চট্টগ্রাম: লোকাল বাসের ঘড়ি চোর হিসেবে শুরু; পরে সেখান থেকে চোরদের সর্দার বনে যান। এরপর মাদক পাচার করতে নেমে একসময় নিজেও বিক্রেতা হয়ে উঠেন। পরবর্তীতে নিয়ন্ত্রণ নেন চট্টগ্রামের রেল স্টেশন ও বরিশাল কলোনি কেন্দ্রিক ইয়াবা ও মাদক স্পটগুলোর। কেবল চট্টগ্রামে নয়; মিয়ানমার ও ভারত থেকে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও হেরোইন এনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করতেন তিনি।
চট্টগ্রামের মাদক ব্যবসার অন্যতম নিয়ন্ত্রক এই ফারুক হোসেন অপরাধ জগতে বস ফারুক, কালা ফারুক, বাইট্টা ফারুক ও বিচ্ছু ফারুক নামে পরিচিত।বৃহস্পতিবার গভীর রাতে নগরীর আইস ফ্যাক্টরি রোড বরিশাল কলোনি এলাকায় র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ফারুক। তার বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন থানায় মাদক আইনে ১৮টিরও বেশি মামলা আছে।
র্যাবের তথ্য মতে, সম্প্রতি বাংলাদেশে গন্ধহীন হলুদ ইয়াবার যেসব চালান পাওয়া সেগুলো ফারুকই প্রথম চট্টগ্রামে নিয়ে আসে। এছাড়া মিয়ানমার ও ভারত থেকে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও হেরোইন এবং সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে মাদক পাচার করে ফারুক। র্যাবের অভিযানে গত ২৩ জুন ১৫ লাখ ইয়াবা ও ১৬ সেপ্টেম্বর উদ্ধারকৃত ১০ হাজার হলুদ ইয়াবার মূল মালিক ফারুক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, পটিয়ার ছেলে ফারুক ২০০০ সালের দিকে চট্টগ্রাম নগরে আসে। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ফারুক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি না পেরুতেই তার অপরাধে হাতেখড়ি। সে সময় স্টেশন রোড়ে যাত্রীদের ভিড়ে ছোঁ মেরে হাত ঘড়ি ছিনিয়ে নিতো সে।
পরে চুরি-ছিনতাই ছেড়ে ফারুক চোরাই পণ্য কেনা-বেচা শুরু করে। তার অধীনে থাকা চোরের দল ঘড়ি, মানিব্যাগ নিয়ে জমা দিত ফারুকের কাছে। ২০০২ সালের দিকে ফারুক ঘড়ি চোরদের লালন পালন ছেড়ে যোগ দেয় রেল স্টেশন ভিত্তিক মাদক সিন্ডিকেটে।
সেসময় ফারুকের বন্ধু কালা বাদলের বড় ভাই সোহেল গার্মেন্টসে চাকরি করতো। সেখানে চাকরি করতো মনির। বাদলের সূত্র ধরে স্টেশনের সিন্ডিকেটে আড্ডা দিতে আসতো মনির। এরপর তাকে পার্টনার হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয় সিন্ডিকেট থেকে। লুফে নেয় মনির।
এরপর ইউসুফের নেতৃত্বে ফারুক ও মনিরের পরিচালনায় বরিশাল কলোনির মাদক ব্যবসা চলছিল জমজমাট। কিন্তু হঠাৎ করেই ইউসুফকে সরিয়ে দিতে চায় মনির। এতে ফারুক সম্মতি না দিলে দুজনের মধ্যে বিরোধ শুরু। পাল্টাপাল্টি মাদক স্পটের নিয়ন্ত্রণ নেয় মনির-হোন্ডা বাহার সিন্ডিকেট ও ফারুক-ইউসুফ সিন্ডিকেট।
এরইমধ্যে ফারুকদের হামলায় হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় হোন্ডা বাহারের। এরপর বিরোধ থাকায় দুইপক্ষের শক্তিক্ষয় হচ্ছে ভেবে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে অাবার মাদক ব্যবসা চালায়। ২০১৫ সালের দিকে পটিয়ায় ফারুককে মারতে গিয়ে নিখোঁজ হন মনির।
এরপর থেকে চট্টগ্রামের রেল স্টেশন ও বরিশাল কলোনি কেন্দ্রিক ইয়াবা ও মাদক স্পটগুলোতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে ফারুক ও ইউসুফ সিন্ডিকেট। তাদের অন্যতম সহযোগি হিসেবে আছে আসলাম, পাভেল, মনির, শরীফ, বিপ্লব, বিলাই মনির, কাশেম, জামাল, পলাশ, রুবেল, সোসাইটি মনির, সুমন ও জাফর প্রমুখ।
অভিযোগ আছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু কর্মকর্তাদের মাসিক মাসোহারা দিয়ে আসছিল ফারুক ও ইউসুফের সিন্ডিকেট। যার কারণে অভিযানের খবর আগেই ফাঁস হয়ে যেত। বরিশাল কলোনীতে অভিযানে গেলে পরিত্যক্ত মাদক ছাড়া কেউ গ্রেফতার হতো না। এভাবেই বার বার গ্রেফতার এড়িয়ে আসছিল তারা। এমনকি হাতকড়া পরানো আসামিকেও ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে বরিশাল কলোনীতে।
সদরঘাট থানার ওসি মর্জিনা আক্তার বলেন, গত ১ মে বরিশাল কলোনীতে অভিযান চালিয়ে খসরু নামের এক মাদক বিক্রেতাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সে সময় দুইশ থেকে আড়াইশ লোক পুলিশের উপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এসময় হাতকড়াসহ পালিয়ে যায় খসরু। ওই অভিযানে ১০৫ ইয়াবা, ৯৫ বোতল ফেনসিডিল ও মাদক বিক্রির দুই লাখ ৩১ হাজার টাকা উদ্ধার হয়।
এদিকে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ফারুক নিহত হলেও এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শীর্ষ মাদক কারবারি ইউসুফ। ইউসুফের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় কমপক্ষে ১৮টি মামলা আছে; এছাড়া সীতাকুন্ড থানার একটি মামলায় তার কারাদন্ড হয়েছে।
সিআইডি সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে মাদক ব্যবসার মাধ্যমে ইউসুফ দেড়শ কোটি টাকার মালিক হওয়ার তথ্য দিয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউসুফের সম্পদের পরিমাণ পাঁচশ কোটিরও বেশী হবে।
র্যাব-৭ চট্টগ্রামের সিনিয়র সহকারি পরিচালক মিমতানুর রহমান বলেন, বন্দুকযুদ্ধে নিহত ফারুক হোসেন ছিলেন আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারি। তার অন্য সহযোগিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।