পুলিশ প্রশাসন পুলিশের বাইরে স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠনের ঘোর বিরোধিতা করেছে। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের কাছে পাঠানো এক মতামতে তারা স্পষ্ট জানিয়েছে, এ ধরনের সংস্থা গঠিত হলে পুলিশের কার্যকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা, দুটোই হারাবে। এতে সমাজে জনশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার ক্ষেত্রে মারাত্মক অবনতি ঘটার পাশাপাশি ফৌজদারি বিচারকেন্দ্রিক সমন্বিত সুশাসন সম্পর্কিত সমস্যাগুলো আরও জটিল আকার ধারণ করবে।
সম্প্রতি বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ফৌজদারি মামলার তদন্তের জন্য পুলিশের বাইরে আলাদা সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করে। এ বিষয়ে পুলিশ বাহিনীর মতামত জানতে চেয়ে গত ২ জানুয়ারি পুলিশের আইজিপিকে চিঠি দেয় কমিশন। সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আইজিপি বাহারুল আলম পুলিশের সকল ইউনিট প্রধান এবং অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে বৈঠক করে এই মতামত তৈরি করেন।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা এই প্রসঙ্গে বলেন, “আলাদা তদন্ত সংস্থার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা। তদন্তকারী কর্মকর্তার উপরই তদন্তের এখতিয়ার থাকা উচিত, অন্য কারো হস্তক্ষেপ নয়।”
পুলিশের পক্ষ থেকে স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠনের পরিবর্তে প্রতিটি থানায় বিদ্যমান তদন্ত সংশ্লিষ্ট জনবল নিয়ে স্বতন্ত্র তদন্ত শাখা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সাথে যুক্ত সকল সংস্থার পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধি, কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধেরও দাবি জানানো হয়েছে।
এছাড়া বিচারিক কার্যক্রম দ্রুত ও দক্ষতার সাথে পরিচালনার জন্য একটি স্বতন্ত্র ও জবাবদিহিমূলক প্রসিকিউশন সংস্থা বা অ্যাটর্নি সার্ভিস তৈরির প্রস্তাব করেছে পুলিশ। প্রস্তাবিত প্রসিকিউশন সংস্থায় ৫০ শতাংশ আইন বিষয়ে ডিগ্রিধারী কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগ এবং অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ বিদ্যমান কোর্ট পুলিশে কর্মরত সিএসআই/জিআরওগণ হতে তদূর্ধ্ব পুলিশ কর্মকর্তাদের নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের মতামতে বিদ্যমান কোর্ট পুলিশ কর্তৃক প্রসিকিউশন ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাবও করা হয়েছে। এতে বিচারিক আদালতে মামলার ডকেট সংরক্ষণ, মালখানা ও হাজতখানা ব্যবস্থাপনা, আসামিদের নিরাপত্তা, সাক্ষীদের সুরক্ষাসহ সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব হবে বলে মনে করে পুলিশ।
পুলিশের তদন্তের মান নিয়ে প্রায়শই প্রশ্ন উঠলেও, পুলিশ বলছে, এই ব্যর্থতা কেবল পুলিশের একার নয়, বাংলাদেশের সকল তদন্তকারী সংস্থারই অনুরূপ বা তার চেয়েও বেশি ব্যর্থতা রয়েছে। এ ব্যর্থতাকে রাষ্ট্রের সামগ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক দায় হিসেবে উল্লেখ করে, রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, লজিস্টিকস ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিকে মূল অনুঘটক হিসেবে দায়ী করেছে পুলিশ।
পুলিশের গোয়েন্দা তথ্য ও সামাজিক নেটওয়ার্ক তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় অপরাধ তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আলাদা তদন্ত সংস্থা গঠিত হলে নতুন করে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং জনসংযোগ কার্যক্রম তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত করা সময়সাপেক্ষ হবে। এতে আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রেক্ষাপট তৈরি হবে বলে আশঙ্কা পুলিশের।
ফৌজদারি মামলার তদন্তে পুলিশের অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ ২০ হাজার এসআই এবং ৫ হাজার ইন্সপেক্টর রয়েছেন। এছাড়াও অপরাধ তদন্তে পুলিশের সাইবার ফরেনসিক ল্যাব, কেমিক্যাল ল্যাব, আইটি ল্যাব, হস্তলেখা ও হস্তরেখা বিশারদ রয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, “১৫০ বছর ধরে পুলিশ ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত করে আসছে। নতুন তদন্ত সংস্থা গঠন করতে গেলে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয় হবে। এর পরিবর্তে পুলিশের সিআইডি, পিবিআইসহ বিশেষায়িত ইউনিটগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা উচিত।”
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০০৯ সালে নিম্ন আদালতের প্রসিকিউসনের কাজ সিএসআইদের থেকে সরিয়ে দেওয়ায় দুর্নীতি বৃদ্ধি এবং মামলার সাজার হার কমেছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের পিপির অফিস থেকে ১ হাজার ৯১১টি মামলার নথি গায়েব হওয়ার ঘটনাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।