শরীফুল রুকন : পুলিশের বিশেষ ব্যাংক ‘কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ’-এর লভ্যাংশ পুলিশ-কল্যাণ ট্রাস্টে যাওয়ার খবরে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে।
আগামী কয়েক মাসের মধ্যে চালু হতে যাওয়া কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ-এর মূলধন জোগাড়ের জন্য ২৭ হাজার টাকা করে দিয়ে ‘শেয়ার’ কিনেছেন এক লাখ ৬৬ হাজার পুলিশ সদস্য। এরইমধ্যে ৪৩০ কোটি টাকার বেশি মূলধন সংগ্রহ করা হয়ে গেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তাদের বরাতে সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে- কমিউনিটি ব্যাংকের লভ্যাংশ কল্যাণ ট্রাস্টে দেয়া হবে। এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতাকারি পুলিশ সদস্যদের অভিযোগ, কনস্টেবল থেকে এসআই পদের কর্মকর্তারা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে তেমন উপকৃত হন না। অথচ পুলিশে সংখ্যার দিক থেকে তারাই সিংহভাগ। তাই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে চাইলে ব্যাংকের লভ্যাংশ শুধুমাত্র ‘শেয়ার হোল্ডারদের’ হিসাবে জমা হওয়া উচিত।
পুলিশ সদস্যরা বলছেন, ব্যাংকের লভ্যাংশ কল্যাণ ট্রাস্টে দেয়া কোনোভাবেই ঠিক হবে না। কল্যাণ ট্রাস্টে যদি লভ্যাংশ যায়, তাহলে ‘শেয়ার হোল্ডাররা’ অবসরে গেলে সেখান থেকে কোনো সুবিধা পাবেন না। তাছাড়া কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পান সহকারি পুলিশ সুপার থেকে উপরের কর্মকর্তারা।
ফেসবুকে BPKT Bank নামের একটি ফেসবুক পেইজে এ নিয়ে সরব হয়েছেন মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা। ব্যাংকের ‘শেয়ার হোল্ডার’ হিসেবে বছর শেষে লভ্যাংশ পেতে চান তারা। সেখানে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখানো পুলিশ সদস্যদের মধ্যে কনস্টেবল থেকে এসআই পদবীর কর্মকর্তারা আছেন। তাদের প্রায় সবারই এক প্রশ্ন- ব্যাংকের লভ্যাংশ কেন পুলিশ-কল্যাণ ট্রাস্টে যাবে?
প্রথমদিকে পুলিশের বিশেষ ব্যাংকটির নাম ঠিক করা হয়েছিল- বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট ব্যাংক। এখন বলা হচ্ছে- ব্যাংকের নাম হবে কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ। ব্যাংকের মূলধন জমাতে সবার কাছ থেকে টাকা নেওয়া হলেও নাম ঠিক করার ক্ষেত্রে সবার মতামত নেওয়া হয়নি। এ ধরনের নানা প্রসঙ্গ তুলে পুলিশের কেউ কেউ কমিউনিটি ব্যাংকের সুফল পাওয়া নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন।
ফেসবুকে BPKT Bank নামের পেইজটিতে মো. আলমগীর নামের একজন পুলিশ সদস্য লিখেছেন, ‘আমার কষ্টের ২৭ হাজার টাকায় শেয়ার হোল্ডার হিসাবে লাভ যতটুকুই প্রাপ্য হই দয়া করে আমার একাউন্টে দিয়ে দিবেন। কৈ এর তৈল দিয়ে কৈ ভাজা বন্ধ করেন। অন্যথায় খোদার গজব পড়বে!’
রফিকুল ইসলাম নামের একজন এসআই লিখেছেন, ‘…লিমিটেড কোম্পানির লভ্যাংশ, কোম্পানি আইন অনুযায়ী লভ্যাংশ শেয়ার হোল্ডারগণের প্রাপ্য। সুতরাং শেয়ার অনুপাতে লভ্যাংশ বণ্টন হওয়া উচিত।’
ফেসবুকে মো. মিজানুর রহমান নামের একজন লিখেছেন, ‘আমি চেয়েছিলাম যে অবসরে গিয়ে এই ব্যাংকে টাকাটা রেখে দিবো। কিন্ত এখনতো চিন্তায় আছি যে আমার টাকাটা কখন যে আবার কল্যাণ-এ জমা হয়ে যায়…।’
জিল্লুর রহমান নামের একজন এএসআই লিখেছেন, ‘চাকুরি করি। কল্যাণ পাবো। চিকিৎসা পাবো। চাকুরিতে ঝুঁকি অাছে, ঝুঁকিভাতা পাবো। অন-ডিউটিতে অাহত নিহত হলে মানবিক কারণে অার্থিক সহযোগিতা পাবো। এগুলো বাহিনীর বিধান ও অাইন। কিন্তু বেতনের টাকায় বিনিয়োগ করে তার লভ্যাংশ কল্যাণ ট্রাস্টে যোগ হবে এটা হতে পারে না। তাছাড়া বাহিনীতে তো অালাদা কল্যাণ ফান্ড অাছে।…’
মো. টুটুল সিকদার লিখেছেন, ‘কাগজে লেখা ছিল, লাভ হলে সকল শেয়ার হোল্ডার পুলিশদের দিয়ে দেওয়া হবে। এখন টাকা কাটার পর অন্য সুর কেন?’
মো. শফি লিখেছেন, ‘…গল্পটা কি ‘নীলকর’ এর গল্পের মত হয়ে যাচ্ছে? আপনার আমার রক্তচোষা টাকা নিয়ে এখন নতুন গল্প বানানো হচ্ছে। এমন অনেক পুলিশ সদস্য আছে যারা অনেক কষ্টে সংসার খরচ বাঁচিয়ে ভবিষ্যতের একটু লাভ, একটু সুখের আশায় টাকা দিয়েছিল। এখন যদি ভিন্ন কথা বলা হয় তাহলে কেউ মেনে নেবে না। সেই মাদক বিষয়ক টাকার মত সবার টাকা ফেরতের আওয়াজ উঠবে। যারা ব্যাংকের মুলধন দিয়েছে তারাই লভ্যাংশ পাবে- এটাই যৌক্তিক এবং বাস্তবতা।’
‘পুলিশ-কল্যাণ ট্রাস্ট/মৃত্যুকালীন পুলিশ-কল্যাণ ট্রাস্ট/পুলিশ পরিবার নিরাপত্তা তহবিলে প্রতি বছর দুই বার করে ছয় বার টাকা কাটা হয়। এরপরও আমাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাস শেষে প্রাপ্ত বেতন থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে কেটে নিয়ে লভ্যাংশ কল্যাণ ফান্ডে যাবে এটা কেমন হয়ে গেলো না? তাহলে কল্যাণ ফান্ডের টাকা দিয়ে ব্যাংক করলেই হতো। আমার বিশ্বাস আইজিপি মহোদয়, এর একটা সঠিক সমাধান নিশ্চয়ই দিবেন।’ – BPKT Bank নামের পেইজটিতে মো. মাসুদ রানা লিখেছেন।
মো. শফি লিখেছেন, ‘পলওয়েল মার্কেটের শেয়ার হোল্ডারদের লভ্যাংশ তো পুলিশ কল্যাণে জমা হয় না, তাহলে ব্যাংকের টাকা কেন কল্যাণে জমা হবে।…’ একই বিষয়ে আরেকজন লিখেছেন, ‘ঢাকার পলওয়েল মার্কেটের যারা শেয়ার হোল্ডার আছে, লভ্যাংশটা শুধু তারাই নেয়। তাহলে আমাদের টাকায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে তার লভ্যাংশ শেয়ার হোল্ডার ছাড়া অন্য কাউকে দেওয়ার যৌক্তিকতা কতটুকু?’
মোস্তফা হারুন নামের একজন এসআই লিখেছেন, ‘প্রথম যখন এই ব্যাংকের মূলধন কালেকশনের জন্য প্রতিটি ইউনিটে পত্র প্রেরণ করা হয়েছিল, সেই পত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল, ব্যাংক প্রতি বছর শেয়ার হোল্ডারদের মাঝে ২০% থেকে ২৫% লভ্যাংশ প্রদান করবে যা ৩০% পর্যন্তও হতে পারে। হঠাৎ করে লভ্যাংশ কল্যাণ ট্রাস্টে দেয়ার ঘোষণা দেয়ায় আমি ব্যথিত হয়েছি। আমার মনে হয় পুলিশের সকল সদস্যই এমন সিদ্ধান্তে হতবাক হয়ে গেছে। কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি নিয়ে আবার বিবেচনার জন্য অনুরোধ করছি। তাছাড়াও বর্তমান সিদ্ধান্তে কোনো স্পষ্টতা দেখতে পাচ্ছি না।
তিনি আরও লিখেছেন, ‘মুলধন প্রদানকারী পুলিশ সদস্যের পরিবারকে অবসরের পরেও কি চিকিৎসাসহ আমৃত্য সুবিধা প্রদান করা হবে, নাকি অবসরে গেলে সে আর কোনো সুযোগ সুবিধা পাবে না, তা ক্লিয়ার করা হয়নি। সব মিলিয়েই মূলধন প্রদানকারী সদস্যদের মতামত নিয়েই নীতিমালা গঠন করা উচিত হবে। একক সিদ্ধান্ত সবার ঘাড়ে চাপিয়ে না দেয়াই উত্তম। এই ঘোষণায় আমার মত অনেক পুলিশ সদস্যই হতাশ। পলওয়েলের শেয়ারের টাকা বণ্টনের মত ব্যবস্থা এখানেও রাখা উচিত।’
বিল্লাল নামের একজন পুলিশ সদস্য লিখেছেন, ‘মাইরা খাওয়ার ধান্ধারে ভাই। ২৭ হাজার টাকা জোর করে নিছে। আমি দিতে চাইনি। এই টাকাটা আমার বেতন থেকে যত মাস কেটে কেটে নিছে সেইসব মাসগুলো চলতে আমার খুব কষ্ট হইছে। ব্যাংকের লভ্যাংশ আহত-নিহতদের মাঝে, বিলিবণ্টন মানি না। আমি ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডার। বছর শেয়ে লভ্যাংশ পাই টু পাই হিসাব করে বুঝিয়ে দিবেন।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি (এস্টেট) ড. শোয়েব রিয়াজ আলম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সিদ্ধান্ত হয়েছে কমিউনিটি ব্যাংকের লভ্যাংশ যাবে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের অ্যাকাউন্টে। তখন ট্রাস্টের মাধ্যমে ওই টাকা ব্যয় হবে পুলিশ সদস্যদের কল্যাণে।’
মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা বলছেন তারা ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডার, এখন ব্যাংকের লাভ তারা সরাসরি নিজেদের ব্যাংক হিসাবে চান- এ প্রসঙ্গ তুলে ধরলে তিনি অবাক হয়ে বলেন, ‘শেয়ার তো আমরা বাজারে ছাড়িনি এখনো। ওরা (পুলিশ সদস্য) তো ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডার না। শেয়ার তো বাজারে পাঁচ বছর পর ছাড়বো। যারা বলতেছে, তারা শেয়ার হোল্ডার নাকি?’
‘আমরা তো ব্যাংকই চালু করিনি, শেয়ার কেন ছাড়বো বলেন? ব্যাংকটা যখন স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধন হবে তখন আমরা বিনিয়োগ নেওয়ার জন্য শেয়ার ছাড়বো। তখন যারা নেবে, তারাই শেয়ার হোল্ডার হবে। এখন ওরা শেয়ার হোল্ডার না, ব্যাংকের জন্য টাকা দিয়েছে, প্রফিট যাবে কল্যাণ ট্রাস্টে, তখন কল্যাণ ট্রাস্ট তাদের টাকা দেবে। আর শেয়ার বাজারে যখন ছাড়বো, তখন ওরা নিতে পারবে।’ যোগ করেন অতিরিক্ত ডিআইজি (এস্টেট) ড. শোয়েব রিয়াজ আলম।
তিনি বলেন, ‘আরেকটা আছে, উদ্যোক্তা শেয়ার হোল্ডার। একটা ব্যাংক গঠনের সময় উদ্যোক্তা শেয়ার হোল্ডার হতে হলে কমপক্ষে এক কোটি টাকা রাখতে হয়। এরা তো রাখছে ২৭৮ হাজার টাকা, এক লাখও না। ওরা তো উদ্যোক্তা শেয়ার হোল্ডার হতে পারবে না। কারণ কেউ তো এক কোটি টাকা রাখতে পারতো না। আমরা ওপেন বলেছিলাম, কেউ ১০, ২০ ও ২৫ হাজারের বেশি রাখতে চায় না। ২৭ হাজার টাকা নিতে এক বছর লেগেছে। এক কোটি টাকা নিতে হয়তো ১০-১৫ বছর লেগে যেতো।’
‘এখন শেয়ার হোল্ডার বলেন বা উদ্যোক্তা শেয়ার হোল্ডার তারা কিছুই হয়নি। শুধু কমিউনিটি ব্যাংকের তহবিলে ২৭ হাজার টাকা জমা দিয়েছে, সেজন্য তাদের সনদ দেয়া হবে। এই ২৭ হাজার টাকার জন্য তারা কর্মরত থাকাকালীন বিভিন্ন সুবিধা পাবে। কেউ রিটায়ার্ড করলে বা অব্যাহতি নিলে তখন আবেদনের প্রেক্ষিতে টাকাটা ফেরত পাবে।’
কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ-এ সব ধরনের গ্রাহক লেনদেন করতে পারবেন। তবে পুলিশ সদস্যরা স্বল্পসুদে ঋণ নেয়ার সুবিধা পাবেন। ব্যাংকটির পরিচালনায় থাকবেন পুলিশরাই। পরিচালনা পরিষদের প্রধান হবেন আইজিপি। পরিষদের সদস্যরা কেউই স্থায়ী নন। পদাধিকারবলে (পুলিশে যার যে পদ) পরিচালনা বোর্ডের পদবি নির্ধারণ করা হবে। কেউ চাকরি থেকে অবসর নিলে তিনি পরিষদের পদে বহাল থাকতে পারবেন না।
অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় কমিউনিটি ব্যাংকের স্বচ্ছতার মাত্রা অনেক বেশি হবে বলেও আশাবাদ প্রকাশ করেন অতিরিক্ত ডিআইজি (এস্টেট) ড. শোয়েব রিয়াজ আলম।
এসআর/এটি/একুশে