আজাদ তালুকদার, সিঙ্গাপুর :
সিঙ্গাপুর নগরকে একটা সাজানো বাগান, নাগরিক ভূস্বর্গ বললেও অত্যুক্তি হবে না। নগরের রাস্তাঘাট ঝকঝকে পরিষ্কার। দক্ষ পরিবহনব্যবস্থা, সর্বাধুনিক আবাসিক ব্যবস্থা, লোভনীয় শপিং, বৈচিত্র্যময় পর্যটন ও বিনোদনের পর্যাপ্ত আয়োজন, সর্বাধুনিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার বিচারে সিঙ্গাপুরকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় আবাসস্থল বলা যায়। ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনন্য-গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ মালাক্কা প্রণালি ভারত মহাসাগর এবং চীন সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের সংযোগের সবচেয়ে সুগম জলপথ। এই প্রণালির তীরে অবস্থিত সিঙ্গাপুর বিশ্বের সর্বাধিক জাহাজ চলাচলের রুটের জন্য বেশ কয়েকটি আধুনিক ও দক্ষ বন্দরসুবিধা গড়ে তুলে এই খাতকে দেশের আয়ের অন্যতম প্রধান সূত্রে পরিণত করেছে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক ‘হাব’ হিসেবে পুনরায় রপ্তানির জন্য শিল্পায়নের এক সফল কেন্দ্র এবং বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অতুলনীয় সমৃদ্ধির প্রতীক হয়ে উঠেছে সিঙ্গাপুর।
প্রকৃতপক্ষে লি কুয়ানের শাসন ১৯৫৯ সাল থেকে ২০১৫ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ৫৬ বছর ধরেই বহাল ছিল। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত লি কুয়ান ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, তারপর ছিলেন ‘সিনিয়র মন্ত্রী’, এরপর ছেলেকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে প্রকৃত ক্ষমতাদণ্ডটি আমৃত্যু নিজের হাতেই রেখে দিয়েছেন। এখনো তাঁর ছেলেই প্রধানমন্ত্রী।
স্বাধীনতার পরপর সিঙ্গাপুরের মানুষ বছরের পর বছর অভাব, কষ্ট সহ্য করেছে। সাথে ছিল ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া কলোনিয়াল সিস্টেমের উচ্ছিষ্ট। যার দরুন সুশাসন এবং দুর্নীতির প্রকোপ। তাতে লি কুয়ান দমে যাননি। দমে যায়নি তার অনুসারীরাও। দাঁতে দাঁত চেপে প্রায় দুই দশকের পরিশ্রমে তারা দুর্নীতি, অভাব সবকিছুকে ঝাঁটাপেটা করে বিদায় করে। তিন দশকের মাথায় লি কুয়ান সিঙ্গাপুরকে পরিণত করেন এশিয়ার অন্যতম ধনী দেশ হিসেবে। এখন সিঙ্গাপুর মাথা পিছু আয়ের দিক থেকে পুরো পৃথিবীতে দ্বিতীয় কী তৃতীয়। তাদের সমুদ্র বন্দর বিশ্বের সবচাইতে ব্যাস্ততম বন্দর। তেল শোধনে সিঙ্গাপুর বাঘা বাঘা দেশকে পেছনে ফেলে তৃতীয়। প্রায় সব নাগরিকের জন্য আধুনিক পরিকল্পিত আবাসনব্যবস্থা সিঙ্গাপুরে। সব শিশুকে স্কুলে পাঠানো মা-বাবার জন্য বাধ্যতামূলক। এই নিয়ম না মানলে জেলে যেতে হবে মা-বাবাকে।
লি কুয়ান যত দিন বেঁচে ছিলেন, সিঙ্গাপুরের অধিকাংশ ভোটার কৃতজ্ঞচিত্তে স্বেচ্ছায় তাঁকে ভোট দিয়েছেন, এটা যেমন অস্বীকার করা যাবে না, কিন্তু এটাও সত্য যে রাজনৈতিক বিরোধিতাকে একেবারেই সহ্য করতেন না লি কুয়ান। প্রকৃতপক্ষে ওখানে ৫৬ বছর ধরে চলেছে লি কুয়ানের একনায়কত্ব, একজন একনায়কের সুদক্ষ শাসন। সব ‘সিস্টেম’ প্রায় শতভাগ কার্যকর ওখানে। সিঙ্গাপুরের প্রশাসন আইন প্রয়োগে কঠোর, এমনকি শাস্তি হিসেবে বেত্রাঘাত এখনো চালু আছে সিঙ্গাপুরে।
রাস্তায় চুইংগাম বা ধূমপানের অপরাধেও সপ্তাহ খানেক রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার শাস্তি মিলতে পারে। লি কুয়ান বড়াই করেই বলতেন, প্রতীচ্যের গণতন্ত্র প্রাচ্যের সংস্কৃতির জন্য উপযোগী নয়। প্রাচ্যের জন্য প্রয়োজন ‘ডিসিপ্লিন’ ও দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন। তাই দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ছিল তাঁর। তাঁর বা তাঁর পরিবারের কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা পুঁজি লুণ্ঠনের কোনো অভিযোগ শোনা যায় না। কোনো মন্ত্রীর দুর্নীতিও সহ্য করতেন না লি কুয়ান।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বিচারে সিঙ্গাপুরের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। তবু সিঙ্গাপুরকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিংবা রাজনৈতিকভাবে মুক্ত সমাজ বলা যাবে না। লি কুয়ান সিঙ্গাপুরকে একটা ‘মেরিটোক্রেসি’ হিসেবে গড়ে তুলেছেন সারা বিশ্ব থেকে মেধাবী ব্যক্তিদের আকর্ষণ করে এবং সিঙ্গাপুরের অধিবাসীদের মেধা বিকাশের সর্বাধুনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলে। ‘মিডিওকারদের’ নানাভাবে লি কুয়ান বুঝিয়ে দিতেন তাঁর এই পছন্দের ব্যাপারটা। কোনো অভিবাসী শ্রমিকই একাধারে চার বছরের বেশি সিঙ্গাপুরে থাকার অনুমতি পান না, কিন্তু প্রকৌশলী, চিকিৎসক বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের মতো পেশাজীবীর জন্য আলাদা নিয়ম। আশপাশের দেশগুলো থেকে যেসব নারী শ্রমিক সিঙ্গাপুরে প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন, তাঁদের নিয়মিত প্রেগনেন্সি টেস্ট দিতে হয়, তাঁরা গর্ভধারণ করলে সরাসরি বের করে দেওয়া হয় সিঙ্গাপুর থেকে।
আবার এমন নজিরও আছে, লি কুয়ান ঘটকালি করেছেন দুই মেধাবী নারী-পুরুষের বিয়েতে। তাঁরা যাতে বেশি সন্তানের জন্ম দেন, সে ব্যাপারেও প্রকাশ্যে উৎসাহ দিতেন তিনি। তিনি ঠাট্টা করে বলতেন, ‘আমার সিঙ্গাপুর হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র “কমিউনিস্ট” রাষ্ট্র।’ সামাজিকভাবে সিঙ্গাপুরের চৈনিক (৭১ শতাংশ), মালয়ি (১৮ শতাংশ) ও ভারতীয় (৭ শতাংশ) জাতিসত্তার জনগণ অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান ও মেলামেশার পরিবেশ গড়ে তুলেছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ উদাহরণও সৃষ্টি করেছে সিঙ্গাপুর।
সিঙ্গাপুরের এমনসব নান্দনিকতা আর বিস্মিত উত্থানের অলি-গলিতে হেঁটে কাটলো বৃহস্পতিবারের পুরো সময়টা।ধন্যবাদ বলবোনা, বলতে পারি ভালোবাসার অশেষ ঋণ জমেছে বিল্লাল ভাইয়ের (এইচ এ বিল্লাল হোসেন, সভাপতি, মালয়েশিয়া ছাত্রলীগ) কাছে।