেও গাড়ি চলে ঢালুর বিপরীতে। শুধু গাড়ি চলা নয়, পানির বোতল কিংবা পানি ফেললে, জুতা রেখে দিলে তাও ঢালুর বিপরীত দিকে গড়াতে থাকে। তবে যাওয়ার সময় নয়, এমন বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে আসার সময়। সেই এডভেঞ্চারাস ঘটনার ক্রমেই ব্যাকুল হচ্ছি আমরা!
জ্বিনের পাহাড় এলাকার রাস্তা খুব উঁচু নয়, তারপরও শো শো আওয়াজে কান বন্ধ হয়ে যায়, পাহাড়ের ঢালে নেমে দাঁড়ালে মনে হয়, কেউ যেন পেছন থেকে আলতো করে ধাক্কা দিচ্ছে; দুলুনি ভাব!
পরতে পরতে এমনই এডভেঞ্চার উপভোগ করে আমরা এবার চূড়ান্ত বিস্ময়ের সংগী হতে চলেছি। পাহাড়ি ঢালুর উল্টো পথে ফিরছি মদিনার দিকে। পাহাড়ের নিচে গোল চত্বরটা টার্ন নিয়েই আনোয়ার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিলেন। নিউট্রলে স্টিয়ারিং। পা দুটি উপরের দিকে তুলে আয়েশি ভংগিমায় বসে আছেন তিনি। কী আশ্চর্য, তাতেই চলছে গাড়ি! গাড়ির গতি বাড়ছে ধীরে ধীরে। এক পর্যায়ে গাড়ির গতি গিয়ে থামলো ১২০ এ। এভাবেই বন্ধ একটি যান চললো প্রায় ৮ কিলোমিটার। আনোয়ার বললেন এটা জ্বিনের শাসন। এই শাসন আপনাকে মানতেই হবে!
কিন্তু আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। এ কী করে সম্ভব! এর আসল কারণ কী? এসব উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানলাম নানা কথা, নানা কিংবদন্তি।
কেউ কেউ ধারণা করেন, জায়গাটিতে প্রচুর চুম্বকজাতীয় পদার্থ আছে তাই এমনটি হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো- পানি, পানির বোতল বা জুতায় চুম্বক কীভাবে আকর্ষণ করে?
স্থানীয়দের কাছে এসব বিষয়ের কোনো সমাধান নেই। ফলে প্রচুর কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে এ নিয়ে।
আহমদ আল সোলাইমান নামে এক সৌদি চালক জানালেন, ‘এখানে কোনো জ্বিন-টিন নেই, এটা ‘আরদে মুকাদ্দাস’ বা পবিত্র মাটি। এই পাহাড়ের ওপর দিয়ে প্লেনও যেতে পারে না। এই পাহাড়ে উঠে নবী করিম (সা.) জিনদের ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন। তখন নাকি কিছু জ্বিন দুষ্টুমি করে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। পরে বয়স্করা তাদের পালানো রোধ করতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয় তাদের পথ উল্টে দিয়ে। তাই এখানে সবকিছু উল্টো চলে।’
যদিও ইসলামের ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনার প্রমাণ মেলে না। নবী করিম (সা.) জ্বিনদের ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন মক্কায়। এটা হাদিসে বর্ণিত। কিন্তু মদিনায় জ্বিনদের সঙ্গে এমন কোনো ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায় না।
জানা যায়, ২০০৯-২০১০ সালের দিকে সৌদি সরকার এই পাহাড় ঘেঁষে তাবুকের দিকে একটি রাস্তা বানানোর পরিকল্পনা করে। কিন্তু ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত কাজ করার পর সমস্যা শুরু হয়। হঠাৎ দেখা যায় রাস্তা নির্মাণের যন্ত্রপাতি আস্তে আস্তে মদিনা শহরের দিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যাচ্ছে। যেনো অদৃশ্য কোনো শক্তি যন্ত্রপাতিগুলো মদিনার দিকে ঠেলছে। এসব দেখে ভীতসন্ত্রস্ত নির্মাণ শ্রমিকরা পালিয়ে যান। ফলে রাস্তার নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। যেখানে রাস্তার কাজ বন্ধ করা হয় সেখানে চারদিকে বিশাল খাড়া কালো পাহাড়। ওই পাহাড়ের পাদদেশে গোল চত্বরের মতো করে আবার সেই রাস্তা দিয়েই মদিনায় আসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রহস্যময় পর্বতটি জ্বিনের পাহাড়, যাদুর পাহাড় কিংবা চুম্বকের পাহাড়- যে নামেই পরিচিত হোক না কেন এটি পৃথিবীর অবাক এক বিস্ময়ের নাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, জ্বিনের পাহাড় সম্পর্কে সঠিক কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বহু ভূতত্ত্ববিদ জায়গাটির প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে বিশ্বাসযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তবে দায়সারা একটা তথ্য বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা গেছে।
ভূতত্ত্ববিদেরা বলেছেন, পাহাড়ে ঘেরা এই জায়গার ভূগর্ভে অনেক খনিজসম্পদ রয়েছে, ফলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির তীব্র প্রভাব রয়েছে এবং ‘ম্যাগনেটিক পাওয়ার’ বা ‘চুম্বক শক্তি’ সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে গাড়ি আপনা থেকেই ছুটে চলে। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ‘ম্যাগনেটিক ল্যান্ড’।
একুশে/এটি/এসআর