চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাসকে খুনের ঘটনা ‘পূর্ব পরিকল্পিত’ নয় বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা: ফেসবুকে ‘বাড়াবাড়ির’ পরিণামে মারধর করে সুদীপ্তকে ‘সতর্ক’ করতে চেয়েছিলেন দুর্বৃত্তরা; কিন্তু ‘দুর্ঘটনাবশত’ খুন হন সুদীপ্ত।
প্রাথমিক তদন্তে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সামনে এই তথ্যই উঠে এসেছে।
রাজনৈতিক নানা বিষয় নিয়ে সিটি কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছিলেন বিভক্ত। এ নিয়ে ফেসবুকে পাল্টাপাল্টি লিখে আসছিল দুই পক্ষ। এক পক্ষের কেউ ফেসবুকে ‘উসকানিমূলক’ পোস্ট দিলে সেখানে কমেন্ট করে অন্য পক্ষের কেউ কেউ। ফেসবুকে নানা স্ট্যাটাস দিয়ে ও কমেন্ট করে এ সংক্রান্ত আলোচনায় ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত বিশ্বাস। বিষয়টি ভালোভাবে নিতে পারেনি ছাত্রলীগের সিনিয়ররা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেন, ‘নগরের লালখান বাজার এলাকার বাসিন্দা এক আওয়ামী লীগ নেতার অনুসারীরা সুদীপ্ত হত্যায় জড়িত বলে তথ্য পেয়েছি আমরা। তবে এখনই কাউকে আটক করবে না পুলিশ। সব প্রমাণ হাতে নিয়ে তারপর গ্রেফতার করা হবে। ঘটনার সময় দুর্বৃত্তরা একটি মোটর সাইকেল ও একটি সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে ঘটনাস্থলে আসে ও পরে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলের অদূরে একটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ আমরা সংগ্রহ করেছি। সেখানে পালিয়ে যাওয়ার সময় এক যুবকের ছবিও ধরা পড়েছে।’
সূত্রটি আরও বলেন, ‘ঘটনাস্থলের অদূরে ইউসিবিএল ব্যাংকের সিসিটিভির ফুটেজ রোববার সংগ্রহ করবে পুলিশ। সেখান থেকে খুনিদের আরও স্পষ্ট ছবি পাওয়া যেতে পারে। এখন পর্যন্ত যে সব ফুটেজ পাওয়া গেছে তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এছাড়া ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে অবস্থানকারীদের মুঠোফোন নাম্বার শনাক্ত করে পরিচয় নিশ্চিতের কাজ চলছে।’
এদিকে সিটি কলেজ ছাত্রলীগের একাংশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন। নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারি হলেন সুজন। আর খুন হওয়া সুদীপ্ত বিশ্বাস ছিলেন এই পক্ষের অনুসারী। এছাড়া সংসদ সদস্য ডা. আফছারুল আমিনের অনুসারী একটি পক্ষ সক্রিয় আছে সিটি কলেজে; এই পক্ষটি নিয়ন্ত্রণ করেন আওয়ামী লীগ নেতা দিদারুল আলম মাসুম।
সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সর্বশেষ কমিটি হয় ২০১২ সালে। কোন্দলের কারণে কমিটি গঠন হয়নি এতদিন। সম্প্রতি কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলে সংসদ সদস্যের অনুসারীরা ও একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর কমিটিতে নিজেদের লোক আনতে মরিয়া হয়ে উঠেন। এসব বিষয় নিয়ে ফেসবুকে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয় সাম্প্রতিক সময়ে।
এদিকে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্তের ফেসবুক ওয়ালে গিয়ে দেখা গেছে, ৬ সেপ্টেম্বর সুদীপ্ত লিখেছেন, ‘প্রিয় নেতৃবৃন্দ, সিটি কলেজ ছাত্রসংসদ কমিটিটা খুব দরকার। আমার কোনো স্বার্থ নেই কিন্তু।’ ৪ অক্টোবর আরেক পোস্টে লিখেন, ‘প্রজা ছাড়া রাজার দাম যেমন নেই তেমনি কর্মী ছাড়া নেতারও দাম নেই। কর্মীদের বিদ্রোহ দরকার নতুন কিছু প্রাপ্তির জন্য।’ তার আগের দিন আরেক পোস্টে লিখেন ‘ওয়ান ইলেভেনে অনেককেই দেখি নাই রাজপথে.. ও সরি এটা বললে আবার অন্যায়…।’
২৮ সেপ্টেম্বর আরেক পোস্টে লিখেন ‘কলেজের বারান্দায় হাঁটেনি এমন পাবলিকও আজকাল মিছিল পরবর্তী সমাবেশের মঞ্চে উঠে। নোংরামি আর কতো?’ ১ অক্টোবর আরেক পোস্টে লিখেন- ‘রাজনীতি বড়ই জটিল জিনিস… একসময়কার কথিত ডাস্টবিন এখন ফুলের বাগানের সৌরভ ছড়াচ্ছে!’ আর ২৪ আগস্টের এক পোস্টে তিনি লিখেন, ‘২০১৭, আর কতো অকাল মৃত্যু চাও’। কাকতালীভাবে এই পোস্টের ৪৪ দিন পর সুদীপ্তও অকালে ‘দুর্বত্তের’ হাতে প্রাণ হারান। আর সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে লিখেন, ‘অপেক্ষায় রইলাম’। এর ঠিক ছয় থেকে সাত ঘন্টা পর খুন হতে হয় তাকে।
সুদীপ্তদের বাসা চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণ নালাপাড়া এলাকায়। গত শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে দুই যুবক বাসায় এসে সুদীপ্তকে জানান, তার এক বন্ধুর বাবা মারা গেছেন। খবরটি শুনেই তাদের সঙ্গে বেরিয়ে যান তিনি। এর ১০ মিনিট পর চিৎকার শুনে তার মা টিনের ঘরের বাসা থেকে বেরিয়ে গলির মুখে যান। বাসা থেকে ওই পথের দূরত্ব প্রায় ১০০ ফুট। সেখানে ছেলেকে রাস্তার পাশে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। পরে তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে বেলা সাড়ে ১১টায় তার মৃত্যু হয়।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, হামলার সময় সুদীপ্তের হাত বেধে ফেলেছিল দুর্বৃত্তরা। এরপর হাত-পা ভেঙে ফেলে। তার মাথার পেছনে আঘাতের ফলে ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়। তবে মাথার বাইরে তেমন ফেটে যায়নি। প্রাথমিক পর্যায়ে তার অবস্থা গুরুতর হিসেবেও মনে হয়নি স্বজনদের কাছে। মারধর করতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত মারা গেছে এমনটা ধারণা করা হচ্ছে। কারণ তার শরীরে ছুরিকাঘাতের কোন চিহ্ন নেই। মেরে ফেলার উদ্দেশ্য থাকলে ছুরিকাঘাত অথবা গুলি করতো। মাথার স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাতের পর চিকিৎসা পেতে দেরী হয়েছে তার। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার চিকিৎসা শুরু হয় সাড়ে ১০টার দিকে। সাড়ে ১১টার দিকে সুদীপ্ত মারা যাওয়ার আরও আধাঘন্টা পর মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ি থেকে সদরঘাট থানায় খবরটি জানানো হয়।
জানতে চাইলে সদরঘাট থানার ওসি মর্জিনা আক্তার বলেন, ‘সুদীপ্তকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে আঘাত করা হয়েছে- আমার কাছেও এমন মনে হচ্ছে না। তারা গুলি-ছুরি ব্যবহার করেনি। খুন করতে হলে এক-দুইজন আসতো পালানোর সুবিধার্তে। কিন্তু এসেছে ৭ থেকে ৮ জন। হকিস্টিক, লাটি এসব দিয়ে ‘সাইজ’ করতে গিয়ে হয়তো মারা গেছে।’
চট্টগ্রামের সরকারি সিটি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র সুদীপ্তর বাবা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক মেঘনাথ বিশ্বাস ওরফে বাবুল বিশ্বাস। মা আন্না বিশ্বাস গৃহিণী। দুই মাস আগে নগরের দেওয়ানবাজার এলাকায় একটি কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন সুদীপ্ত। তার ছোট ভাই একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মোস্তাইন হোসেন বলেন, রাজনৈতিক কারণে খুন হয়েছে বলে আমরা তথ্য পাচ্ছি। তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি আছে। পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ নিয়ে খুনিদের গ্রেফতার করা হবে।