সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

‘মালয়েশিয়ায় অনেক কষ্টে আছি, ভাষায় প্রকাশ করার মতো না’

প্রকাশিতঃ ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১০:০৬ অপরাহ্ন


শরীফুল রুকন : গত জানুয়ারিতে কলিং ভিসায় মালয়েশিয়ায় গিয়েছেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর বাসিন্দা মো. হাসান। এর আগে গত বছরের শেষের দিকে মালয়েশিয়ায় থাকা স্যামসাংয়ের একটি কারখানায় চাকরি দেওয়ার কথা বলে হাসানের কাছ থেকে ঢাকার একটি রিক্রুটিং এজেন্সি নেয় সাড়ে ৫ লাখ টাকা নেয়।

হাসান বলেন, “টাকা দেওয়ার দুই মাস পর যখন আমার কলিং আসে, তখন দেখি সেটা সিগ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানের। তখন আমি এজেন্সির মালিককে বলি, সিগ্যাল কেন? আমি তো স্যামসাংয়ের জন্য টাকা জমা দিয়েছি। তখন তিনি বলেছেন, তারা নাকি চুক্তি করেছে সিগ্যালের সাথে। আর স্যামসাং চুক্তি করেছে সিগ্যালের সাথে। চুক্তি অনুযায়ী, সিগ্যাল থেকে লোক নিয়ে যাবে স্যামসাং।”

রিক্রুটিং এজেন্সিটির মালিকের এমন কথায় বিশ্বাস করে পুরো সাড়ে ৫ লাখ টাকা দিয়ে মালয়েশিয়া চলে যান হাসান। হাসানের ভাষ্য, “মালয়েশিয়া আসার পর আমি অনেক কষ্টে আছি, ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। মালয়েশিয়ায় সিগ্যালের মতো খারাপ আর কোনো কোম্পানি নেই। এক রুমের মধ্যে আমার মতো ৬০ জনকে রেখেছে।”

একই রুমে থাকা আরেকজন প্রবাসী নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, “আমাকেও স্যামসাং কোম্পানিতে চাকরি দেবে বলেছিল এজেন্সি। কিন্তু পরে দেখি ডিমান্ড এসেছে, সিগ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। জানতে চাইলে বলে, তোমরা সিগ্যালে যাবে, কিন্তু কাজ করবে স্যামসাংয়ে। সেখান থেকে স্যামসাংয়ে নিয়ে যাবে। স্যামসাং সরাসরি লোক নিচ্ছে না।”

“কেন নিচ্ছে না, জানতে চাইলে বলে, এর আগে স্যামসাংয়ে ঝামেলা হয়েছে। এজন্য তারা সরাসরি নিচ্ছে না। এরা ভায়া হয়ে নিচ্ছে। এটা বলে আমাদেরকে পাঠিয়েছে। আসার পর আমাদেরকে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ দিয়েছে। কেউ ঢালাই দেয়, কেউ রড টানে। কেউ ড্রিল মেশিন চালায়। কিন্তু আমাদের ভিসা হয়েছে ফ্যাক্টরি ওয়ার্কার (কারখানার কর্মী) হিসেবে। ৪৯০ জনের সাথেই এমন প্রতারণা হয়েছে।”

“এসব নিয়ে প্রতিবাদ করলে বলে আমার ক্ষতি করবে, পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেবে। এমনকি বাড়িতে ফোন দিয়েও হুমকি দিয়েছে।” বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মালয়েশিয়া প্রবাসী এই ব্যক্তি।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় গিয়েছেন ৩ লাখ ২৯ হাজার ৪৩১ জন বাংলাদেশি।

অন্যদিকে গত ৭ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগের মহাপরিচালক দাতুক রুসলিন জুসোহ জানান, এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৩৫ হাজার ৮০২ জন অবৈধ (বৈধ কাগজপত্রহীন) অভিবাসীকে তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়েছে দেশটির অভিবাসন বিভাগ।

এর মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা কত তা জানা যায়নি। বর্তমানে মালেশিয়ায় মোট কতজন অনথিভুক্ত বা অবৈধ বাংলাদেশি রয়েছেন তার নির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই। তবে, সে সংখ্যা আড়াই লাখেরও বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছর মালয়েশিয়ায় যাওয়া অর্ধ লক্ষাধিক প্রবাসী বাংলাদেশিকে হতে হয়েছে চরম ভাগ্য-বিড়ম্বিত। তাদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে খালি হাতে দেশে ফিরেছেন, আর অনেকে ফেরার চেষ্টা করছেন।

নিরুপায় হয়ে অনেকেই প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছেন শেষ আশ্রয়স্থল বাংলাদেশ হাইকমিশন, কুয়ালালামপুরে। হাইকমিশনে থাকা বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে সাময়িক সমাধান মিলছে অনেকের, বলেছেন একাধিক প্রবাসী।

প্রতারণার ফাঁদে প্রবাসী শীর্ষক এই সিরিজের প্রথম পর্বে লোভের শিকার প্রবাসীরা শিরোনামে করা উক্ত প্রতিবেদনে সৌদি আরবে গিয়ে প্রতারণার শিকার ব্যক্তিদের দুর্দশা তুলে ধরা হয়। দ্বিতীয় পর্বের এই প্রতিবেদন ও পরবর্তী প্রতিবেদনে মালয়েশিয়ায় গিয়ে বিপদে পড়া প্রবাসীদের কথা ও সংকট থেকে উত্তরণের উপায় খোঁজার চেষ্টা করা হবে।

মালয়েশিয়ার কেদাহ এলাকায় বসবাস করা শাকিল হোসেন বলেন, “কলিং ভিসায় মালয়েশিয়া আসার পর আমার কোনো কাজ নাই। অন্য অনেকের সাথে আমাকেও বসিয়ে রেখেছে। এজেন্সির প্রতিনিধি দেখা করে না। একটা রুমে পাঁচজন থাকি। একটা টেবিল ফ্যান দিয়েছে। কোনো খাবার দিচ্ছে না। আমরা নিজে থেকে কিনে খাচ্ছি। কেউ বাড়ি থেকে টাকা এনে খাচ্ছে। কাজ না থাকলে অনেক কষ্ট।”

অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি তাদেরকে এমন বিপদে ফেললেও গণমাধ্যমের কাছে তাদের নাম প্রকাশে ভয় পান ভুক্তভোগী অনেক মালয়েশিয়া প্রবাসী। এর কারণ জানতে চাইলে একজন প্রবাসী বলেন, “রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে বললে তারা যদি বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়, তাহলে আমি আরও বিপদে পড়ে যাবো। কারণ ৫ লাখ টাকা খরচ করে এসেছি। কষ্ট করে হলেও টাকাটা তুলতে হবে। আবার অনেকেই পরিচয় প্রকাশ করে ঘটনা জানান না, কারণ তাদেরকে নির্যাতনের ভয় দেখানো হয়। আবার অনেকে পরিবারকে দুশ্চিন্তায় রাখতে চান না। যে কারণে তারা গণমাধ্যমের কাছে নিজেদের নাম-পরিচয়ও প্রকাশ করতে চান না।”

মালয়েশিয়া প্রবাসী সাংবাদিক রিয়াজ আহমেদ বলেন, “মালয়েশিয়ায় নতুন প্রবাসী কর্মী যারা এসেছেন কাজের জন্য, তাদের মধ্যে অনেকেই কাজ পাচ্ছেন না। এই বিষয়ে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো দায় এড়াতে পারে না। অথচ তারা উল্টো অমানবিক আচরণ করেন।”

“যে রিক্রুটিং এজেন্সি লোক পাঠায়, তার প্রতিনিধি মালয়েশিয়া থাকে। প্রতিনিধির কাছে যখন একজন প্রবাসী কর্মী বলে যে, আমাকে কাজ দিচ্ছেন না কেন? আমাকে আজকে এত মাস বসিয়ে রেখেছেন। তখন ওই প্রতিনিধি এক প্রকার টর্চার বা মানসিক চাপ প্রয়োগ করে প্রবাসী কর্মীকে। এজেন্সির প্রতিনিধি তাদেরকে আশ্বস্ত করতে থাকে, তোমাদের কাজ দেব, এতদিন লাগবে। অপেক্ষা করো। তোমরা হাইকমিশনে কোনো অভিযোগ করতে পারবে না। বেশি কথা বললে দেশে পাঠিয়ে দেব। এই কথাগুলো বলে।”

প্রবাসী সাংবাদিক রিয়াজ বলেন, “একটা লোক এজেন্সিকে পাসপোর্ট দিয়ে ফেলেছে। এমন অবস্থায় তিনি চিন্তা করেন যে, আমি টাকা খরচ করে মালয়েশিয়া এসেছি, আমার পরিবারকে সুখে-শান্তিতে রাখার জন্য। এখন যদি আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়, আমার পরিবারের দায়িত্ব কে নেবে? আবার দেখা যায়, ভুক্তভোগী কর্মীর হাতে পাসপোর্ট থাকে না, এজেন্সির প্রতিনিধি বা কোম্পানি নিয়ে ফেলে। ফলে অভিযোগ করার জন্য দূরে অবস্থিত হাইকমিশনে যেতে পারেন না ভুক্তভোগী। কারণ পাসপোর্ট না থাকায়, তাকে পুলিশ ধরে ফেলতে পারে। যদিও মোবাইলে অভিযোগ করা যায় হাইকমিশনে। কিন্তু সমস্যার কথা অনেকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেন না।”

তবে অভিযোগ পেলে মালয়েশিয়ার শ্রম অফিস ও বাংলাদেশ দূতাবাস সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে বলেও জানান তিনি।

১০ বছর ধরে মালয়েশিয়া থাকা চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার বাসিন্দা জাকির হোসেন বলেন, “আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে স্থানীয় কিছু বাংলাদেশি মালয় নারীদের বিয়ে করে এবং সে স্ত্রীর নামে কোম্পানি খুলে ভিসা বের করে। অনেক সময় এসব ভুয়া কোম্পানির অফিসও থাকে না। এসব কোম্পানির ভিসা কিনে অনেকের পথে বসার উপক্রম হয়।” জাকিরের পরামর্শ, “বহু বছর ধরে বিদেশে থাকা পরিচিত আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে ভিসা নিতে হবে। রিক্রুটিং এজেন্সির ফাঁদে পা দেওয়া থেকে বিরত থাকাই ভালো। নইলে বৈধভাবে এসেও অবৈধ হয়ে বিপদে পড়তে হবে।”

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মাইগ্রেশন স্টাডিজের কো-অর্ডিনেটর ড. মোহাম্মাদ জালাল উদ্দিন শিকদার বলেন, “মালয়েশিয়ায় গিয়ে অনেকেই বিপদে আছেন। গণমাধ্যমে এই বিষয়ে তেমন রিপোর্ট হচ্ছে না। কিন্তু ভুক্তভোগীরা বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে এসব জানাচ্ছেন। এ থেকে সেখানকার ভয়াবহ অবস্থা আমরা বুঝতে পারি।”

তিনি বলেন, “মালয়েশিয়ার যে কোম্পানিগুলো কর্মী নিয়ে গিয়েছে, তাদের অনেকে কাজ দিতে পারেনি, বসিয়ে রেখেছে। সাড়ে ৩ লাখ টাকা থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকায় মালয়েশিয়া গিয়েছেন একেকজন কর্মী। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে সিন্ডিকেট আছে। এত টাকা খরচ করে প্রবাসী কর্মীদের যদি মালয়েশিয়ায় রাস্তায় থাকতে হয়। এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কী আছে?”

ড. মোহাম্মাদ জালাল উদ্দিন শিকদার বলেন, “শ্রমিক নিয়োগ সংক্রান্ত চুক্তিগুলো নিয়ে আমরা গভীরভাবে ভাবছি না। মালয়েশিয়ার ভিসার প্রত্যয়ন দিতে হচ্ছে সে দেশে থাকা বাংলাদেশ হাইকমিশনকে। কিন্তু ভিসা দেওয়া সেই মালয়েশিয়ান কোম্পানি পরিদর্শন করতে পারছেন না বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তারা। মালয়েশিয়া সরকার লিখিতভাবে হাইকমিশনকে জানিয়েছে, মালয়েশিয়ান কোম্পানি পরিদর্শনের এখতিয়ার বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের নেই। তাহলে এটা কী ধরনের চুক্তি হলো? বাংলাদেশের কর্মকর্তারা সেই কোম্পানিগুলো পরিদর্শন করলে জানতে পারতেন, কর্মী নিয়োগের সক্ষমতা ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর আছে কিনা? এসব না করে আমাদের কর্মীদেরকে মালয়েশিয়া পাঠিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কিনা, সেই প্রশ্ন এখন আসছে।”

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, “আমার দেশের কর্মী যেখানে গিয়ে কাজ করবে, সেখানে আমার সরকার গিয়ে দেখতে পারবে না? তাহলে গোড়াতেই গলদ আছে? এমন কোম্পানি থেকে ভিসা দেওয়া হচ্ছে, যেগুলোর অস্তিত্ব নেই। অথবা দেখা যাচ্ছে ৫০ জনের ভিসা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু সেই কোম্পানিতে কাজ আছে মাত্র ১০ জনের। তখন বাকি ৪০ জনকে রাস্তায় থাকতে হচ্ছে। হাইকমিশন এসব বিষয় আগেই খতিয়ে দেখলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারতো। আমরা দেখছি, এটা সবসময় হচ্ছে, যেই দেশে আমাদের মানুষ যাবে, সেই দেশের মতো করে নথিপত্রগুলো তৈরি করা হয়। আমরা তাদের তৈরি করা নথিপত্রের সাথে একমত পোষণ করি, বলি যেভাবে পারো নিয়ে যাও। প্রবাসী কর্মীর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য এমন করা হচ্ছে।”

জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, “মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে বিভিন্ন সময় সরকারের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলেছি। সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের পথ খুঁজেছি। কিন্তু নানা জটিলতায় সমস্যার সমাধান হয় না।” নকল চাকরির ভিসায় কোনো শ্রমিককে বিদেশে না পাঠাতে প্রতিটি এজেন্সিকে সতর্ক করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

জনশক্তি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফর বলেন, “পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। দালালের প্ররোচনায় না পড়ে বৈধভাবে কাগজপত্র দেখে বিদেশে যাওয়ায় উৎসাহী করা হচ্ছে। নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”

আগামীকাল : প্রবাসে প্রতারণা: অভিযোগ না করায় ‘মিলছে না প্রতিকার’