.চট্টগ্রাম : ২০১৫ সালের ২১ নভেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি হওয়ার পর গহিরার পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। এরমধ্যে পার হয়ে গেছে আড়াই বছর। দীর্ঘ এ সময়ে দলীয় নেতাকর্মী, শুভানুধ্যায়ী, অনুসারী তো নয়ই; পরিবারের সদস্যরাও আসেননি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কবরে।
সম্প্রতি একুশে পত্রিকাকে এই তথ্য জানিয়ে ইসমাইল নামের এক প্রতিবেশি জানান, শুরুর দিকে পরিবারের সদস্যরা এসে মৃতের জন্য টুকটাক অানুষ্ঠানিকতা পালন করলেও দুই বছরের বেশি সময় ধরে তারা আর কেউ বাড়িঘরে আসেননি, আসেননি কবর জেয়ারতেও।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিশালাকারের একটি পুকুরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী চৌধুরী বাড়ির চারপাশের পরিবেশ, বসতি। পুকুরের পশ্চিম পাশে ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তা খান বাহাদুর আবদুল জব্বার চৌধুরীর বৈঠকখানা, প্রাচীন জমিদার বাড়ি। দক্ষিণপ্রান্তে মসজিদের কাছে চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর পৈত্রিক বাড়ি।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর রেলকর্মকর্তা বাবা হোসেন আহমেদ চৌধুরী আর খান বাহাদুর আবদুল জব্বার চৌধুরী চাচাত-জেঠাত ভাই। পুরোনো জমিদার বক্স আলী চৌধুরীর বংশধর এঁরা। বক্স আলী চৌধুরীর দ্বিতীয় প্রজন্মে দুই ভাইয়ের একজন ইকবাল আলী। তাঁর সন্তান ব্রিটিশ শাসনামলে খান বাহাদুর উপাধি পাওয়া পুলিশ অফিসার আবদুল জব্বার। তার চার ছেলে ফজলুল কবির চৌধুরী, ফজলুল কাদের চৌধুরী, ফজলুল রহিম চৌধুরী, ফজলুল সোবহান চৌধুরী।
এঁদের মধ্যে বড়জন ফজলুল কবির চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধী দলীয় নেতা আর মেঝ ছেলে ফজলুল কাদের চৌধুরী দেশ স্বাধীনের আগে পাকিস্তানের স্পীকার ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন। পরবর্তীতে ফজলুল কবির চৌধুরীর সন্তান এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী, ফজলুল কাদের চৌধুরীর দুই সন্তান সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী পারিবারিক রাজনীতির হাল ধরেন।
জানা যায়, বক্সআলী চৌধুরীর তৃতীয় প্রজন্ম ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তা খান বাহাদুর আব্দুল জব্বারের নির্মিত শানবাধানো বৈঠকখানায় রাজনীতি করেছেন ফজলুল কবির চৌধুরী আর ফজলুল কাদের চৌধুরী।
.এই বৈঠকখানার রাজনীতিই এ দুইজনকে দুই ধারার রাজনীতির প্রাদপ্রদীপে নিয়ে এসেছিলো তৎসময়ে। তাদের পথ ধরে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী রাজনীতির জন্য এ বৈঠকখানা কাজে লাগান। ১৯৯৬ সালে জেঠাত ভাই এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী আকস্মিক নৌকা প্রতীকে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে আসা সাকা-গিকা ভ্রাতৃদ্বয় পুকুরের পশ্চিম প্রান্তে বাড়ি নির্মাণ করে প্রাচীন এ বৈঠকখানা থেকে আলাদা হয়ে যান। পাকিস্তানি ভাবধারায় করা এ বাড়ির নামকরণ করেন ‘বাইতুল বিলাল’।
এরপর রাজনীতির নানা ব্যঞ্জনা আর বাঁকময়তার সাক্ষী ঐতিহ্যবাহী এ বৈঠকখানাতে ফজলে করিম চৌধুরীর রাজনীতির শুভ সুচনা হয়। গত ২২ বছর ধরে তিনি পরিবর্তিত, আধুনিক, সমৃদ্ধশালী রাউজান গঠনে ভূমিকা রাখছেন এখানে বসেই। এ বৈঠকখানার ম্যাকানিজমে এমপি হয়েছেন পরপর তিনবার।
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি) ছেড়ে ১৯৯৬ সালে ধানের শীষ প্রতীকে গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রথমবারের মতো এমপি হলেও সেসময় ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। অল্পভোটে পরাজিত হলেও রাউজানে তখন থেকে সরকারি উন্নয়ন-কর্মকাণ্ডের সমন্বয় করেন আ.লীগের এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী।
রাজনৈতিক মেরুকরণে ১৯৯৬ সাল থেকে সাকা চৌধুরী চলে যান পাশ্ববর্তী রাঙ্গুনিয়া আসনে। ফলে ‘৯৬ থেকে একক, অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতার মালিক হয়ে উঠেন ফজলে করিম চৌধুরী। পক্ষান্তরে ক্রমশ কোণঠাসা ও খর্ব হতে থাকে সাকা-গিকা চৌধুরীর প্রভাব-প্রতিপত্তি। মূলত ২০০৮ সালের নির্বাচনে জেঠাতভাই ফজলে করিম চৌধুরীর কাছে দ্বিতীয়বার পরাজিত হয়েই বাড়িবিমুখ হতে থাকেন সাকা-গিকা।
পরবর্তীতে সাকার গ্রেফতার, যুদ্ধাপরাধের বিচারকার্যক্রম শুরু হলে বাড়িঘরে আসা-যাওয়া অনেকটা কমিয়ে দেন তারা। মাঝখানে উত্তাল, বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি পাড়ি দিয়ে সাকা চৌধুরীর লাশটা কেবল দাফন করতে গিয়েছিলেন পরিবারের সদস্যরা। এরপর মৃত ব্যক্তির আনুষ্ঠানিকতার স্বার্থে দু-একবার আসা-যাওয়া করলেও এরমধ্যে আর কেউ বাড়ি যাননি। ফলে পাকিস্তানের চাঁদতারাখচিত বিশাল এই বাড়িটি মানুষশূন্যতায় খা খা করছে।
জানা যায়, নির্বাচন, অনুষ্ঠান, ঈদ-পার্বণ উপলক্ষে সাকা চৌধুরীসহ ৪ ভাই গ্রামে এলে ‘৯৬ সালে নির্মিত এ বাড়িতেই থাকতেন। কয়েকবছর আগে প্রয়াত সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবার বাড়ির উত্তরপ্রান্তে নতুন বাড়ি করেছেন। বর্তমানে দুই বাড়িই ফাঁকা। দরজা ও গেটে বড় বড় তালা ঝুলছে। গেইটের কাছে কেয়ারটেকারদের থাকার ঘর। ম্যানেজার কামালসহ চারজন কেয়ারটেকার বাড়িটি পাহারা দেন।
কামাল জানান, সাহেবদের বউ-ছেলে-মেয়ে কেউ আসেন না। গত দুইবছরে কবর জেয়ারত করতেও কেউ আসেননি। একসময় ঈদ করতে আসলেও গত ৫-৬ বছর ধরে তাও আসেন না।
আসেন না কেন জানতে চাইলে, কিছুক্ষণ চুপ থাকেন কামাল। তারপর বলেন, আসেন না কেন সাহেবরাই ভালো বলতে পারবেন। এসময় বাজারের থলে হাতে পাশ দিয়ে যাওয়া সাকা চৌধুরীর দূরসম্পর্কের এক চাচাত ভাই প্রতিবেদককে দেখে দাঁড়িয়ে যান। প্রশ্নের উত্তরটি তিনিই দিলেন। তার দাবি- সাকা চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা একধরনের ভীতির কারণে কবর জেয়ারতে বাড়ি আসেন না।
তিনি বলেন, ক্ষেত্রবিশেষে রাজনীতি অনেক খারাপ ‘জিনিস’। একসময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী-ফজলে করিম চৌধুরীরা এক পরিবারের মতো ছিলেন। ফজলে করিম চৌধুরী তাদের বিপরীত মেরুর রাজনীতিতে আসার পর তাদের মধ্যে দূরত্ব, বিভক্তি তৈরি হয়। এ দূরত্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, তাদের মধ্যে মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত হয় না অনেকবছর। তারা একে অপরকে আস্থায় রাখতে পারেন না। ভ্রাতৃপ্রতীম, রক্তের সম্পর্ক গিয়ে ঠেকেছে চরম উৎকণ্ঠায়।
একুশে/এটি