আজাদ তালুকদার : উসকো-খুসকো চুল। তীব্র গরমেও জিন্স প্যান্ট, জিন্স শার্ট। লম্বা গোফের বাহার। এমন স্বভাব-চেহারা সৌষ্টবের এক তরুণ রাত হলে নগরে ঘুরে বেড়ান। পা-গাড়িই বাহন। দুপায়ের গাড়িতে চড়ে নিয়ন বাতির আলোয় ছুটতেন ঘর থেকে ঘরে।
না, অন্য কোনো কারণ নয়। পেটের দায়ে, পিঠের দায়ে অথবা মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার তীব্র এক দহন থেকে নিশাচর হয়েছিলেন এই তরুণ।
প্রশ্ন হতে পারে মানুষ হিসেবে বাঁচার জন্য নিশাচর হবেন কেন, রাতেই বা কেন ঘুরে বেড়াবেন শহরের অলি-গলি?
উত্তরটা একেবারে সাদামাটা। সরল সমীকরণ। পিতৃ-মাতৃহীন ৬ ভাইবোন, অসহায় নিকটাত্মীয় মিলে গড়ে প্রায় ১৮ জনের ভরণপোষণ ও পড়ালেখার খরচ জোগাতে টানা প্রায় ১০ বছর অনেকটা না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন এ তরুণ।
নিজের পড়াশোনা ঠিক রেখে দিনের বেলা ১০টি ব্যাচ পড়ানোর পর রাতভর শিক্ষার ফেরি করতেন। বিকাল থেকে ভোর পর্যন্ত পড়াতেন ১৩টি বাসায়।
ভালো পড়ান, ভালো শিক্ষক-এই তকমা ছড়িয়ে পড়ায় বাড়তি সুবিধাও ছিল তরুণের। ফলে রাতে ঘুমানোর সময়গুলোও কাজে লাগাতে পেরেছেন অনায়াসে।
অন্য শিক্ষকের কাছে পড়বেনই না যারা; তাদেরকেই তিনি মধ্যরাতে পড়ানোর শিডিউল দিতেন। রাত-দিন কিংবা মধ্যরাত তাদের জন্য কোনো ব্যাপার নয়। ‘স্যার’ পড়াতে রাজি হয়েছেন তাতেই তারা খুশি, উদ্বেলিত।
ভাঙাগড়া জীবন-গল্পের এই প্লট ফেরি করে জীবনতরী কূলে ভেড়ানো মানুষটার নাম শাব্বির ইকবাল; চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের বর্তমান সচিব। আজকের জায়গায় আসার পেছনের গল্পটি তাঁর অন্য দশজনের মতো নয়। নানা বৈপরীত্যে, বৈষম্যে, ব্যঞ্জনায় ভরা।
মাত্র আড়াই বছর বয়সে প্রয়াত হন ক্যান্সার-আক্রান্ত বাবা গোলাম রহমান চৌধুরী। ১১ সন্তানের পরিবারে তখন ঘোর অমানিশা। দুবেলা ভাতের নিশ্চয়তাবিধান যেখানে কঠিন, পড়ালেখার স্বপ্ন সেখানে দুঃস্বপ্ন-দুঃসাহস ছাড়া আর কিছুই নয়।
সেই দুঃসাহসী গল্পটা এগিয়ে নিতে যুদ্ধটা বড় বেশি দীর্ঘ হয়ে উঠে বাবা-হারা পরিবারটিতে। প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রায়-সব সন্তানকে মেট্রিকের গণ্ডি পর্যন্ত টেনে নিতেই হাফিয়ে উঠেন মা রিজিয়া রহমান।
বড় তিন ছেলে আপন চেষ্টায় গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে আপন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হন। বিশাল এ পরিবারের পাশে দাঁড়ান আন্তরিকতা ও প্রত্যয় নিয়ে। রাখেন নানাভাবে ত্যাগ ও অবদানের স্বাক্ষর। কিন্তু বিয়ে করে সংসারী হওয়ার পর তাদের সাহায্যের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। ফলে থমকে যায় অন্যদের পড়ালেখার চাকা।
তখনই চ্যালেঞ্জটা তুলে নিলেন পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান শাব্বির। জন্মস্থান কক্সবাজারের পেকুয়ার গুড়া মিয়া চৌধুরী (জিএমসি) ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৮৯ সালে এসএসসি পাশ করে নেমে যান সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়। চ্যালেঞ্জ কিংবা যুদ্ধের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিলেন চট্টগ্রাম। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তির সুযোগ পান চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজে।
লক্ষ্য শুধু নিজের পড়াশোনা নয়, পরিবারের সকলকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু তার আগে দরকার নিজের থাকা-খাওয়ার গ্যারান্টি। শিক্ষা বিকানোর বিনিময়ে সেই গ্যারান্টিও পেয়ে গেলেন নগরীর বাকলিয়ায়। সকাল-বিকেল পড়িয়ে দুবেলা আহার, সাথে সকালের নাশতা। আহা কী স্বস্তি! নিজের পেট-পিঠের চিন্তা আর নেই। চিন্তাটা এবার পরিজন নিয়ে।
‘চিন্তার চেয়ে চিতার আগুন ভালো’- চিন্তা দূর করতে প্রয়োজনে আগুনে ঝাঁপ দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ শাব্বির ইকবাল একে একে জোগাড় করে নিলেন ৬টি টিউশনি। উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্র হয়ে পড়িয়েছেন ১ম বর্ষের ছাত্রও।
’৯১-৯২ তে মাসেই উপার্জন ৫ হাজার টাকা; থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে পড়ানোর কাজটি তখন ছেড়ে দিলেন। নগরীর ডিসি রোডে ভাড়া নিলেন এক কামড়ার বাসা। নিজের খরচের জন্য যৎসামান্য রেখে বাকি টাকা পাঠিয়ে দিতেন পরিবারের জন্য। এর মাঝেই দায়িত্ব নিলেন পরিবার থেকে পড়াশোনার দায়িত্ব পালনে অক্ষম এমন একজন সহপাঠীর।
সতীশ চন্দ্র নামে এই বন্ধুটির বাড়ি রাঙ্গুনিয়ায়। একসঙ্গে পড়েন সিটি কলেজে। নিজের বাসায় রেখে ভরণপোষণের পাশাপাশি টিউশনির টাকায় বন্ধুর পড়ালেখার পুরো দায়িত্বটি কাঁধে তুলে নেন শাব্বির।
এই সময়টাতে স্বামীর লাঞ্চনা-বঞ্চনা সইতে না পেরে শাব্বিরব্র কাছে ৩ সন্তানসহ চলে আসেন ইমিডিয়েট বড়বোন। পর পর চলে আসেন অন্য ভাইবোন ও অসহায় স্বজনরা। বিপদগ্রস্ত বড়মামীও চলে আসেন কিছুকালের জন্য ২ মেয়েসহ। সবাইকে নিয়ে থাকার জন্য আগের ব্যাচেলর বাসা ছেড়ে ২ বেডের ফ্যামিলি বাসা নিলেন শাব্বির। সবমিলিয়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা কখনো বা ২০ ছাড়িয়ে গেছে। কাউকেই তিনি ‘না’ করতে পারেন না।
এবার শুরু হলো সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাবার সংগ্রাম। এই সংগ্রামে জয়ী হতে বেশি সময় লাগেনি। দিনে ব্যাচ পড়ানোর পাশাপাশি রাত জেগে টিউশনি করতেন। রাতের টিউশনিতে সে কি অভিজ্ঞতা তার!
ব্যাচে শাব্বির ইকবালের কাছে এক স্বজনের মাধ্যমে পড়তে গেলেন নবম শ্রেণী পড়ুয়া সাফিয়া ইসলাম। পরিচয়পর্বেই শিক্ষকের মোটা গোফ, লম্বা চুল, জিন্স শার্ট-প্যান্ট মোড়ানো শরীরের অদ্ভুত অবয়ব দেখে ভড়কে যান শিক্ষার্থী। না, এই শিক্ষকের কাছে কিছুতেই পড়বে না সে। তার ভাষ্য, তিনি মাস্টার নন, মাস্তান! আর মাস্তানের (!) কাছে পড়তে বসানোর জন্য ওই স্বজনের কী আকুলি-বিকুলি!
মজার ব্যাপার হচ্ছে, পরের সময়গুলোতে সেই শিক্ষার্থীর কাছে এই মাস্তানটাইপ (!) শিক্ষকই হয়ে উঠেন সেরা শিক্ষক। এমন শিক্ষকের নার্সিং পেয়ে মেয়েটিও নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ পান।
রাতের বেলা নগর ঘুরে টিউশনি করতে গিয়ে পুলিশের কত প্যাদানি যে খেতে হয়েছে তার হিসাব অনেক দীর্ঘ। সপ্তাহান্তে কমপক্ষে ২-৩ বার পুলিশের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। মধ্যরাতে উদ্ভট, ব্যতিক্রমী বেশভুষার কাউকে কাছে পাওয়া মানে বিরাট কিছু। খপ করে ধরেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতেন পুলিশ, পেয়ে গেছি পেয়ে গেছি ভাব!
: এতরাতে যাস কই!
: পড়াতে যাই।
: বেটা পাগল নাকি! এই মধ্যরাতে কেউ পড়াতে যায়! সত্যি করে বল কী করিস?
: সত্যি বলছি, পড়াতে যাচ্ছি।
সারা শরীর তল্লাশি করে একটি কলম ছাড়া আর কিছুই মেলে না। ধুর যা, সময়টাই লস-বলেই ধাক্কা দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচতেন পুলিশ।
শাব্বির ইকবালের মতে, পুলিশ তাকে জ্বালাতন করেনি, বরং তিনিই পুলিশকে প্রায় রাতে জ্বালিয়েছেন, হতাশ করেছেন। কারণ, একবুক আশা নিয়ে পুলিশ তাকে ধরে, আর ছাড়ে একবুক হতাশা নিয়ে।
পুলিশের ঘ্যানঘ্যানানি, শিক্ষার্থীদের প্যানপ্যানানিতে প্রতিদিন ভোর হতো শাব্বিরের। রাতের টিউশনিগুলোতে রাখা থাকতো টুথব্রাশ। যেখানেই ভোর হতো মুখে টুথব্রাশ চালিয়ে হালকা দানাপানি খেয়ে বেরিয়ে যেতেন ভোর ৬ টা হতে ব্যাচ পড়াতে। দুপুর ১২ টা পর্যন্ত চকবাজারের সমীকরণ কোচিংয়ে একটানা ব্যাচ পড়িয়ে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়তেন দুইটা বেঞ্চ জোড়া লাগিয়ে। এক-দেড়ঘণ্টা ঘুমিয়ে দুপুরে হোটেলে আহার, ফের ৩ টা থেকে শুরু হতো ব্যাচ পড়ানো।
একজন মানুষের দিনে যেখানে ন্যূনতম ৬ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন সেখানে মাত্র এক ঘণ্টা ঘুম সঙ্গী করে কাটিয়েছেন ১০ বছর। অবশ্য ছুটির দিনগুলোতে কখনোবা ২/১ ঘণ্টা রাতের বেলা ঘুমের সুযোগ হয়েছিল বৈকি। তবে ঈদের দিন কেউ পড়তো না বলে সারাদিন মনভরে ঘুমিয়েছেন ঈদের নামাজ-খাওয়া-বেড়ানো সব বাদ দিয়ে।
বলাবাহুল্য, এই ঘণ্টা দেড়েকের বিশ্রামই তার জীবন পাল্টে দিয়েছিল, ৩/৪ টি পরিবারের দায়িত্ব পালনের কঠিনযুদ্ধে সহায়তার হাত বাড়িয়েছিল। দিনজাগা, রাতজাগা জীবনের বিনিময়ে স্বচ্ছলতার দেখা যখন মিলে, তখনই নিলেন বাকলিয়ায় দুই বেডের বাসাটি। গাদাগাদি করে প্রতিরুমে ৫/৬ জন করে থাকতেন। রসায়ন-পদাথের বড় বড় বইগুলোই ছিল বালিশ। অন্যদের থাকার সুবিধার জন্য ৩-৪ দিন পর বাসায় আসতেন তিনি। তাদের পড়ালেখা, খাওয়া-দাওয়ার খোঁজ নিয়ে ফের বেরিয়ে যেতেন কঠিন ব্রত পালনে। নিজের পরীক্ষা আসলে আগের রাতে ৫০ টাকায় হোটেলের রুম ভাড়া করতেন। পরীক্ষার জন্য ওই একরাতের প্রস্তুতিই সম্বল।
অর্থাভাবে মেট্রিকের পর বন্ধ হয়ে যাওয়া বড় তিন ভাইবোনের পড়ালেখা পুনশ্চ শুরু করার উদ্যোগ নিলেন। আয়-উপার্জন তখন প্রায় ৫০ হাজার টাকা। এসময় কিছু ফার্নিচার, টিভি, কম্পিউটার কেনা হলো বাসায়। শাব্বিরের ঘামে-শ্রমে কষ্টের দিনগুলোও প্রায় শেষ।
মিশনটা এবার রক্তীয়দের মানুষ গড়ার, সুশিক্ষায় ব্রতী করার। বড় তিনজনের মধ্যে দুই বড় ভাইবোন উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলেন। ইমিডিয়েট বড় ভাই তো পাশ করলেন শাব্বিরের অন্তত ৪ বছর পর। তবে চেষ্টা করেও উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পার হতে পারেননি বড় বোন।
তাতে দুঃখ নেই শাব্বিরের; সমাজে বাড়বাড়ন্ত লোকসংখ্যার বিপরীতে কমে যাওয়া মানুষের সংখ্যার ক্ষুদ্র তালিকাটিতে স্বজনেরা যদি থাকে, থাকতে পারে সেটাই বড় প্রশান্তি তার কাছে। তাই তো পরিবারের কনিষ্ঠজনের জ্বালিয়ে দেওয়া শিক্ষার সলতেটির উপর ভর করে প্রায়সব ভাইবোন আজ আপন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, উজ্জ্বল মানুষের প্রতিচ্ছবি।
সময় গড়িয়েছে অনেক। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে রসায়নে অনার্স-মাস্টার্স করেছেন বেশ ক’বছর। কিন্তু কাজের ধরন, বেশভুষা পাল্টায়নি শাব্বিরের। বন্ধুরা তো বটেই, তার শিক্ষার্থীরাও চাকরি-বাকরি নিয়ে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। কী দরকার বেশি কিছুর! বাবার পরিবার, শিক্ষার্থীদের নিয়েই তো চলছে বেশ।
২০০২ সালে এক পড়ন্ত বিকেলে ২৪তম বিসিএস’র ফরম নিয়ে এলেন শাব্বির ইকবালের এক ছাত্র। বললেন, স্যার এই ফরমে সাইন করুন। বাকিসব আমরাই ফিলাপ করছি। ছাত্রের অনুরোধে সাইন করে দিলেন। এর বেশিকিছু আর জানেন না।
কিছুদিন পর প্রিলিমিনারির ডাক পড়লো। রাতভর ট্রেনে চড়ে ঢাকায় নামলেন। পরীক্ষা দিলেন। পরীক্ষা শেষে আবার চাপলেন চট্টগ্রামের ট্রেনে। টিকে গেলেন বিসিএস’র প্রাথমিক পরীক্ষায়। খবরটিও জানলেন ছাত্রের কাছে। লিখিত পরীক্ষায়ও ঠেলে ঠেলে পাঠালেন ছাত্ররাই। তাতেও ভালো করলেন। তাও জানলেন বন্ধু খোরশেদ কাদেরের কাছে। প্রথমে বিশ্বাস করতে চাননি। বন্ধু আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, এই যে রোল নম্বর!
এবার একটু নড়েচড়ে বসলেন। স্থির করলেন আর হেলা নয়, ভাইভার জন্য প্রস্তুতি নিবেন। প্রস্তুতি নিয়ে ভাইভাতে অংশ নিলেন। এরপরের গল্পটা নতুন জীবন, নতুন চ্যালেঞ্জের। চ্যালেঞ্জিং বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের কর্মকর্তা হয়ে গেলেন আগুনে পোড়া, জলে ভেজা জীবনতরীর মালিক শাব্বির ইকবাল।
২০০৫ সালের জুলাই মাস। সরকারের নির্দেশে চলে গেলেন ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার হয়ে। সেখানে সাড়ে তিনবছর কাটানোর পর সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বদলি হলেন একই পদে। সেখানে থাকলেন একবছর। এরপর ফরিদপুরের চরভাদ্রাসন উপজেলায় এসি ল্যান্ড হিসেবে আড়াই মাস থাকার পর বোয়ালমারীতে এসিল্যান্ড হিসেবে তিনবছর দায়িত্ব পালন করেন।
এখানে তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে। যে কোনো সমস্যা, বিপদ-আপদে মানুষ ছুটতেন তাঁর কাছে। নির্দিষ্ট দায়িত্বের বাইরে সাধ্যমতো সবাইকে তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন।
বেশ জমিজমার মালিক এক লোক ২৫ বছরের সংসার রেখে এক তরুণীকে বিয়ে করে ফেললেন। আগের স্ত্রী এই অভিযোগ নিয়ে এলেন ডাকসাঁইটে এসি ল্যান্ড শাব্বির ইকবালের কাছে। নিজের দফতরে ডাকলেন ওই লোককে। আদ্যোপান্ত শুনলেন, জানলেন। মগজধোলাই করলেন বেশ। কিন্তু কিছুতেই কাজ হয় না। ওই লোক ফিরে যাবেন না আগের স্ত্রীর কাছে।
শাব্বির ইকবাল অনেক বুদ্ধি খাটালেন, বের করলেন অভিনব এক কৌশল। বাধ্য করলেন, সিংহভাগ জমি আগের স্ত্রীর নামে লিখে দিতে। ভয়ে জবুথবু ওই লোক তাই করলেন। আগের স্ত্রীর নামে প্রায়সব জমি দান করে দেয়ার খবর শুনে বিগড়ে গেলেন নতুন স্ত্রী।
বললেন, তোমার সঙ্গে আর নয়। আমি যাচ্ছি বলেই চলে গেলেন। তারপর পাঠিয়ে দিলেন ডিভোর্স লেটার। আমও গেল, ছালাও গেল। ওই লোক এখন যায় কই! অনেক ভেবেচিন্তে আগের স্ত্রী-সন্তানদের কাছেই ফিরে গেলেন তিনি। শাব্বির ইকবালের বুদ্ধিমত্তায় রক্ষা পেলো একটি সংসার, কয়েকটি জীবন।
বোয়ালমারীর আরও এক মজার ঘটনা- একটি প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে পুরো উপজেলা তোলপাড়। লোকজন ধরে নিয়ে এলেন প্রেমিকযুগলকে। শাব্বির ইকবালের অফিসের সামনে তিন শতাধিক লোকের জমায়েত। সবার দাবি- তাদের প্রিয় এসি ল্যান্ড শাব্বির ইকবালকেই এর বিচার করতে হবে। তাদের কঠিন শাস্তি দিতে হবে অথবা নির্বাসনে পাঠাতে হবে।
টান টান উত্তেজনায় বিচারে বসলেন এসি ল্যান্ড। সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। উপস্থিত লোকজনের কঠিন শাস্তির দাবির বিপরীতে দেখলেন প্রেমিকযুগলের অপরাধের যে মাত্রা তাতে বড়জোড় তিনশ’ টাকা জরিমানা করা যায়। এর বেশি শাস্তি কোনোভাবেই আইনে কাভার করে না। কিন্তু তিনশ’ টাকা জরিমানার কথা শুনলে তো বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
প্রথমে সবাইকে পিনপতন নীরবতার আওতায় নিয়ে এলেন শাব্বির ইকবাল। তারপর শুরু করলেন। বললেন, এই উপজেলার মানুষ অত্যন্ত কর্মনিষ্ঠ, সময়জ্ঞান নিয়ে চলেন বলে আমি জানতাম। একারণে তাদের আমি ভালোবাসি, কর্তব্যের বাইরেও সাধ্যমতো তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু আজকের এই ঘটনায় আমি যারপরনাই বিস্মিত। আমার অবাক লাগছে এতগুলো কর্মমুখর মানুষ মূল্যবান সময় নষ্ট করে, নাওয়া-খাওয়া ভুলে আইনের বিধান অনুযায়ী তিনশ’ টাকা জরিমানা করা যায় এমন একটা খেলু, হাস্যকর ঘটনার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠতে পারে।
সঙ্গে সঙ্গে সবাই যেন নুয়ে পড়লেন। এরপর দুঃখপ্রকাশ করে একে একে সবাই চলে গেলেন। শাব্বির ইকবালের উপস্থিত বুদ্ধিতে জনতার রুদ্ররোষ থেকে সেদিন প্রেমিকযুগল বেঁচে গেলেন তিনশ’ টাকা অর্থদণ্ডের বিনিময়ে।
সামাজিক সংঘাত ও অবক্ষয় রোধে বোয়ালমারীতে তিনবছরে হাজার হাজার (রেকর্ডভুক্ত ৭শ’) ঘটনার মীমাংসা করে শাব্বির ইকবাল বোয়ালমারী উপজেলার মানুষের কাছে আজও কিংবদন্তি হয়ে আছেন।
প্রসঙ্গত, স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ আগুন-সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিল বাঁশখালী আদালত। ২০১৩ সালে বিএনপি-জামাত তাণ্ডব চালিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিল বাঁশখালী আদালতের পুরোনো ভবন, শত বছরের প্রাচীন নথিপত্রও। বাঁশখালীর তৎকালীন ইউএনও শাব্বির ইকবালের অসীম সাহস ও দৃঢ়চেতা মনোভাবে এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে দ্রুততম সময়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল বিধ্বস্ত বাঁশখালী, বাঁশখালীর মানুষ।
বলাবাহুল্য, এখানেও বহু সামাজিক জটিলতার সমাধান দিয়ে আলোচনার ঝড় তুলেছিলেন শাব্বির ইকবাল। আজ এমনই এক ঘটনা বলি পাঠকদের।
এক নৈশপ্রহরীর বিরুদ্ধে পরকীয়া প্রেম ও নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে সকালবেলা ইউএনও অফিসে হাজির হলেন এক নারী। কক্ষে প্রবেশ করে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন তিনি। ইউএনও তাকে শান্ত করলেন। আপ্যায়ন করালেন। তারপর শুনলেন স্বামীর বিরুদ্ধে মহিলার অভিযোগনামা।
সঙ্গে সঙ্গে ডেকে পাঠালেন স্বামীকে। ইউএনও স্যার ডেকেছেন-না এসে উপায় নেই। তড়িৎ হাজির। স্ত্রীর কোনো অভিযোগই খণ্ডাতে পারেন না তিনি। স্বামী কথা দিলেন আর কখনো এমন হবে না, স্ত্রীর প্রতি অবিচার করবেন না। হাত ধরাধরি করে সেদিন বাড়ি ফিরলেন দুজন। কিন্তু এক সপ্তাহ না যেতেই স্বামী ফের পুরোনো চেহারায়। স্ত্রী আবারও হাজির ইউএনও’র দরবারে। শান্ত করে, বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, দেখি কী করা যায়, সময় করে আপনাকে ডেকে নেব।
এরপর ইউএনও নিজেই গেলেন শেকল বানানোর দোকানে। ২০ হাত লম্বা একখানা শেকল বানিয়ে নিয়ে আসলেন। অতপর ডেকে আনলেন স্বামী-স্ত্রী দুজনকে। স্বামীর চোখেমুখে তীব্র অপরাধবোধ। ইউএনও স্যারের কথা তিনি রাখেননি। ইউএনও’র প্রশ্ন- এখন কী শাস্তি দেব আপনিই বলুন। অবনত নৈশপ্রহরী জানালেন, স্যার আপনি যে শাস্তিই দেন আমি মেনে নিব।
আর তখনই শেকলটা বের করে আনলেন। পরিয়ে দিলেন দুজনের হাতে। তালা লাগিয়ে চাবিটা রেখে দিলেন নিজের ড্রয়ারে। শেকলপরা স্বামী-স্ত্রী বাড়ি ফিরে গেলেন। স্ত্রী রান্নাঘরে গেলে স্বামীকেও যেতে হয়, বাথরুমে গেলে সেখানেও সঙ্গী স্বামী। একইভাবে স্বামীর সবকিছুতেই স্ত্রীর বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ। এক বাঁধনে একসপ্তাহ থাকার পর ব্যাকুল হয়ে উঠেন স্বামীবেচারা। ইউএনও’র কাছে গিয়ে স্বামী বললেন, স্যার আমার শিক্ষা হয়ে গেছে, এবার বাঁধনটি খুলে দিন। স্ত্রী ছাড়া আমার গতি নেই। সেদিন শেকলের বাঁধন ইউএনও খুলে দিলেন। কিন্তু মনের বাঁধনে এখনো রয়ে গেছেন তারা। একজনকে ছাড়া আরেকজন কিছুই ভাবতে পারেন না। বলা চলে, এখন তারা বেশ সুখী দম্পতি।
অন্যের সংসার জোড়া লাগালেও টানা জীবন সংগ্রামের কারণে নিজের ব্যাচেলর জীবনের অবসান ঘটাতে অনেক দেরী হয়ে যায় শাব্বিরের। বিয়ে করার ফুরসত পান চাকরিতে ঢোকার আরও ১০ বছর পরে। তাদের সংসারে এখন দেড় বছরের ফুটফুটে এক মেয়ে।
বাঁশখালীতে তিনবছর থাকার পর শাব্বির ইকবাল যোগ দেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে। সেখানে তিনমাস থাকার পর তার পোস্টিং হয় চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সচিব হিসেবে। তিনবছর ধরে আছেন স্থানীয় সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ পদে। জেলা পরিষদের উন্নয়ন-অগ্রগতি নিরন্তর মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি জনমানুষের সঙ্গে নিবিড় সেতুবন্ধন তৈরি করে শাব্বির ইকবাল প্রমাণ করেছেন তিনি সরকারের বড় কর্মকর্তা কিংবা আমলা নন, প্রকৃতার্থেই তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, জনগণের সেবক।