সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

বনের গরু মনের কারাগারে ! (ভিডিও)

প্রকাশিতঃ ৪ মার্চ ২০১৮ | ১০:৫১ পূর্বাহ্ন

আজাদ তালুকদার : বনের গরু বা ‘গয়াল’ এখন বিলুপ্ত পশু। পশুটির বিলুপ্তি ঠেকাতে বনবিভাগ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এর লালন-পালন উন্মুক্ত করে দেয় বেশ ক’বছর আগে। শুধু তাই নয়, ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে খাগড়াছড়িতে গয়াল পালনের প্রকল্পও হাতে নিয়েছিল সরকার। কিন্তু একসময় মুখ থুবড়ে পড়ে সেই প্রকল্প।

ভারতের ‘সেভেন সিস্টার’ ও মিয়ানমারে বিলুপ্ত এই পশুটির সরকারি ও ব্যক্তিপর্যায়ে লালন-পালন হলেও বাংলাদেশে এর পরিচর্যা বা চাষাবাদ খুব একটা চোখে পড়ে না। এ অবস্থায় হারিয়ে যাওয়া পশুটি পরম মমতায় লালন-পালন করছেন এক উচ্চশিক্ষিত যুবক। নাম এরশাদ মাহমুদ। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া-বান্দরবান সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায় গড়ে তুলেছেন ‘গয়াল-খামার’।

২০০৮ সালে ছোটবড় তিনটি গয়াল দিয়ে যাত্রা করা এরশাদের গয়াল-খামারে নিয়মিত বেচাকেনার পরও বর্তমানে ৫০টির বেশি গয়াল রয়েছে। এর মধ্যে আছে পরিণত বয়সের অন্তত ৪০টি গয়াল, যেগুলোর প্রতিটির মূল্য দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা।

বৃহস্পতিবার (১ মার্চ) পড়ন্ত বিকেলে গয়াল-খামারের পাশেই এরশাদ মাহমুদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল একুশে পত্রিকার। এসময় একুশে পত্রিকার সম্পাদকীয় পরামর্শক রেহানা বেগম রানু, একুশে পত্রিকার সুহৃদ এইচএম জামাল উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।

বুনো গরু বা গয়ালের বংশবিস্তার সম্পর্কে চমৎকার এক গল্প শোনান গয়ালবন্ধু এরশাদ মাহমুদ; বলেন, ‘গয়ালের এক অসাধারণ ক্যারেক্টার! তাদের মধ্যে মা-ছেলে, ভাইয়ে-বোনে সহবাস কিংবা প্রজনন হয় না। ২০০৮ সালে মা-ভাই-বোন মিলিয়ে তিনটি গয়াল দিয়ে শুরু করে পরবর্তীতে দেখি তাদের মাঝে বংশবিস্তার হয় না। অথচ তারা যথেষ্ট ম্যাচিউর, ঋষ্টপুষ্ট।’

অগত্যা, বান্দরবান থেকে দুটি পুরুষ গয়াল কিনে নিয়ে আসি। কিছুদিন পর দেখি মা-মেয়ে দুজনই ‘কনসিপ’ করেছে। এভাবেই শুরু হয় বংশবিস্তার। পশুর মাঝে এই স্বকীয়তা, সংকোচননীতি আমাকে যারপরনাই বিস্মিত করে। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা কাজ করে তাদের জন্য।-বলেন এরশাদ।

এরশাদ মাহমুদ বলেন, রীতিমত গয়ালের মমতায় জড়িয়ে গেছি আমি। প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় গয়ালের সঙ্গে কাটাই। আমি তাদের (গয়াল) বুঝতে চেষ্টা করি। গয়ালরাও আমাকে বোঝে, বোঝে আমার ভাষা। আমাকে দেখলে এগিয়ে আসে, আহ্লাদি হয়ে উঠে। দাঁড়াতে বললে দাঁড়ায়, বসতে বললে বসে- এমনকি লাফ দিতে বললে টুস করে লাফও দেয়-বলেন এরশাদ।

দিনে দুবার করে গয়ালদের ভুষি, শুকনো খড় খেতে দেয় রাজা মিয়া, হোসেন আহমদ ও বাচা। কখনো রশি খুলে দিয়ে পাহাড়ে, বনে-বাদারে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। মুক্তবিহঙ্গের মতো ডানা মেলে ঘুরে বেড়ায় তারা। ৫-৭ দিন পর আপনাআপনি আবার ফিরে আসে এরশাদের খামারে।

বনে-জঙ্গলে মিলিয়ে যাওয়া গয়াল পুনরায় খামারে ফিরে আসা সম্পর্কে এরশাদ বলেন, অনেকদিন ধরে ভালোবাসা দিয়ে, মমতা দিয়ে আগলে রেখেছি তাদের। পশু হলেও তাদের ‘সেন্স অব হিউমার’ ভালো। তারা আমাকে বোঝে, আমার মন বোঝে। এই মনের টানেই উন্মুক্ত জীবন থেকে স্বেচ্ছায় তারা ফিরে আসে। বন্দী হয় আমার ‘মনের কারাগারে’।

অবশ্য ফিরে আসার আরেক তথ্য জানান এরশাদ মাহমুদ। বলেন, ‘প্রতিদিন খাবারের সঙ্গে লবণ মিশিয়ে সুস্বাদু করে খেতে দেয়া হয় তাদের। লবণ খেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে লবণ ছাড়া ৫-৭ দিনের বেশি থাকতে পারে না তারা। ছুটে আসে লবণের কাছে, লবণদাতার কাছে। পুনরায় বেছে নেয় গৃহপালিত জীবন।’

বনের জীবন থেকে গৃহপালিত হয়ে উঠা এই পশুটি ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের চেয়েও অনেক বেশি কৃতজ্ঞতা দেখায়। মানুষ ‘নুন’ খেলে অনেকসময় ভুলে যায়, বেঈমানি করে। আর বনের পশুটি যার ‘নুন’ খায় তার ‘গুণ’ গায়। যেখানেই যাক ঘুরেফিরে কাছে থাকে, পাশে থাকে। যোগ করেন পশুপ্রেমী এরশাদ মাহমুদ।

যত্ন করে করতে পারলে গয়ালের প্রজণন-খামার বেশ লাভজনক জানিয়ে এরশাদ মাহমুদ জানান, দুইবছর লালন-পালনের পর একটি গরু বিক্রি করে একলাখ টাকা পাওয়া গেলে গয়াল বিক্রি করে দুইগুণ টাকা পাওয়া যায়। তাছাড়া গয়ালের মাংস গরুর মাংসের চেয়ে স্বাদ বেশি। সৌখিন কোরবানিদাতা, ওরশ মাহফিল, মেজবান-আয়োজকদের কাছে গয়ালের কদর বাড়ছে। তাই গয়ালের খামার করে এর বিলুপ্তি ঠেকানোর পাশাপাশি বেকারত্ব ঘুচানো শুধু নয়, বছরে মোটা অংকের টাকা উপার্জন সম্ভব। এখাতে যারা বিনিয়োগ করতে চান তাদেরকে বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় টিপস দিয়ে সহযোগিতার কথাও জানান এরশাদ।

শুধু গয়ালচাষ নয়, গরু, মহিষ, ছাগল, হাস এমনকি মুরগী চাষও করেন এরশাদ মাহমুদ। করেন মৎস্যচাষ। নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছেন বৃহদাকারের ৫০টি মৎস্যখামার। করেছেন মাইলের পর মাইল ট্রি প্ল্যান্টেশন। ২০১৩ সালে সেরা মৎস্যজীবী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন এরশাদ মাহমুদ। এরশাদের বিভিন্ন প্রকল্পে বর্তমানে ২শ’র বেশি মানুষ কাজ করেন।

চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুল থেকে ১৯৮০ সালে এসএসসি, হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ থেকে এইচএসসি এবং রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ থেকে বিএ পাশ করে আইন কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন এরশাদ মাহমুদ। আইনজীবী পিতা নুরুচ্ছফা তালুকদার চেয়েছিলেন ছেলে তার মস্তবড় আইনজীবী হবে। কিন্তু বাবার এই চাওয়া কখনো টানেনি তাকে। তাই আইনপড়া অসম্পন্ন রেখে গ্রামে পাড়ি জমান। একে একে গড়ে তোলেন বনায়ন, মৎস্যপ্রকল্প, গরু-মহিষ-গয়াল ও ছাগলের খামার।

এরশাদ বলেন, গ্রামে জন্ম হলেও বড় হয়েছি শহরে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে শহুরে জীবন, শহুরে চাকচিক্য আমাকে কখনো টানেনি। হাছান ভাইসহ অন্য ভাইবোনরা ক্যারিয়ার গঠনে রাজনীতি, ইউরোপ-আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জীবন বেছে নিলেও আমি স্বেচ্ছায় গ্রামীণজীবন বরণ করে নিয়েছিলাম। গ্রামের মাটি, মানুষ, লতাগুল্ম, গাছগাছালি আমার প্রেম, ধ্যানজ্ঞান।

ছোটবেলায় একবার স্কুলছুটিতে গ্রামের বাড়ি সুখবিলাস বেড়াতে এসে ভাঙা চায়ের কাপে অল্প মাটি মিশিয়ে তেতুল বিচি গুঁজে দিয়েছিলাম। কয়েকদিন পর দেখি সেখানে অঙ্কুরোদগম হয়েছে। পাতা গজিয়েছে। বাহ, কী আনন্দ! সেই থেকে ভেবেছি গাছ-বাঁশ, প্রাণ-প্রকৃতির জীবন বেছে নিবো। হয়েছেও তাই।

গয়ালের প্রেমে পড়লাম কী করে শুনবেন? আগ বাড়িযে শোনান এরশাদ। বলেন, ছোটবেলায় পটিয়ায় নানাবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। দেখি বিশাল সুন্দর এক পশুকে মুখে নাফা, বড় রশি দিয়ে বেঁধে টানাহ্যাচড়া করে নিয়ে যাচ্ছে একদল মানুষ। দৃশ্যটি দেখে বেশ মায়া হলো। কষ্ট লাগলো। গরু নয়, গরুর মতো দেখতে- কী এটা জানতে বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলাম। পরে জানলাম এটি বুনো গরু, বনে বনে থাকে, যার আভিধানিক নাম গয়াল। শিশুমনে সেদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমার অধিকারে একটি গয়াল চাই-ই। নিষ্ঠুরভাবে বেঁধে নয়, আদর দিয়েই বড় করবো পশুটিকে। বড় হয়ে আমার সেই ইচ্ছা পূরণ হলো। একটি নয়, আমার অধিকারে এখন ৫০টি গয়াল। বলেন এরশাদ।

এরশাদ জানান, ‘জীবনের স্বর্ণালী সময়গুলো গ্রামের মানুষ, সোদামাটির সঙ্গে পার করে দিয়েছি। সারাটা জীবন গ্রামে পড়েছিলাম বলে, প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্গে মিশেছিলাম বলে একসময় সাফল্য এসে আমাকে ধরা দিয়েছে। যখন দেখি, আমার মাছগুলো লুকোচুরি খেলে, আমার ডাকে সাড়া দেয়, বুনো গরু (গয়াল) আমাকে বুঝতে চেষ্টা করে, তখন অন্তরে অন্যরকম ভালোলাগা ছুঁয়ে যায়।’

এরশাদের এসব ব্যবসায় বর্তমানে বার্ষিক টার্নওভার দুইকোটি ৪০ লাখ টাকা। সব অর্থ তিনি ভোগ করেন না। উপার্জিত টাকার অর্ধেকের বেশি তিনি জনগণের কল্যাণে বিলিয়ে দেন। এজন্য গড়ে তুলেছেন, শিক্ষা, ক্রীড়া, চিকিৎসা, সামাজিক ও কৃষিচাষের জন্য সুদমুক্ত ঋণবিতরণ ফান্ড। যেখান থেকে এলাকার সামর্থহীন, হতদরিদ্র পরিবারের শিক্ষা, স্বাস্থ্যে অর্থসহায়তার পাশাপাশি, খেলাধূলায় প্রণোদনা, কন্যাদায়গ্রস্ত পরিবারের মেয়ে বিয়ে দেয়া, সুদমুক্ত ঋণ দিয়ে বিশেষত কৃষিকাজে প্রণোদনা দিয়ে থাকেন।

প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্গে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটাতে গিয়ে গিয়ে বিলাস-ব্যসন, ব্যক্তিগত জীবনের কথা একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিলেন এরশাদ মাহমুদ। অবশ্য পরিবারের অনুরোধে ৭ বছর আগে বিয়ে করেন তিনি। তার একমাত্র সন্তান চট্টগ্রাম গ্রামার স্কুল (সিজিএস) এর পড়ছে। থাকে শহরে মায়ের সঙ্গে। আর এরশাদ মাহমুদ থাকেন প্রকৃতির কাছে, মাছ-গাছের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। এমন নির্মল জীবন থেকে প্রকৃতিপ্রেমী এরশাদ মাহমুদকে কেউ ফেরাতে পারে না।

এখানে বলে রাখি, এরশাদ মাহমুদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক, সাবেক মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপির ছোটভাই। তার প্রয়াত পিতা অ্যাডভোকেট নুরুচ্ছফা তালুকদার চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও একাধিকবার পাবলিক প্রসিকিউটর ছিলেন।