রেহানা বেগম রানু
পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী এবং দরকষাকষির বিশ্বসভা একশত ছিয়ানব্বইটি দেশের সমন্বয়ে কনফারেন্স অব পার্টিস ২১ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ফ্রান্সের প্যারিসে। জাতিসংঘ আয়োজিত চলতি মাসের ত্রিশ তারিখে শুরু হয়ে ডিসেম্বরের এগার তারিখ পর্যন্ত চলতে থাকা এ বিশ্ব দরকষাকষি সভায় নির্ধারিত হবে-আগামী বিশ্ব পরিবেশ কী হবে। উষ্ণায়ন কোন দিকে মোড় নেবে। কার্বন নিঃসরণ কোন মাত্রায় থাকবে। সমুদ্রসহ বিশ্বের মূলধন পানি, বাতাস ও কেমন আয়ু পাবে। ওজোন স্তরের ভবিষ্যৎ কী হবে। পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বের ভবিষ্যৎ কোন কোন বাঁক অতিক্রম করবে।
২০২০ সালের পর উষ্ণায়নের অনুষঙ্গ ও কারণগুলো কোন মাত্রায়, কী ভাবে পৃথিবীকে বিড়ম্বিত করবে-তা নির্ধারিত হবে কপ-২১ এ।
বিশ্বের সাতশত পঁচিশ কোটি মানুষের এবং অসংখ্য প্রাণের জন্য একমাত্র গ্রহ পৃথিবী। পৃথিবীর বাতাস, পানি, মাটি, উদ্ভিদ, সবুজের সম্ভার পাহাড়, বৃক্ষ। বাস্তুতান্ত্রিকতার সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকা প্রাণ খাল, নদী, সাগর, জলাশয়, বিল-ঝিল। উষ্ণায়নের অস্থিরতায় পীড়িত দলিত এসব জীবসম্ভার পৃথিবীর প্রাণচাঞ্চল্যের আধার।
এসবের সুরক্ষার জন্য পৃথিবীতে কার্বন বিস্তরণ কমিয়ে আনতে হবে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায়। জীবাস্ম জ্বালানিসহ বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ড পৃথিবীকে কার্বনের দুর্বিষহ সাগরে নিমজ্জিত করছে। বাতাস ভারি হচ্ছে। সাগর অম্লীয় হয়ে যাচ্ছে। বাস্তুতান্ত্রিকতা উষ্ণায়নের পাগলা ঘোড়ার দাপটে দলিত নিষ্পেষিত হচ্ছে।
পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। মেরু অঞ্চলের জমাকৃত বরফ গলছে। সমুদ্রের উষ্ণতা ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে। আর্থ সামিট, কিয়োটো প্রটোকল, ডারবান, বালি, কোপেনহেগেন এর অমনোযোগিতা মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎকে অন্ধকারের হাতছানি দিচ্ছে। পৃথিবীর শিল্পোন্নত এবং উদীয়মান শিল্পের দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ-জনপদে মানবতার ভবিষ্যতের ভাবনার চেয়ে কার্বন নিঃসরণের প্রতিযোগিতা বহুগুণে বেড়ে গেছে। মানবতার ভবিষ্যৎ, জীবনের ভবিষ্যৎ মহা সংকটাপন্ন। যারা কিয়োটো প্রটোকলে স্বাক্ষর করেননি তারাও চিন্তাগ্রস্ত হচ্ছে প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে। সংকট-সভ্যতা মুখোমুখি। এমন প্রেক্ষিত ও পটভূমিকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কপ-২১, ফ্রান্সের প্যারিসে।
সবাই উপলব্ধি করছে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমাদের সাম্মিলিত ভবিষ্যৎ সংকটাপন্ন। অতীতে উন্নত দেশগুলোর চরম বিরোধিতায় কার্যত কপ সম্মেলনে যুৎসই ও টেকসই কোন চুক্তিতে আসা যায়নি। ক্ষীণ আলো জ্বালিয়ে রেখে ফ্রান্সের প্যারিসে বসতে যাচ্ছে জাতিসমূহের আপাত বৃহৎ এ সম্মিলনী কপ-২১। পৃথিবীর তাপমাত্রা কমাতে হবে। দেশে দেশে কার্বণ নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জীবনের বাসগৃহ পৃথিবীকে যৌথভাবে সুরক্ষিত করতে হবে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে শিল্পবিপ্লবের পূর্বাবস্থায় নিয়ে আসতে হবে।
গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে হবে। জলবায়ু সহনীয় প্রযুক্তিকে দেশে দেশে বিস্তৃত ও বিকশিত করতে এক সাথে কাজ করতে হবে। প্রত্যেক দেশকে তার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে কর্মসূচি উপস্থাপনের জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে।
ধরিত্রী সম্মেলনের পর প্রথম ঈঙচ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় বার্লিনে। এখন থেকে বিশ বছর আগে। এর পরে ১৯৯৭ সালেকপ – ৩ এর মধ্যদিয়ে কিয়োটো প্রটোকল গৃহিত হয়। এটিও ছিলো বিশ্ব পরিবেশ চেতনা সংরক্ষণের অন্যতম মাইল ফলক। এভাবে বিভিন্ন সংখ্যায় ঈঙচ – এর পথ ধরে ঈঙচ -১১ তে মন্ট্রিল একশন প্ল্যান উপস্থাপিত হয়। পরিবেশ সচেতনতা এপথ ধরে ভিত্তিভূমি পেতে থাকে ধাপে ধাপে।
কপ-১৫ তে বিশ্বের দেশসমূহ প্রবল আশা ও হিসাব নিকাশ করতে একত্রিত হয় কোপেনহেগেনে। এখানের এ সম্মেলন হতাশার দীর্ঘশ্বাসে ভরে ওঠে বিভিন্ন কারণে। কিয়োটো প্রটোকলের আইনগত বাধ্যবাধকতা তৈরিতে একমত হতে না পেরে বিভিন্ন পক্ষসমূহ আমাদের সন্তানদের সম্মিলিত ভবিষ্যৎকে হতাশায় ভরে দেয়। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের অনমনীয় অবস্থা কপ -১৫ কে অনিশ্চয়তায় ভরে তুলে।
গ্রিন ক্লাইমেন্ট ফান্ড নামের জলবায়ু তহবিল গঠনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয় কপ– ১৭ তে। ডারবানে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলন অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে দেয়। এভাবেই আশা নিরাশার দোলাচলে বিশ বছর।
বিশ্বের একশত পঁচানব্বইটি রাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সরকারি, আন্তসরকারের সংস্থা, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা, পরিবেশবাদী সংগঠন এবং সিভিল সোসাইটির সদস্যরা মিলে প্রায় পঞ্চশ হাজার মানুষের এ মিলন মেলা আমাদের স্বপ্নকে সুস্থ পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে ব্যস্ত থাকবে।
ঈঙচ -এর অবিচল ও অনড় অবস্থান এবং এর সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত লীমার চেতনা বিশ্ববাসীর জন্য আশা। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় ভিত্তি। বিশ বছরের অবিচল ঈঙচ প্যারিসে এসে সার্বজনীন একটি আইনগত ভিত্তিতে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াবে-এ প্রত্যাশা বিশ্বের উদ্বিগ্ন মানুষের।
পৃথিবীর মানুষের প্রত্যাশা বৈশ্বিক উষ্ণতার লাগাম টেনে ধরার। বৈশ্বিক উষ্ণতাকে ২ক্কঈ এর নীচে রেখে পৃথিবীকে উত্তপ্ত হওয়া থেকে সুরক্ষিত করার প্রত্যয় প্যারিসে অর্জিত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশের পরিবেশ সুরক্ষিত রাখতে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের কলেবর বৃদ্ধি পাবে। মানুষের প্রত্যাশা ও ঝুঁকিপূর্ণ সমৃদ্ধির স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। প্রাণের স্পন্দন, সবুজের স্নিগ্ধতায় ভরে যাওয়া প্রকৃতি জীবনের ছন্দকে আন্দোলিত করবে।
সাগর, নদী, পাহাড়, বাতাস, জীব বাস্তুতাতিন্ত্রকতা জলে, স্থলে, অন্তরিক্ষে প্রতিবেশের প্রতিটি স্তরে জীবনকে সুরক্ষিত করবে। জীবন হবে যার যার-প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান-সম্পদ সবার, কপ – ২১ এ প্রত্যাশাকে প্রাপ্তির কানায় কানায় ভরিয়ে দেবে। প্রতিটি জীবনের আগামী হবে সংশয়, সংকট, শংকামুক্ত। এ প্রত্যাশা আমাদের।