সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতিতে মেরুকরণ, আলোচনায় ছালাম

প্রকাশিতঃ ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭ | ১১:০৪ অপরাহ্ন

চট্টগ্রাম : ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিতে আসা সিডিএ চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালামকে ঘিরে চট্টগ্রাম মহানগরের রাজনীতিতে নয়া মেরুকরণের আভাস মিলেছে।

চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর কে হবেন নগর নগর আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি- এ প্রশ্নে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচনা হয় ছালামকে নিয়ে।

সূত্র মতে, ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের জন্য চার জন সহ সভাপতির পাশাপাশি নগর কমিটির কোষাধ্যক্ষ আব্দুচ ছালামই ছিলেন হাইকমান্ডের আলোচনার শীর্ষে।

সিডিএ’র চেয়ারম্যান পদের গুরুত্ব এবং ক্ষমতাকে ভিন্ন আঙ্গিকে নিয়ে গিয়ে আগেই আলোচনার জন্ম দেন ছালাম। যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার সিডিএ চেয়ারম্যান পদে থেকে মন্ত্রী-এমপির চেয়েও অনেক বেশি কাজ করা যায় তা দেখিয়েছেন ছালাম।

এ কারণে ২০০৯ সালের মে মাসে পরবর্তী দুইবছরের দায়িত্ব পাওয়া ছালামের মেয়াদ বাড়ানো হয় ৬ বার। নয়বছর ধরে চেয়ারম্যান পদে থাকা ছালামের মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন হয়েছে।

দেশের বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান ওয়েল গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালাম ২০০৪ এর দিকে নগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন। এরপর কো-অপ্ট করে মান্নান-মহিউদ্দিন কমিটির কোষাধ্যক্ষ করা হয় তাকে। পদ নিয়েও প্রথম কয়েকবছর রাজনীতির ‘অতিথি’ আর শুভানুধ্যায়ী হিসেবে এম এ মান্নান-মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায় হাজিরা দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন ছালাম।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এলে সরব হয়ে ওঠেন তিনি। প্রচার করেন তিনি চান্দগাঁও-বোয়ালখালী আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। সেসময় মহানগর আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ মহিউদ্দিন চৌধুরীকে সামনে রেখে এবং কেন্দ্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়া কয়েক নেতার সহযোগিতায় দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা পর্যন্ত পৌঁছতে বেগ পেতে হয়নি ছালামকে। মনোনয়নও একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মহাজোট সমীকরণে এই আসনে জাসদ সভাপতি মইন উদ্দিন খান বাদল চূড়ান্ত মনোনয়ন পান। তবে দল ক্ষমতায় এলে ‘অন্যভাবে’ মূল্যায়িত হওয়ার আশ্বাস আদায় করেই ঘরে ফিরেন বুদ্ধিমান ছালাম।

সেই আশ্বাসের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের ৪ মাসের মাথায় বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক কোটায় প্রথম কোনো ব্যক্তি সিডিএ’র চেয়ারম্যান পদে আসীন হন আব্দুচ ছালাম। দায়িত্ব নিয়েই নির্জীব, প্রাণহীন সিডিএকে জাগিয়ে তুলেন। চট্টগ্রাম নগরীতে নতুন নতুন রাস্তা নির্মাণ, প্রভাবশালীদের অবৈধ দখলদারিত্ব গুঁড়িয়ে দিয়ে রাস্তার সম্প্রসারণ, রিঙ্ক রোড নির্মাণ, একের পর এক ফ্লাইওভার প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং সর্বশেষ চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে ৫ হাজার কোটি টাকার বিশাল অঙ্কের বরাদ্দ এসেছে ছালামের হাত ধরেই।

গত মেয়র নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসেবেও দলীয় ফোরামে ছালাম ছিলেন আলোচনার তুঙ্গে। কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন নেতা, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের প্রায়সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন ছালামের মনোনয়নের পক্ষে। এ নিয়ে বিস্মিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনোনয়ন চূড়ান্ত করার আগে ঠাট্টাচ্ছলে চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় এক নেতার কাছে জানতে চান, ‘মনোনয়ন ইস্যুতে আমার অফিসের সবাই ছালামের পক্ষে? এর রহস্য কী?’ ওই নেতা জবাব দিলেন, ‘আপা তার (ছালাম) কাছে যাদু আছে! অবশ্য সেই ‘যাদু’ বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন তা জানা যায়নি।

শুধু প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় নয়, প্রভাবশালী প্রায় মন্ত্রী-এমপি, দলের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেন ছালাম। প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানার সঙ্গেও তার যোগাযোগ আছে বলে শোনা যায়।

২০১৪ সালের শুরুর দিকে বিনা বিজ্ঞপ্তি ও লটারিতে চট্টগ্রামের সকল মন্ত্রী-এমপি, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা, ঢাকা-চট্টগ্রামের একডজন সাংবাদিকসহ ৫৯ জনকে সিডিএ’র অনন্যাতে প্লট ‘উপহার’ দিয়ে তাদেরকে আজীবনের জন্য ‘সারথী’ করে নিয়েছেন। অবশ্য অঢেল সহায়সম্পত্তির মালিক এমন মন্ত্রী-এমপিকে প্লট উপঢৌকন দেওয়ায় সেসময় তীব্র সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছিল ছালামকে।

মহিউদ্দিন চৌধুরীর হাত ধরে রাজনৈতিক অভিষেক হলেও একটা সময়ে গিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে ডা. আফছারুল আমীন, আ জ ম নাছির উদ্দীন, ইব্রাহীম হোসেন বাবুল, এম রেজাউল করিম চৌধুরী গ্রুপে ভিড়ে যান আব্দুচ ছালাম।

তবে পরবর্তীতে কৌশলী ছালাম মহিউদ্দিন চৌধুরীর জীবদ্দশাতেই ঘুচিয়ে ফেলেন সেই দূরত্ব। ফলে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার ধসে ১৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় ছালামের গ্রেফতার ও ফাঁসি দাবি করা মহিউদ্দিন চৌধুরীও সহজে বুকে টেনে নেন তাকে। মহিউদ্দিনের মৃত্যুর পর জানাজা, কুলখানি, মহিউদ্দিনের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর সান্ত্বনা দিতে যাওয়া সবকিছুতেই মহিউদ্দিন-পুত্র কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার নওফেলকে ছায়ার মত সঙ্গ দিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে মহিউদ্দিন-পরিবারের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন ছালাম।

এ প্রসঙ্গে রাজনীতি সচেতনরা বলছেন, বর্তমানে ‘নতজানু’, ‘সমঝোতা’র রাজনীতিতে টিকে থাকার সব যোগ্যতাই আব্দুচ ছালামের রপ্ত হয়ে গেছে। তাই আগামীতে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে তিনি টিকে যাবেন তা এখনই বোঝা যাচ্ছে।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব প্রশ্নে আগ্রহী ৪-৫ জন সহ সভাপতিকে পিছনে ফেলে নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আব্দুচ ছালামই আলোচনার শীর্ষে ছিলেন।

চট্টগ্রামের রাজনীতিতে প্রবীণ ও জ্যেষ্ঠ পদের নেতাদের ডিঙিয়ে এই মুহূর্তে আব্দুচ ছালামকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হলে অনেকেই তা মেনে নিবেন না। গ্রুপিং আরও বেশি চাঙ্গা হবে- সেই সমীকরণে শেষমেশ দলের জ্যেষ্ঠ সহ সভাপতি অসুস্থ মাহতাবউদ্দিন চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী। এ যাত্রায় সুযোগ হাতছাড়া হলেও সব মিলিয়ে আব্দুচ ছালামের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় সূত্রগুলো।

সূত্র জানায়, নানা কারণে আব্দুচ ছালাম নেত্রীর গুডবুকে রয়েছেন। তাই আগামীতে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখা যেতে পারে তাকে। অর্থনৈতিক ভিত্তি, নরম মেজাজ, পরিশ্রমী ও কাজপাগল, সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার মানুষ হিসেবে দলের ভেতরে-বাইরে অনেকের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছেন ছালাম। সেক্ষেত্রে আগামীতে তাকে চট্টগ্রাম নগর কমিটির শীর্ষ পদে বসিয়ে দিলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। এক্ষেত্রে স্বপদে বহাল রাখা হতে পারে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক, সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনকে।

কেন্দ্রীয় সূত্র বলছে, মেয়র নাছিরের জনপ্রিয়তা কমে গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সুনজরে নেই, ছিটকে পড়তে পারেন নাছির; এ ধরনের নানা কথার মাঝেও আ জ ম নাছির তার জায়গাতেই থাকবেন। কারণ, কোনো কারণে সরকার পরিবর্তন হলে বিরোধী দলে থেকে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার মতো অর্থনৈতিক ভিত্তি, কর্মীবাহিনীসম্পন্ন প্রভাবশালী নেতার ‘কদর’ দলে কোনো অংশে কমেনি, বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাই আ জ ম নাছির আগামীতেও দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকবেন তা একপ্রকার নিশ্চিত। তবে নাছির দলীয় পদে বহাল থাকলে মেয়র পদের মনোয়ন পরিবর্তন হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে সূত্রটি। এক্ষেত্রে উন্নয়ন সমন্বয় ও পরিচালনার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আব্দুচ ছালাম অথবা মহিউদ্দিন-পুত্র ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলই হতে পারেন দলের পরবর্তী মেয়র প্রার্থী।

সূত্র বলছে, নির্বাচনের বাকি আর মাত্র ১০ মাস। মহানগর আওয়ামী লীগের বর্তমান মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে না দিয়ে নির্বাচন পর্যন্ত এই কমিটি বহাল রাখার পক্ষে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একটি বড় অংশ। নির্বাচনের আগে বড় ধরনের গ্রুপিং এড়াতে তাদের এই ‘মত’ বলে জানা গেছে।

তবে আরেকটি অংশ চাইছে, নির্বাচনের আগে চট্টগ্রামে একটি শক্তিশালী নতুন কমিটি গঠিত হলে নিঃসন্দেহ জাতীয় নির্বাচনে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সবমিলিয়ে নির্বাচনের আগে নাকি পরে চট্টগ্রাম নগরের কমিটি হচ্ছে তা সূত্রগুলো নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি।

এসব বিষয়ে কথা বলতে বৃহস্পতিবার সারাদিন সিডিএ চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালামের সাথে দফায় দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কোনোবারই তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে রাত ১০ টার দিকে তার ব্যক্তিগত সহকারী তারেক গণির সাথে যোগাযোগ করা হলে একুশে পত্রিকা তিনি জানান, স্যার (ছালাম) চট্টগ্রামের বাইরে আছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারেক আহমেদ সিদ্দিকীর মেয়ের বিয়েতে অংশ নিতে বৃহস্পতিবার সকালে তিনি ঢাকা গেছেন।