সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

কীভাবে জলবায়ু সংকট আমাদের ভবিষ্যতকে বিপদে ফেলছে?

বিশেষ সম্পাদকীয়

প্রকাশিতঃ ১৫ নভেম্বর ২০২৪ | ৭:৫৫ অপরাহ্ন


নজরুল কবির দীপু : বিশ্ব আজ এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব, পৃথিবীর পরিবেশের প্রতি অবহেলা এবং মানব সভ্যতার জন্য ক্রমাগত বাড়তে থাকা ঝুঁকি আমাদের সামনে এক কঠিন বাস্তবতা উপস্থাপন করছে। পৃথিবীর উপর এক নতুন ধরনের চাপ তৈরি হচ্ছে, যার মোকাবিলা করতে হলে আমাদের জীবনধারা, নীতি ও মনোভাবের ভিত্তিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার। এই কঠিন সময়ে, আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন একজন সাহসী পথপ্রদর্শক, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে (কপ২৯) তাঁর ভাষণে এক নতুন পৃথিবী গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

ড. ইউনূস তাঁর ভাষণে পৃথিবীকে রক্ষার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন নিঃসরণ’ ভিত্তিক একটি নতুন জীবনধারার কথা তুলে ধরেন, যা আমাদের জীবনযাপন, অর্থনীতি, শক্তির ব্যবহার, এবং পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা পুনরায় বিবেচনার জন্য একটি সুযোগ হতে পারে। তার ‘তিন শূন্য’ ধারণা কেবল একটি পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি মানবতা এবং সভ্যতার জন্য একটি গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ড. ইউনূস বলেন, আমাদের ভবিষ্যত নির্ভর করছে কীভাবে আমরা পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাত্রা গড়ে তুলি। তিনি বলছেন, ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন নিঃসরণ’ ভিত্তিক জীবনধারা আমাদের জন্য জরুরি। এখানে মূল বিষয় হলো, আমাদের নিত্যব্যবহারের সকল পণ্য যেন আমাদের পরিবেশে কোনো প্রভাব না ফেলে এবং কোন অতিরিক্ত বর্জ্য তৈরি না হয়। এটি কেবল একটি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নয়, বরং একটি সামাজিক আন্দোলন হতে পারে, যা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে পারে। যেখানে আমরা অতিরিক্ত ভোগ ও অপচয় পরিহার করবো এবং শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় উপকরণের দিকে মনোযোগ দেবো।

শূন্য বর্জ্য ধারণা মানুষকে শিখায় যে, প্রতিটি উপকরণ বা পণ্যকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য হতে হবে এবং কোনো কিছু অপচয় হতে দেবো না। আমরা যে পণ্য ব্যবহার করি, তার প্রতিটি দিক আমাদের জীবনে যথার্থভাবে আসতে হবে, যাতে সেগুলো আমাদের পরিবেশে কোনো ক্ষতি না করে। এর পাশাপাশি, শূন্য কার্বন নিঃসরণ বা ‘নেট জিরো’ ধারণা আমাদের পরিবেশবান্ধব শক্তি ব্যবহারের প্রতি প্রতিশ্রুতি দেয়। এতে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে, শুধুমাত্র পুনঃনবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।

এভাবে, আমরা যদি ‘তিন শূন্য’ ভিত্তিক জীবনধারা গ্রহণ করি, তবে এটি কেবল পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক হবে না, বরং আমাদের অর্থনীতি, শিল্প এবং সামাজিক কাঠামোও পুনর্গঠন করবে। একটি পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি তৈরি করতে, পুনঃনবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার এবং পরিবেশসম্মত উৎপাদন প্রক্রিয়া খুঁজে বের করা জরুরি।

বর্তমানে জলবায়ু সংকট মানব সভ্যতার জন্য এক মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা কোন ধরনের একক দেশ বা জাতির সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলছে। আর এর জন্য একমাত্র দায়ী হলো আমাদের বুদ্ধিহীন জীবনযাত্রা এবং অতি ভোগবাদী সংস্কৃতি। ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা যে জীবনধারা বেছে নিয়েছি, তা পরিবেশের বিপক্ষে কাজ করছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যদি পরিবেশের উপর চাপ তৈরি করি, তবে এটি আমাদের ভবিষ্যতকে সংকটাপন্ন করে তুলবে।’ আজকাল মানুষ অতিরিক্ত ভোগের দিকে ঝুঁকেছে এবং সেই কারণে পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা কমে যাচ্ছে। পৃথিবী আজ বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে, আর সে জন্য আমাদের এই ‘আত্মবিধ্বংসী মূল্যবোধ’ থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

আমাদের যেভাবে জীবনযাপন করার প্রবণতা বাড়ছে, তা জলবায়ু সংকটের এক প্রধান কারণ। আমরা যে বিপুল পরিমাণে খাওয়া, পিতা-মাতা, বাচ্চা, কর্মসংস্থান এবং অন্যান্য চাহিদার জন্য অতিরিক্ত উৎপাদন ও ভোগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, তা শুধু পরিবেশের ক্ষতি করছে, বরং আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনছে। সুতরাং, আমাদের এই আত্মবিধ্বংসী জীবনধারা পরিহার করতে হবে এবং পরিবেশ সম্মত একটি জীবনযাত্রা তৈরি করতে হবে, যেখানে অতিরিক্ত ভোগবাদিতা থাকবে না।

বিশ্ব জলবায়ু সংকটের মূল কারণ হিসেবে শিল্পোন্নত দেশগুলোর অবহেলাকেই দায়ী করা হয়। এটি এমন একটি সংকট যা এককভাবে কোনো দেশই মোকাবিলা করতে পারবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর উপর। বিশেষত, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে দুর্যোগের প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ড. ইউনূস ঠিকই বলেছেন, ‘শিল্পোন্নত দেশগুলোর অবশ্যই স্বীকার করতে হবে তাদের দায়বদ্ধতা এবং তারা যে ভোগবাদী জীবনযাত্রার মাধ্যমে পৃথিবীকে সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে, তার জন্য তাদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।’

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তারা জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় অর্থ সরবরাহ করবে, তবে বাস্তবে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হতে দেখা যায়নি। যদি তারা এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না করে, তবে সংকট আরো তীব্র হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেগুলোই, যারা কিছুই পরিবর্তন করতে সক্ষম নয়। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য উন্নত দেশগুলোর সহায়তা অত্যন্ত জরুরি, এবং তাদের বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।

জলবায়ু সংকট কোনো একক দেশের সমস্যা নয়, এটি বিশ্বব্যাপী একটি সংকট, যার সমাধানে একসঙ্গে কাজ করা জরুরি। এ বিষয়ে একমাত্র অর্থ বরাদ্দ করলেই হবে না, বিশ্বের প্রতিটি দেশ, সরকার, সংগঠন এবং নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। জলবায়ু সংকটের মোকাবিলায় যে পরিকল্পনা করা হবে, তার বাস্তবায়নে আন্তরিকতা এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। জলবায়ু সংকটের সঠিক সমাধান করতে, দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা এবং সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

এখন সময় এসেছে, আমরা যে জীবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, তার পুনর্বিবেচনা করার। জলবায়ু পরিবর্তন আর বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত সংকট আমাদের সামনে একটি স্পষ্ট চ্যালেঞ্জ রেখে যাচ্ছে। এর মোকাবিলা করতে হলে আমাদের জীবনধারা পরিবর্তন করতে হবে এবং আরও দায়িত্বশীলভাবে পরিবেশের দিকে তাকাতে হবে। ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন নিঃসরণ’ ভিত্তিক জীবনধারা গ্রহণ করে, একটি নতুন পৃথিবী গড়ে তোলার আহ্বানই আজকের সময়ের সবচেয়ে জরুরি বার্তা। মানবতার বাঁচার পথ এভাবেই খোঁজা সম্ভব, যেখানে একত্রিত হয়ে কাজ করব এবং একটি শূন্য-বর্জ্য, শূন্য-কার্বন পৃথিবী গড়তে আমরা এগিয়ে যাব।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।