সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন: আইটি খাত কি পারবে পূরণ করতে?

প্রকাশিতঃ ১৬ নভেম্বর ২০২৪ | ৯:৪৭ পূর্বাহ্ন


নজরুল কবির দীপু : গত তিন দশকে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির সাক্ষী। শুরুতে দেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার হার্ডওয়্যার আমদানি ও বিক্রির দিকে মনোযোগ দিলেও, দ্রুত তারা সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবার ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে। বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) শিল্পের উত্থান, যা মূলত সস্তা শ্রমের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে শুরু হয়েছিল, এখন দেশের জন্য একটি স্থায়ী শিল্প খাত হয়ে উঠেছে। বিপুল সংখ্যক তরুণ এই খাতে কাজ করে দেশের অর্থনীতিতে সরাসরি অবদান রাখছে।

তবে, বাংলাদেশে ডিজিটাল অবকাঠামোর অভাব এখনো একটি বড় বাধা। দেশের অনেক এলাকায় উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ নেই। এমনকি যেখানে সংযোগ আছে, সেখানেও মান প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বিদ্যুৎ সরবরাহও নিরবচ্ছিন্ন নয়। ফলে আইটি খাতের কার্যকারিতা ব্যাহত হচ্ছে। শহর ও গ্রামীণ এলাকার মধ্যে ডিজিটাল বৈষম্য এবং ধনী-দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রযুক্তির ব্যবহারে পার্থক্য স্পষ্ট। প্রবীণ নাগরিকদের জন্য ডিজিটাল শিক্ষার সুযোগ না থাকায় তারা ডিজিটাল সেবা গ্রহণে পিছিয়ে রয়েছেন। এ অবস্থা পরিবর্তন করা না গেলে দেশের আইটি খাতের প্রসার বাধাগ্রস্ত হবে।

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম প্রচুর প্রতিভাবান। তবে, তাদের শিক্ষাগত জ্ঞান এবং শিল্পক্ষেত্রের চাহিদার মধ্যে বড় ফারাক রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম এখনও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সক্ষম নয়। দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে দক্ষতা উন্নয়ন ও ক্রমাগত প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। এ ঘাটতি পূরণ করা না গেলে, তরুণ প্রজন্মের প্রতিভা অপচয় হবে এবং দেশের আইটি খাত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।

আইটি উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগ ও অর্থায়ন। বাংলাদেশের ব্যাংকিং সিস্টেম মেধাভিত্তিক শিল্পকে ঋণ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। স্থাবর সম্পত্তি জামানত না থাকায় আইটি কোম্পানিগুলো সহজে ঋণ পায় না। এই পরিস্থিতি আইটি খাতে বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করছে। বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য নীতিমালার সরলীকরণ এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এ খাতে আর্থিক সহায়তা এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার জন্য সরকারের সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।

বাংলাদেশের আইটি খাত একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে প্রতিযোগিতা করছে, তবে ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, এবং শ্রীলংকার মতো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশের সেবার মান উন্নত করা এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। বর্তমানে বাংলাদেশের আইটি সেবা রপ্তানি মোটামুটি প্রাথমিক স্তরের। এই ধরনের সেবা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এবং রোবটিক প্রসেস অটোমেশন (আরপিএ) দিয়ে সহজেই প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। ফলে এসব কাজের চাহিদা কমে যাচ্ছে। সস্তা শ্রমনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে গুণগত মানে বিনিয়োগ করার সময় এসেছে।

গবেষণা ও উন্নয়ন বাংলাদেশের আইটি খাতের জন্য একটি অবহেলিত ক্ষেত্র। দেশে মেধাস্বত্ব সুরক্ষা আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ হয় না, যা নতুন উদ্ভাবনকে নিরুৎসাহিত করে। শিক্ষাব্যবস্থাও এখনও চিরাচরিত ও গতানুগতিক পাঠ্যক্রমে সীমাবদ্ধ, যা উদ্ভাবনী চিন্তা এবং দক্ষতার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। এর ফলে দেশীয় আইটি খাত নতুন ধারণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ ছাড়া, একটি দেশ কখনো নিজস্ব মেধাস্বত্ব তৈরি করতে সক্ষম হয় না।

বাংলাদেশের বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে আইটি খাতকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার সম্ভাবনা রয়েছে। আইটি খাতে কাজ করার জন্য বড় জায়গার প্রয়োজন পড়ে না। একটি ল্যাপটপ ও উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই একজন ব্যক্তি ঘরে বসেই লক্ষাধিক টাকা আয় করতে পারে। এমনকি শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিরাও এ খাতে কাজ করতে পারেন। বিপিও কোম্পানিগুলো স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে দ্রুত কর্মী নিয়োগ করতে পারে। ফলে এটি দেশের বেকার সমস্যা সমাধানের একটি কার্যকর উপায় হতে পারে।

তবে, বাংলাদেশের আইটি খাতকে এগিয়ে নিতে আরও কিছু উদ্যোগ প্রয়োজন। উদীয়মান প্রযুক্তি যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন, এবং মেশিন লার্নিং-এ দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা জরুরি। আন্তর্জাতিক কোম্পানির সঙ্গে সহযোগিতা বাড়িয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ও জ্ঞানকে সহজলভ্য করতে হবে। বিদেশি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে চুক্তি করে দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পাঠ্যক্রম আধুনিকায়ন করতে পারে। এর ফলে জ্ঞানের পরিধি বাড়বে এবং ছাত্র-ছাত্রীদের চাকরি পাওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।

ডিজিটাল বিভাজন কমাতে শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে অবকাঠামোগত বৈষম্য দূর করা জরুরি। ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের দাম কমেছে, কিন্তু ন্যাশনওয়াইড ট্রান্সমিশনের খরচ এখনও অনেক বেশি। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে গ্রামাঞ্চলের মানুষ প্রযুক্তির সুফল থেকে বঞ্চিত হবে। মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠানগুলো দূর করে ইন্টারনেট সেবা সহজলভ্য করা প্রয়োজন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়েও ইন্টারনেট সংযোগ অব্যাহত রাখতে স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি।

বাংলাদেশের আইটি খাতের একটি বড় সুযোগ হলো গ্লোবাল টেকনোলজি মার্কেটে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করা। দেশীয় কোম্পানিগুলো বিদেশি প্রকল্পে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করেছে। যেমন, ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবস্থাপনা, ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট সিস্টেম। এ ধরনের প্রকল্প আন্তর্জাতিক বাজারে সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। অনুন্নত দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে এসব প্রকল্পে কাজ করলে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর অভিজ্ঞতা বাড়বে এবং বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।

অবশেষে, আইটি খাতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিয়ে দক্ষতা উন্নয়ন, গবেষণা প্রণোদনা, এবং টেকসই প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। সরকারের যথাযথ সহযোগিতা এবং নাগরিকদের ডিজিটাল দক্ষতা উন্নয়ন ছাড়া এই খাতের সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব নয়। বাংলাদেশের আইটি খাতকে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত করতে এখনই সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।