ঢাকা : ক্ষমতায় থাকাকালে বাছবিচার না করে একের পর এক বিদেশি ঋণ নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে দেশে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১০৩ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন (১০ হাজার ৩৭৯ কোটি) ডলারে পৌঁছেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে) ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ওই সময় অর্থাৎ ২০০৮-০৯ সাল শেষে সরকারের বিদেশি ঋণ ছিল ৫০ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। ১৫ বছর ৮ মাসের ব্যবধানে বিদেশি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আর শুধু শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৫৩ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার।
সরকারি খাতের বিদেশি ঋণের মধ্যে সরকারের নিজস্ব, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সরকারি সংস্থার ঋণ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের জুন শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১০৩ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ। এর মধ্যে ৮৩.২১ বিলিয়ন (৯ লাখ ৯৮ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা) সরকারের নেওয়া। বাকি ২০.৫৭ বিলিয়ন ডলার বেসরকারি খাতের দায়। বেশি হারে সুদ ও কঠিন শর্তে নেওয়া এসব ঋণ সরকারি সংস্থাগুলোর দেওয়া পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে চাপে পড়ছে মানুষ।
চলতি বছরের জুন শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০৪ বিলিয়ন বা ১০ হাজার ৩৭৯ কোটি ডলার। চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে সরকার ও বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৯৯ দশমিক ৩০ বিলিয়ন (৯ হাজার ৯৩ কোটি) ডলার। অর্থাৎ তিন মাসেই প্রায় ৪ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ নিয়েছে সরকার।
বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সাবেক সরকারের দায়িত্বহীন ঋণ ব্যবস্থাপনার কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎসের তুলনায় বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশি ঋণ গ্রহণকে সাধারণত ইতিবাচক হিসেবে দেখেন, তবে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করেছে তা মূলত দর-কষাকষি ও যথাযথ বিচার-বিশ্লেষণ ব্যতীত হয়েছে, যা সরকারের ঋণ পরিশোধের চাপকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
অর্থনীতিবিদরা উল্লেখ করেন যে, করোনা মহামারি পরবর্তী বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে মার্কিন সুদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে বৈদেশিক ঋণের সুদের হারও বেড়ে গেছে। একইসাথে, দেশীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা যারা বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করেছিল তারাও সমস্যায় পড়েছে। এর ফলে তারা নতুন ঋণ গ্রহণের পরিবর্তে বিদ্যমান ঋণ পরিশোধের দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়। তবে সম্প্রতি ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল হওয়া এবং দেশীয় ঋণের সুদের হার বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ীরা আবারও বৈদেশিক ঋণের দিকে ঝুঁকছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম ব্যয়বহুল মেগা প্রকল্প, সাবেক সরকারের ঋণের অপব্যবহার এবং পুঁজি পাচারের সমস্যা তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে পদ্মা সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল এবং মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন, এই প্রকল্পগুলো থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে ঋণের কিস্তির সামান্য অংশও পরিশোধ করা সম্ভব হবে না।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের একটি বড় অংশ এখন ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট’। এই ধরনের ঋণের অসুবিধা হলো, সরবরাহকারীরা প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম সরবরাহের সময় আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দাম ধরে, যার ফলে ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়। এর চেয়েও গুরুতর সমস্যা হলো, সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার এবং আমলাদের ‘মার্জিন’ বা লাভের পরিমাণ অনেক বেশি হয়। ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
এই সমস্যাগুলোর সমাধানে সরকারকে দুর্নীতি, পুঁজি পাচার এবং পুঁজিবাজারের অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে মনে করেন ড. মইনুল ইসলাম। তিনি বিশেষভাবে হুন্ডি ব্যবস্থা দমনের উপর জোর দেন, কারণ হুন্ডির মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ আমলা, রাজনীতিবিদ এবং ব্যাংক ঋণখেলাপিরাই বৈদেশিক মুদ্রা কেনার চাহিদার বড় অংশ তৈরি করে। তিনি মনে করেন, কঠোরভাবে দুর্নীতি দমন ব্যতীত পুঁজি পাচার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।