আবু আজাদ : ফকির লালন গেয়েছিলেন ‘ও প্রেম আর আমার ভাল লাগে না/ সে প্রেমের দায়ে জেল খাটলাম/তবু ঋণ শোধ হলো না’। কিন্ত না সব প্রেমই নিষ্ঠুর হয় না। সত্যিকারের ভালবাসা কখনো শেষ হয় না। লালনের গানকে মিথ্যে করে দিয়ে চট্টগ্রামের রাসেল-তানিয়া জুটি আবারো প্রমাণ করলেন, ‘প্রেম চিরসুন্দর, প্রেম শাশ্বত।’
ঘটনার শুরু আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগে। এক পাড়াতেই বসবাস। সেই সূত্রে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠে চট্টগ্রাম নগরের বাকলিয়া মাস্টারপোল এলাকার কিশোর-কিশোরী রাসেল (২১) ও তানিয়ার (১৮) মাঝে। বাধা ছাড়া কি আর ‘প্রেম’ পুর্ণতা পায়! তাই চিরাচরিত নিয়মেই রাসেল ও তানিয়ার সম্পর্কের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় দু’জনের পরিবার। দু’পরিবারের বিরোধ চরম পর্যায়ে পৌঁছলে, রাসেলের বিরুদ্ধে মামলা করে তানিয়ার বাবা। প্রেমের দায়ে জেলে যেতে হয় রাসেলকে। গত প্রায় পচিঁশমাস ধরে জেলের ঘানি টানছেন রাসেল।
কিন্তু না, জাগতিক বিরোধের কাছে হেরে যায়নি রাসেল-তানিয়ার শাশ্বত ভালোবাসা। সব বাধা ডিঙ্গিয়ে রাসেল জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে তানিয়াকে। আদালতের নির্দেশে গত ১৩ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বিয়ে হয় রাসেল-তানিয়া জুটির।
রাসেলের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. ইসহাক একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রায় দু’বছর আগে তানিয়ার পরিবার রাসেলের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ এনে বাকলিয়া থানায় মামলা করে। ওই মামলায় সে সময় রাসেলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।’
তিনি আরো বলেন, ‘সম্প্রতি দু’পরিবারের সম্মতিতে মামলা তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করা হয়। কিন্তু চট্টগ্রামের প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত এ আবেদন নামঞ্জুর করলে হাইকোর্টে রিভিশন করেন তারা। পরে হাইকোর্ট জামিনের শর্ত হিসেবে রাসেল ও তানিয়ার বিয়ের আদেশ দেন।’
‘আদালতের আদেশের প্রেক্ষিতে, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে গত ১৩ ফেব্রুয়ারী(মঙ্গলবার) কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক (জেল সুপার) ইকবাল কবির চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে ও বেসরকারি কারাপরিদর্শক আবদুল মান্নানের উপস্থিতেতে রাসেল ও তানিয়ার বিয়ে সম্পন্ন হয়। এখন বিয়ের সার্টিফাইট কপি ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হাইকোর্টে পৌঁছালে রাসেলের জামিন হবে বলে আশা করছি।’ বলেন অ্যাডভোকেট মো. ইসহাক।
কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক (জেল সুপার) ইকবাল কবির চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে, এ বিষয়ে কথা বলতে আদালতের নির্দেশ লাগবে বলে একুশে পত্রিকাকে জানান তিনি।
বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারী) সকালে রাসেলের বাকলিয়ার বাসায় প্রতিবেদকের সাথে কথা হচ্ছিল তার ছোট বোন ইয়াসমিনের সাথে।
তিনি এ ঘটনার শুরুর দিককার কথা জানাতে গিয়ে বলেন,‘আমাদের জন্ম, ছোট থেকে বেড়ে উঠা সবই এই ইকবাল কলোনীতে (বাকলিয়া)। রাসেল ভাই-তানিয়া আপু সবাই এক সাথে এখানে বড় হয়েছে। বছর তিনেক আগে তাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠে। প্রথম প্রথম আমরা কয়েকজন জানলেও পরিবারের কেউ জানতো না বিষয়টি।’
ইয়াসমিন আরো বলেন, ‘কয়েকমাস পর বিষয়টি জানাজানি হলে দু’পরিবারের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। তানিয়া আপুর পরিবার তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। কিন্তু তিনি রাসেলকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিলেন না।’
‘২০১৬ সালের চাঁদরাত (৩০ রমজান)। তারিখটা ৭ জুলাই। তানিয়া আপু রাসেল ভাইয়ার সাথে একটিবার দেখা করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তার মা-বাবার ভয়ে পারছিলেন না। শেষমেষ রাত আড়াইটার দিকে তিনি আমাদের পাড়ার গলিতে রাসেল ভাইয়ার সাথে দেখা করতে যান। কিন্তু বিধিবাম, তারা ধরা পড়ে যান তানিয়া আপুর বাবার হাতে।’ বলেন, ইয়াসমিন।
বেসরকারি কারাপরিদর্শক আবদুল মান্নান জানান, এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে মেয়ের বাবা আব্দুল শুক্কুর বাকলিয়া থানায় রাসেলের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা করেন। রাসেল গ্রেপ্তার হয়। মামলা যায় চট্টগ্রামের প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে। রাসেলের পরিবার বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও তার জামিন করাতে পারেনি।
এদিকে, তানিয়ার পরিবার বাকলিয়া ছেড়ে চলে যায় জামালখানে। তানিয়াকে গ্রামের বাড়ী নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু তানিয়ার অমতে তা কোনোভাবেই হচ্ছিল না। এছাড়া বাকলিয়ার স্থানীয়রাও চাচ্ছিলেন বিষয়টির যেন সুষ্ঠু সমাধান হয়।
শেষমেষ কয়েকমাস আগে তানিয়ার পরিবার মামলা তুলে নিতে সম্মত হয়। কিন্তু আদালত তা নামঞ্জুর করেন। পরে তারা হাইকোর্টে রিভিশন করেন। এসময় হাইকোর্ট জামিনের শর্ত হিসেবে রাসেল ও তানিয়ার বিয়ের আদেশ দেন। পরে দু’পরিবারের সম্মতিতে জেল সুপার ইকবাল কবির চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে রাসেল ও তানিয়ার বিয়ে হয়। জানান আবদুল মান্নান।
কারাগারে বিয়ের পরিবেশ সম্পর্কে জানাতে গিয়ে আবদুল মান্নান বলেন, ‘ভাই হাজার হলেও বিয়েতো, দুটো জীবনের মিলন। তাই আমাদের পক্ষ থেকে হাল্টা মিষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। কারারক্ষী, আইনজীবী আর দু’পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে অনাড়ম্বর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় এই বিয়ে।’
একুশে/এএ/এটি