শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

সারা দেশে সহিংসতা ঘিরে মামলার সুনামি, অজ্ঞাতনামা আসামি প্রায় দুই লাখ

প্রকাশিতঃ ১৪ অক্টোবর ২০২৪ | ৯:৫২ পূর্বাহ্ন


ঢাকা : জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও পরবর্তী বিভিন্ন বিক্ষোভ, সংঘর্ষের ঘটনায় সারা দেশে মামলা হয়েছে অন্তত ৫০৬টি। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যমতে, এসব মামলায় নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে ৪৫ হাজার ৫৪৭ জনকে, আর অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৭৯০ জনে।

বিভিন্ন থানার হত্যা মামলার এজাহার পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিপুলসংখ্যক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। চট্টগ্রামের একটি মামলায় সর্বোচ্চ ৪০ হাজার অজ্ঞাতনামা আসামির উল্লেখ রয়েছে।

মানবাধিকারকর্মীরা অজ্ঞাতনামা আসামির বিপুল সংখ্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের আশঙ্কা, এ ধরনের মামলায় সাধারণ মানুষ ও ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক কর্মীরা হয়রানির শিকার হতে পারেন।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের মো. নূর খান লিটন বলেন, “মামলাগুলোর আসামির সংখ্যা ও নামের ফিরিস্তি দেখে মনে হচ্ছে, আমরা আগের স্বৈরশাসনের সময়কার অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি।”

পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিরপরাধ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র এআইজি ইনামুল হক সাগর বলেন, “অভিযোগ দেওয়ার সময় শুধুমাত্র অভিযুক্তদের নামই দেওয়া হয়। তদন্তের সময় পুলিশ সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে কাজ করে।”

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা গত ১ জুলাই আন্দোলন শুরু করে। গঠিত হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামের প্ল্যাটফর্ম। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে হামলা ও সহিংসতা শুরু হয়। জনতাও শিক্ষার্থীদের সমর্থনে রাস্তায় নামে।

আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান।

এরপরও সহিংসতা অব্যাহত থাকে। বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনও বিভিন্ন দাবিতে রাস্তায় নামে। আনসার সদস্যরা সচিবালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন, যেখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় ১৩ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়।

এ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে আসামি করে ২২০টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ১৮৮টি মামলায় হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগও দায়ের হয়েছে।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগস্ট মাসে ২৬৮টি মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫৫৫ জনকে এবং নাম উল্লেখ করা আসামির সংখ্যা ২৬ হাজার ২৬৪। সেপ্টেম্বর মাসে ২৩৮টি মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ৩০ হাজার ২৩৫ জনকে এবং নাম উল্লেখ করা আসামির সংখ্যা ১৯ হাজার ২৮৩।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৯৫টি মামলা হয়েছে, যেখানে অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলেন, “যেভাবে ফ্যাসিস্ট শাসনামলে পুলিশ মামলা করেছে, এখনো একইভাবে চলছে। আমি ঢালাওভাবে আসামি করা সমর্থন করি না।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি বলেন, “উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যারা যখন ক্ষমতা পেয়েছেন, তারা তাদের মতো করে মামলা করেছেন। এতে করে পুলিশের হয়রানি ও ঘুষবাণিজ্যের সুযোগ বেড়েছে।”

আইনজীবীরা মনে করছেন, এত বিপুলসংখ্যক অজ্ঞাতনামা আসামি থাকার কারণে তদন্ত প্রক্রিয়ায় জটিলতা বাড়বে এবং অভিযোগ প্রমাণ করতে সমস্যা হবে।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, “এ ধরনের মামলা হাস্যরসের জন্ম দেবে এবং মানুষের আস্থা থাকবে না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা হওয়া উচিত।”