রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

ঝলমলে আলোর আড়ালে অন্ধকারের ছায়া

প্রকাশিতঃ ২৫ জুন ২০২৪ | ১:০১ অপরাহ্ন

শরীফুল রুকন : চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণ হালিশহরের জুয়েলারি দোকান ‘রেশমি গোল্ড’ কিছুদিন আগেও আলো ঝলমলে ছিল। কিন্তু পুঁজি হারিয়ে দোকানটি এখন বন্ধ। দীর্ঘদিন ধরে চলা ব্যবসা গুটিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেছেন জুয়েলারি দোকানটির মালিক রণজিত কুমার ধর।

মুঠোফোনে রণজিত বলেন, ‘স্বর্ণের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। লোকসানের বোঝা আর বহন করতে পারছিলাম না, তাই দোকান বন্ধ করে গ্রামের বাড়ি চলে এসেছি।’

শুধু রেশমি গোল্ড নয়, চট্টগ্রাম নগরে অন্তত ৮টি জুয়েলারি দোকান বন্ধ হয়ে গেছে ২০২৩ সালের জুলাই মাসের পর থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে। এই তথ্য রয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স এসোসিয়েশনের (বাজুস) চট্টগ্রাম কার্যালয়ের কাছে।

দোকানগুলোর নাম হচ্ছে- চট্টগ্রাম নগরের নতুন ফিশারীঘাটের মা জুয়েলার্স, কাজীর হাটের মডার্ন মিন্টু রাণী জুয়েলার্স, দক্ষিণ হালিশহর বড়পোলের রেশমি গোল্ড, লালখান বাজারের মা জুয়েলার্স, সিডিএ মার্কেটের অঞ্জলী জুয়েলার্স, নিউ মনসুরাবাদের এন.কে জুয়েলার্স, বায়েজিদের মোহাম্মদনগরের পূর্ণ জুয়েলার্স ও আমিন জুট মিলের প্রভা জুয়েলার্স।

বাজুস চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রণব সাহা বলেন, ‘বর্তমানে ছোট আকারের জুয়েলারি দোকানগুলোতে ব্যবসা নেই বললেই চলে। আমাদের কাছে তথ্য আছে, পুঁজি হারিয়ে ও ঋণগ্রস্ত হয়ে চট্টগ্রাম নগরের আটটি জুয়েলারি দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। এর বাইরে আরও দোকান বন্ধ হতে পারে, যে খবর হয়তো আমাদের অফিসে আসেনি।’

পুঁজি হারিয়ে ফেলার কারণে আরও কিছু দোকান বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘জুয়েলারি শিল্পে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু এখন অনেকেই চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন। জুয়েলারি শিল্পের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। সরকার জুয়েলারি শিল্পের উন্নয়নের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এসব পদক্ষেপ পর্যাপ্ত নয়।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঐতিহ্যবাহী জুয়েলারি শিল্প এখন ধুঁকছে। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোট জুয়েলারি দোকানগুলো। ব্যবসায়ীরা হতাশায় ভুগছেন, অনেকেই পুঁজি হারিয়ে বসেছেন।

জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের দাবি, স্বর্ণের দাম বৃদ্ধি, বাজারে অস্থিরতা, ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস, দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থা, ব্যাংক ঋণের জটিল প্রক্রিয়া, করের বোঝা ভারী হওয়া- এসব কারণে তাদের বেচাকেনা কমে গেছে। ফলে লোকসান বেড়েছে এবং কিছু ব্যবসায়ী দোকান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

চট্টগ্রাম নগরের রাহাত্তারপুল এলাকার এন.কে জুয়েলার্স এর মালিক টুটুল তালুকদার বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে স্বর্ণের দাম বারবার ওঠানামা করছে। অনিশ্চিত বাজারে ক্রেতারা স্বর্ণ কেনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে স্বর্ণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে তারা স্বর্ণের অলংকার কেনার পরিবর্তে অন্যান্য জিনিসপত্র কেনার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন।’

এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় অনেকের আয় কমে গেছে। ফলে, তারা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্যও টাকা খরচ করতে পারছে না, তাই জুয়েলারি কেনার মতো বিলাসবহুল জিনিস কেনার কথা ভাবতেই পারছেন না।

চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা খালেদা আক্তার বলেন, ‘বর্তমানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে আমার পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার পর আমাদের হাতে তেমন টাকা থাকে না, যা আমরা জুয়েলারি কেনার জন্য খরচ করতে পারি।’

চকবাজার এলাকার বাসিন্দা উম্মে কুলসুম বলেন, ‘অনেক জুয়েলারি দোকানে একই রকম নকশার জুয়েলারি বিক্রি করা হয়। নতুন ও আকর্ষণীয় নকশার অভাব ক্রেতাদের আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে। কিছু অসৎ ব্যবসায়ী কম মানের জুয়েলারি বিক্রি করে ক্রেতাদের বিশ্বাস ভাঙছেন। ফলে অনেক ক্রেতা এখন জুয়েলারি কেনার ক্ষেত্রে সতর্ক হয়ে যাচ্ছেন।’

বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্যাক্সেশনের চেয়ারম্যান ও কার্যনির্বাহী সদস্য আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে জুয়েলারি তৈরির খরচও বেড়েছে। ফলে বাজারে জুয়েলারির দামও বেড়েছে। ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়াসহ নানা কারণে বেচাকেনা কমে গেছে। স্বর্ণ কারিগররা দু:খ-দুর্দশায় জীবন-যাপন করছেন। কিছু কারিগর পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।’

বাজুস সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের জুয়েলারি শিল্পে ২ থেকে ৩ লাখ কারিগর এবং বিপুলসংখ্যক শ্রমিক কাজ করেন। ২০২০ সালে বাংলাদেশে স্বর্ণের অলংকার, স্বর্ণের বার এবং রৌপ্য বিক্রি ছিল ২ হাজার ৮৫৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার; যা ২০৩০ সালে ২১ হাজার ৯৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বিপরীতে, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী জুয়েলারি বাজারের মূল্য ছিল ২১৬ দশমিক 8৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০২৩ সালে এ বাজার ২২৪ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০৮ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হবে বলে অনুমান করা হয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘উৎকৃষ্টমানের স্বর্ণের অলংকার ও জুয়েলারি উৎপাদক হিসেবে বাংলাদেশের কারিগরদের দীর্ঘ সুনাম রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে জুয়েলারি শিল্প এখনও কাঙ্ক্ষিত সম্ভাবনায় বিকশিত হয়নি৷’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশে ব্যবসার জন্য স্বর্ণ সংগ্রহে অসুবিধা রয়েছে। আর্থিক ও নীতি সহায়তার অভাব রয়েছে। এবং প্রযুক্তি, উৎপাদনপ্রক্রিয়া, জুয়েলারি পণ্যের নকশা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে ধীরগতি আছে। এই সমস্যাগুলো দূর করতে হবে। শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের দিকে চেয়ে থাকলে হবে না, প্রাণবন্ত জুয়েলারি খাত নিশ্চিত করার জন্য রপ্তানি বাজার খোঁজা অপরিহার্য। তবেই মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি দেশের ক্রমবর্ধমান শ্রমশক্তির উপযুক্ত কর্মসংস্থান হবে।’

২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট রপ্তানি করেছে ৫২ দশমিক 8৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; যার ৮৫ শতাংশ এসেছে তৈরি পোশাকশিল্প থেকে৷ অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ৮৯ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; যার ৩৩ শতাংশ ব্যয় হয়েছে সুতা, কাপড়, এলএনজি, লেদারসহ ৯টি পণ্যের দাম পরিশোধের আওতায় অর্থাৎ আমাদের রপ্তানি খাত সম্পূর্ণভাবে তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর নির্ভরশীল।

একটি পণ্যভিত্তিক রপ্তানি খাত যে কোনো দেশের জন্য ভয়ংকর ও হুমকিস্বরপ উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ বলেন, ‘সরকার ২০২৬ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের দরকার রপ্তানি বহুমুখীকরণ৷ এ রপ্তানি বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে স্বর্ণশিল্প হতে পারে সরকার ও নীতিনির্ধারকদের একটি নতুন হাতিয়ার। কারণ স্বর্ণের অলংকার ও পাকা স্বর্ণের ক্ষেত্রে প্রায় ২০-৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজন করা সম্ভব।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের যারা কারিগর রয়েছেন তাঁদের নিপুণ হাতে তৈরি অলংকারের চাহিদা প্রতিটি উন্নত দেশে রয়েছে৷ কিন্তু সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তাঁরা ভারতসহ অন্যান্য দেশে চলে গেছেন। ফলে উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা যে একটি বর্ধিষ্ণু স্বর্ণশিল্প পেয়েছিলাম, তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারিনি।

অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে স্বর্ণের আনুমানিক বার্ষিক চাহিদা ৪০-৭০ টন। কিন্তু এ শিল্পের প্রধান কাঁচামাল, যা পাকা স্বর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয় তা-ই অবৈধ বলে গণ্য হয়। এর জন্য দায়ী সরকারি নীতিনির্ধারকদের সঠিক দৃষ্টিশক্তির অভাব।’

স্বর্ণ আমদানি করে মূল্য সংযোজনের পর স্বর্ণের অলংকার রপ্তানি করার কৌশল বাংলাদেশ গ্রহণ করতে পারে মন্তব্য করে অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ বলেন, ‘চীন তাদের নিবন্ধনকৃত স্বর্ণের প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা প্রসেসিং জোন তৈরি করেছে। এ জোনের আওতায় যেসব প্রতিষ্ঠান স্বর্ণের অলংকার উৎপাদন ও রপ্তানি করবে, তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে স্বর্ণ আমদানির বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়। আমাদের দেশেও এরকম করা উচিত। অনেকেই মনে করেন স্বর্ণ আমদানির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা প্রদান করে থাকলে দেশের ডলার বাইরে চলে যাবে। কিন্তু এ স্বর্ণের অলংকার যখন আবার বিদেশে রপ্তানি করা হবে তখন ব্যয়কৃত ডলার উঠে আসবে৷’

রাষ্ট্রযন্ত্র ও নীতিনির্ধারকদের কাছে জুয়েলারি শিল্প অবহেলিত উল্লেখ করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘দেশে জুয়েলারি ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। এই শিল্পে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে অনেক দক্ষ কারিগর অন্যান্য দেশে চলে গিয়েছেন। অথচ ওইসব দেশে তাঁদের অভিজ্ঞতার উপযুক্ত সম্মান ও সম্মানি দেওয়া হয়। দক্ষ কারিগরের অভাবে আমাদের দেশে এই শিল্প নিজস্ব স্বকীয়তা হারাচ্ছে। জুয়েলারি শিল্প খাতকে আপাদমস্তক ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে৷ সেজন্য প্রয়োজন নীতিনির্ধারকদের আন্তরিকতা ও সহায়তা।’