একুশে প্রতিবেদক : সেপ্টেম্বর মাসে দেশের সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেপ্টেম্বরে দেশের সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা আগস্ট মাসের তুলনায় কিছুটা কম। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনও দুই অংকের ঘরেই রয়েছে, যদিও তা দশমিক ৯৬ শতাংশীয় পয়েন্ট হ্রাস পেয়ে এসেছে। অন্যদিকে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি দশমিক ২৪ শতাংশ কমে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশে নেমেছে।
বিবিএসের সিপিআই (ভোক্তা মূল্যসূচক) প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও সাধারণ জনগণের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখনও চড়া। বাজারে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম কমার পরিবর্তে উল্টো বেড়েছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে ডিম, মুরগি, চাল, আলু, তেল এবং চিনির দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, গত মাসের শেষ দিকে ডিমের হালি ৫৩ টাকা থেকে বেড়ে ৫৬ টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা প্রায় ৮ শতাংশ বৃদ্ধি নির্দেশ করে। একইভাবে, ব্রয়লার মুরগির কেজির দাম ১৭০-১৮৫ টাকায় উঠেছে, যেখানে আগস্টে তা ছিল ১৫৫-১৭০ টাকার মধ্যে।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। সেপ্টেম্বরে গ্রামাঞ্চলে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ১৫ শতাংশ, যেখানে শহরাঞ্চলে তা ছিল ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এতে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, গ্রামাঞ্চলের মানুষ নিত্যপণ্য কেনাকাটায় বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় গ্রামের মানুষকে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি কমলেও বাজারে পণ্যের দাম কমেনি, যা একটি পদ্ধতিগত সমস্যার ইঙ্গিত বহন করে। অর্থনীতিবিদ ড. এ কে এনামুল হক বলেন, “বাজারে পণ্যের দাম না কমলেও বিবিএসের মূল্যস্ফীতি কমার তথ্য আসছে। এতে পদ্ধতিগত কোনো সমস্যা থাকতে পারে। এ পরিস্থিতি মনিটরিং করার জন্য একটি স্বাধীন কমিটি থাকা উচিত, যা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে।”
বাজারে সিন্ডিকেটের সক্রিয়তা এবং দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলমের মতে, “সম্প্রতি পূর্বাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের বন্যার কারণে উৎপাদন কিছুটা কমেছে, ফলে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। আমন ধানের উৎপাদন ২৪ লাখ টন কম হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা বাজারে চালের দামে প্রভাব ফেলছে।”
এছাড়া, পণ্যের আমদানি প্রক্রিয়ায় নানা জটিলতার সুযোগ নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে কিছু পণ্য আমদানি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বাজারে তাদের মূল্য বেড়েছে। চাল, ডিম, মুরগি, আলু ও মাছের দাম আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা আশা করছেন, আসন্ন রবি মৌসুমে ভালো উৎপাদন হলে খাদ্যপণ্যের দাম কিছুটা কমতে পারে।
দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বিবিএসের মূল্যস্ফীতি পরিসংখ্যানকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না। বিবিএসের এক জরিপে উঠে এসেছে যে ৩৩ দশমিক ১৬ শতাংশ ব্যবহারকারী বিবিএসের মূল্যস্ফীতির তথ্যকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না, আর ২৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন এ সংক্রান্ত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা কম।
বিশ্লেষকরা এ বিষয়ে আরও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য একটি স্বাধীন কমিশনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। পরিসংখ্যান বিশেষজ্ঞ জিয়া হাসান বলেন, “মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধির তথ্য যাচাই করার জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা উচিত, যাতে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সঠিকভাবে মনিটর করা যায়।”
সেপ্টেম্বরে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও বাসাবাড়ির খরচ, পরিবহন খরচ, এবং জ্বালানি খরচ বাড়ছে। ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের দাম সেপ্টেম্বর মাসে ১ হাজার ৪২১ টাকা থেকে বেড়ে ১ হাজার ৪৫৬ টাকায় উঠেছে, যা গত পাঁচ মাসে পাঁচ দফায় মোট ৯৩ টাকা বেড়েছে। এছাড়া, জ্বালানি গ্যাস, পানি, ও বাড়ি ভাড়ার খরচও ক্রমাগত বাড়ছে, যা সাধারণ জনগণের জন্য অতিরিক্ত আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে।
সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং অন্যান্য খরচের কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজারে সিন্ডিকেট ও দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে নিত্যপণ্যের দাম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মনে করা হচ্ছে, তবে আসন্ন রবি মৌসুমের ভালো উৎপাদনের মাধ্যমে বাজারে কিছুটা স্বস্তি ফিরতে পারে।