চট্টগ্রাম: ‘আমি কী বলব? আমার দুই ভাইয়ের চোখে খেজুর কাঁটা দিয়ে কি কেউ খুঁচিয়েছিল? আমার তো মনে হয়, খেজুর কাঁটা কেন, এসিডই কেউ মারেনি’, কথাগুলো এসিডদগ্ধ ভুক্তভোগী কবির ও ছবুরের ভাই ফরিদুল আলমের।
তিনি বলেন, ‘আমার দুই ভাইয়ের চোখে এসিড ঢেলে খেজুর কাঁটা দিয়ে নৃশংস নির্যাতন চালানো হয়েছিল। আইয়ুব আর ইব্রাহিম এসিড ঢেলেছে, চোখে খেজুর কাঁটা দিয়েছে দুই হাশেম। জজকোর্টে দুই হাশেম খালাস পেয়েছে। তাহলে আমার ভাইদের চোখে খেজুর কাঁটা গেঁথে দিল কে?
১৯৯১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সোবহানের দুই সন্তান কবির আহমদ ও সবুর আহমদের উপর চোখে খেজুর কাটা ও এসিড ঢেলে নৃশংস নির্যাতন চালায় রাঙ্গুনিয়ায় দুর্ধর্ষ আইয়ুব বাহিনী; এই বাহিনীর প্রধান আইয়ুব যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদেরের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত।
বিচার চেয়ে মামলা করায় ওই বছরের ৩০ অক্টোবর যাত্রীবাহী জীপ গাড়ী থেকে মুক্তিযোদ্ধা সোবহানকে ধরে নিয়ে যায় আইয়ুব বাহিনী। ১২ দিন পর দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হাত পা গলা কাটা অবস্থায় লাশ পাওয়া যায় মুক্তিযোদ্ধা সোবহানের। মুক্তিযোদ্ধা সোবহান খুনের মামলায় ২১জন আসামীর মধ্যে সন্ত্রাসী আইয়ুবসহ ১৭জনের যাবজ্জীন সাজা হয়। তবে সোবহানের দু’সন্তানের চোখ উৎপাটন করে এসিড দেওয়ার মামলা দুই যুগের বেশী সময় ধরে ঝুলে ছিল।
এ ঘটনায় আইয়ুব বাহিনীর আইয়ুবসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে ১৯৯৩ সালের ১৬ আগস্ট বিচার শুরু করে আদালত। ২৭ বছর পর বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ স্বপন কুমার সরকার এ মামলার রায় ঘোষণা করেছেন।
মামলায় অভিযুক্ত ১৩ আসামির মধ্যে রাঙ্গুনিয়ার আইয়ুব বাহিনীর প্রধান আইয়ুব এবং উপজেলার পারুয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. ইব্রাহিমকে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদন্ড ও ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড প্রদান করা হয়।
এ রায়ে ৭ বছর করে দণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামিরা হলেন- সোলায়মান, আবদুল হক, ইউসুফ, জাফর, দুলা মিয়া ও গোলাম কাদের। তাদের প্রত্যেককে ৫ হাজার টাকা করে অর্থদন্ড প্রদান করা হয়। এ মামলায় অভিযোগ প্রমানিত না হওয়ায় চারজনকে খালাস দেয়া হয়। এরা হলেন- আবদুস সালাম, আবুল হাশেম, জাহাঙ্গীর আলম ও আবুল হাশেম। এ ছাড়া এ মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিসহ তিনজন দুলা মিয়া, গোলাম কাদের ও রশিদ আহমদ মারা গেছেন।
এদিকে রায় ঘোষণার সময় আদালতে এসিড সন্ত্রাসের শিকার ছবুর আহমেদসহ তার পরিবারের স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন। রায় শোনার পর ছবুর আহমেদ ও তার স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। মামলার রায়ে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন দাবি করে এসিড সন্ত্রাসের শিকার ছবুর আহমেদ বলেন, ‘আমার দুই চোখ খুঁচিয়ে এসিড ঢেলে দেয়ার ২৭ বছর যন্ত্রণা নিয়ে কাটিয়েছি প্রতিটি মূহুর্ত। আশা করেছিলাম আদালত আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেবে।’
মামলার বাদী ফরিদুল আলম বলেন, ‘আসামিরা এক সপ্তাহ আগে বলেছিল, আমরা মামলা থেকে খালাস পাচ্ছি। চারটি চোখ ও একটি জীবন হারানোর পর যদি ১০ বছর সাজা দেয়, আমরা কিভাবে সন্তুষ্ট হবো। আমরা তো শুধু সংক্ষুব্ধ নই, বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি এখন। প্রধান আসামি আইয়ুব আজকে আদালতে প্রবেশের আগে টিভি ক্যামেরার সামনে ভি চিহ্ন দেখিয়েছে।’
মামলার রাজসাক্ষী মো. ইকবাল বলেন, ‘খুলশী এলাকার ব্যবসায়ী ও বিএনপি নেতা নাজিম উদ্দিন মাইকেল চারদিন আগে আমাকে বলেছিল, প্রধান আসামি আইয়ুবের ১০ বছর সাজা হবে। তখন আমি বলেছিলাম, তার যাবজ্জীবন নয়তো ফাঁসি হবে। রায় নিয়ে আমরা বাজি ধরেছিলাম। রায় ঘোষণার পর হেরে গিয়ে, তাকে অভিনন্দন জানিয়েছি।’
‘পরে আমি মাইকেলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে কী গায়েবী শক্তি পেয়েছে কি না যে আগাম রায় জানতে পারছে। ১০ বছর সাজার বিষয়টি সম্পর্কে সে তখন জানালো, আইয়ুবের আইনজীবী জামালের কাছ থেকে সে জেনেছে।’ যোগ করেন ইকবাল।
এ বিষয়ে জানতে নাজিম উদ্দিন মাইকেলের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রথমবার তিনি ধরেননি। এরপর থেকে নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী লোকমান হোসেন বলেন, ‘আমরা আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড আশা করেছিলাম। রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর উচ্চ আদালতে আপিল করবো।’
এসআর/একুশে