রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

চট্টগ্রামে মিথ্যা মামলার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি: নিরীহ মানুষ গ্রেপ্তার আতঙ্কে

প্রকাশিতঃ ২৫ নভেম্বর ২০২৪ | ১০:১৭ পূর্বাহ্ন


একুশে প্রতিবেদক : চট্টগ্রামে মিথ্যা মামলার সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। সরকারের দৃঢ় অবস্থান ও সুস্পষ্ট নির্দেশনার পরও এ ধরনের মামলা দায়ের বন্ধ করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন অসঙ্গতিপূর্ণ অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলাগুলোতে নির্দোষ ব্যক্তিরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক তৈরি করছে।

সাতকানিয়ায় হত্যাচেষ্টা মামলায় একজন ডাক্তারের সহকারীর নাম জড়িয়েছে। মামলার ১৭ নম্বর আসামি মো. জাবেদ হাসানের দাবি, তাকে হয়রানি ও সামাজিকভাবে হেয় করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।

গত ৮ অক্টোবর সাতকানিয়া থানায় এই মামলা দায়ের করা হয়। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর রাত ৯টায় সাতকানিয়া থানাধীন কেরানিহাট-বান্দরবান সড়কের দস্তিরহাট এলাকায় হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর, জখম ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন আসামিরা। মামলায় মোট ৪৯ জনকে আসামি করা হয়েছে।

অভিযুক্ত জাবেদ হাসান পেশায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক (মেডিসিন) ডা. হাবিবুর রহমানের সহকারী। তিনি ২০০৫ সাল থেকে চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করছেন এবং কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত নন।

জাবেদ হাসানের দাবি, মামলার ঘটনার সময় তিনি চট্টগ্রামের এপিক হেলথ কেয়ারে ডাক্তার হাবিবুর রহমানকে সহায়তা করছিলেন। ডাক্তারের রেজিস্ট্রার এবং সিসিটিভি ফুটেজে তার উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যাবে।

জাবেদ হাসান বলেন, এই ঘটনায় আমি এবং আমার পরিবার চরম মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। তিনি প্রশাসনের কাছে ন্যায়বিচার দাবি করেছেন।

এ বিষয়ে জানার জন্য মামলাটির বাদী মোস্তাফিজুর রহমানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে জাবেদ হাসান বলেন, ‘মামলার বাদীর সঙ্গে আমরা কথা বলতে পেরেছি। তিনি জানিয়েছেন, মাত্র ১৫ জনকে তিনি আসামি করেছিলেন। কিন্তু আমি জাবেদ হাসানসহ বাকিদের নাম কীভাবে মামলায় যুক্ত হয়েছে তা তিনি জানেন না।’

বিষয়টি সাতকানিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খানকে অবগত করা হয়; কিন্তু তিনি কোন মন্তব্য করেননি।

আইনজ্ঞরা বলছেন, যার বিরুদ্ধে অসত্য অভিযোগ আনা হচ্ছে, রায়ে তাকে নির্দোষ ঘোষণা করা হলে মামলাকারীর সমান শাস্তি হতে পারে৷ অর্থাৎ দোষী প্রমাণ হলে আসামির যে শাস্তি হতো, নির্দোষ প্রমাণ হলে মামলাকারীকে একই শাস্তি দেওয়া হতে পারে৷

সিনিয়র আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা বলেন, ‘মিথ্যা অভিযোগকারী কিংবা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ২১১ ধারা অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়৷ তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হলো, ওই মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হতে হবে৷ বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের যদি মনে হয়, আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো মিথ্যা, ভিত্তিহীন, তুচ্ছ, বিরক্তিকর বা হয়রানিমূলক এবং আসামির প্রতি চাপ সৃষ্টি করতে মামলাটি করা হয়েছে, তাহলে এ ধরনের মামলা মিথ্যা মামলা হিসেবে গণ্য হবে৷ মামলা মিথ্যা বা ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হলে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগকারী বা মামলা দায়েরকারীকে দন্ড দিতে পারেন৷ এ ছাড়া সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বাদী হয়ে পৃথক মামলা দায়ের করতে পারেন৷’

মামলা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হলে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দিতে পারেন৷ এমনকি আদালত মিথ্যা অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে দন্ডমূলক ব্যবস্থাও নিতে পারেন৷ আমলযোগ্য নয়- এ রকম কোনো মামলায় কোনো পুলিশ কর্মকর্তা মিথ্যা প্রতিবেদন দিলে তার বিরুদ্ধেও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ দিতে পারেন৷

সম্প্রতি চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানায় একটি মামলায় মোহাম্মদ এয়াকুব নামে একজন সরকারি কর্মচারীকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় অভিযোগ করা হয়, তিনি ৫ আগস্ট বিকাল ৫টায় ডবলমুরিং থানার কাছে মনসুরাবাদ মাজার এলাকায় অস্ত্রসহ উপস্থিত ছিলেন এবং ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়েছেন। অথচ পাসপোর্ট ও ভ্রমণ নথি অনুযায়ী এয়াকুব সেই সময় ভারতে চিকিৎসার জন্য অবস্থান করছিলেন। ১ আগস্ট তিনি চেন্নাই যান এবং চিকিৎসা শেষে ৯ আগস্ট চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। এ মিথ্যা মামলায় তার নাম আসায় তিনি বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। তার অভিযোগ, অফিসের কিছু প্রতিপক্ষ তাকে ফাঁসাতে মিথ্যা মামলার আশ্রয় নিয়েছে।

আরেকটি আলোচিত ঘটনা ঘটে কোতোয়ালি থানায়। নাসিরুল আলম নামের একজন ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী ব্যবসায়ীকে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে একটি মামলায় ১৪৩ নম্বর আসামি করা হয়। নাসিরুল ১৯৮৯ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে বাস করছেন এবং ম্যানচেস্টারে ব্যবসা করেন। তিনি রাজনীতির সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নন। গত বছরের জুন মাসে তিনি দেশে ফিরেছিলেন। নাসিরুল মনে করেন, তার জায়গাজমি নিয়ে বিরোধের কারণে তাকে এই মামলায় জড়ানো হয়েছে।

মামলা প্রসঙ্গে কোতোয়ালি থানার ওসি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, “মিথ্যা মামলা হচ্ছে এটা অস্বীকার করার জো নেই। তবে আমরা নিশ্চিত করতে চাই, নিরীহ কেউ হয়রানির শিকার হবে না।”

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করেও সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন যুবলীগ কর্মী কফিল উদ্দিন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে হামলা ও পরিকল্পনার অভিযোগ এনে তিনি ১৮৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলায় ২৬ পুলিশ সদস্যসহ অনেকের নাম রয়েছে, যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন চট্টগ্রাম থেকে বদলি হয়ে গেছেন। কফিল উদ্দিন নিজে অস্ত্র ও মাদক সংক্রান্ত মামলার আসামি এবং এর আগেও গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন। তার মামলার এজাহারে উল্লেখিত তথ্য যাচাই করলে অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। এই মামলাটি নিয়ে চট্টগ্রামে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।

মিথ্যা মামলা দায়েরের এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। নিরপরাধ ব্যক্তিরা গ্রেপ্তার আতঙ্কে ভুগছেন। কেউ কেউ এলাকায় বসবাস করতেও ভয় পাচ্ছেন। বিশেষ করে যেসব মানুষ মামলার আসামি হয়েছেন অথচ ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন না, তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।

বেশ কিছু মামলায় দেখা যাচ্ছে, বাদীদের সঠিক পরিচয় নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ, ডবলমুরিং থানায় মামলা দায়েরকারী মোহাম্মদ মানিকের মোবাইল নম্বরে একটি ডিজিট কম দেওয়া হয়েছে, যাতে কেউ তাকে সহজে খুঁজে না পায়। অনেকেই মনে করছেন, এসব মিথ্যা মামলার পেছনে ব্যক্তিগত শত্রুতা, প্রতিশোধ বা প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার মতো উদ্দেশ্য কাজ করছে।

মিথ্যা মামলা প্রতিরোধে পুলিশও চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। ডবলমুরিং থানার ওসি কাজী রফিক আহম্মেদ স্বীকার করেছেন, “মামলা নিয়ে আমরা বিপাকে আছি। থানায় মামলা নিতে বাধ্য করা হয়। আবার মিথ্যা মামলা হলে সেটা যাচাই করতে সময় লাগে।” তবে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, মিথ্যা মামলায় কাউকে হয়রানি করা হবে না এবং সঠিক তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করা হবে।

মিথ্যা মামলার প্রবণতা নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম সফরে তিনি বলেন, “আগে পুলিশ ভুয়া মামলা করত, এখন পাবলিকও ভুয়া মামলা করছে।” তার এই মন্তব্য মিথ্যা মামলার বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে স্পষ্ট করে তুলেছে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে হওয়া মামলাগুলো যথাযথভাবে তদন্ত করতে হবে। কোনো নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা যাবে না। নিরীহ কারও নামে মামলা হলেও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নিতে হবে। গত ২৩ নভেম্বর সকালে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্বকালে মাঠ পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের এ নির্দেশনা দেন তিনি।

মিথ্যা মামলার এই প্রবণতা বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মিথ্যা মামলার দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা হলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি কমে আসবে। এ ছাড়া তদন্ত প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করতে হবে, যাতে নির্দোষ ব্যক্তিরা হয়রানির শিকার না হন।

উদ্ভুত পরিস্থিতিতে মামলা করে যাতে কাউকে হয়রানি করা না যায়, সেজন্য ডিসি, এসপি, জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে জেলা পর্যায়ে কমিটি করার কথা ভাবছেন বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল৷ তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনায় মামলা করে যাতে কেউ সুযোগ নিতে না পারে, সেজন্য এই কমিটি মামলার এজাহার বা এফআইআর করার আগে যাচাই করে দেখবে৷ কারণ, হয়রানিমূলক মামলা নিয়ে তারাও বিব্রত৷ এ নিয়ে কী করা যায় সেটা নিয়ে তারা ভাবছেন৷ গত ১৯ নভেম্বর সচিবালয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন: আইন মন্ত্রণালয়ের কৈফিয়ত’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা এসব কথা বলেন৷

আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘আজ যারা হয়রানিমূলক ও মিথ্যা মামলা করছেন, কাউকে কাউকে নাকি হুমকিও দেওয়া হচ্ছে যে টাকা না দিলে মামলা করা হবে৷’ হয়রানিমূলক মামলাকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা মনে রাখেন, আমি যদি এই মন্ত্রণালয়ে থাকি, আপনাদের কীভাবে শাস্তির আওতায় আনা যায়, সেই আইন খুঁজে বের করবো৷’