ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ : আমাদের দেশের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের পাশাপাশি নার্স, উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, মিডওয়াইফ, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এবং ফার্মাসিস্টদের মতো সহায়ক স্বাস্থ্য জনবল কর্মরত। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কয়েক দফা নিয়োগের মাধ্যমে সাধারণ চিকিৎসকের এবং নার্সের ঘাটতি বেশ খানিকটা পূরণের চেষ্টা করা হয়েছে। এখনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ৫৮ শতাংশ পদ, সাধারণ চিকিৎসকের ২৫ শতাংশ আর নার্সদের ১০ শতাংশ পদ শূন্য রয়েছে।
সাধারণ চিকিৎসকের বাকি ঘাটতি পূরণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক তিন ধাপে ছয় হাজার চিকিৎসক নিয়োগের সুপারিশ সাধুবাদ জানাই। আশা করি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহ অর্থাৎ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয় এই সুপারিশ বাস্তবায়নে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
দীর্ঘ বিরতির পর অতিসম্প্রতি মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদেও বড় একটি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু মিডউইফেরি, ফার্মাসিস্ট, উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার এবং ডমিসিলিয়ারি স্টাফ পদে যথাক্রমে ৬২, ৪২, ৩২ এবং ২১ শতাংশ পদ শূন্য রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এইসব বিষয়ে নিয়োগ না হওয়ায় জনগণ যেমন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে এইসব বিষয়ে পড়াশোনা করা হাজার হাজার যোগ্য প্রার্থী বেকার রয়েছে।
এদের মধ্যে একটি বড় গ্রুপ হলো স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় অনুমোদিত, রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ কর্তৃক অধিভুক্ত, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল স্বীকৃত মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) [Medical Assistant Training School-MATS]-এর মাধ্যমে ‘ডিএমএফ’-ধারী মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট প্র্যাকটিশনার।
স্বাধীনতার পর দেশে চিকিৎসকের তীব্র সংকট মোকাবিলা করতে বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৩-১৯৭৮)-এর মাধ্যমে এই মেডিকেল শিক্ষার সূত্রপাত হয়। এইসব মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট প্র্যাকটিশনাররা সাধারণত জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন-উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার পদে নিয়োজিত হয়। কিন্তু বর্তমানে দুই হাজার পদ শূন্য রয়েছে।
একযুগ ধরে এই পদে নিয়োগ না হওয়ায় প্রায় ২৫ হাজার ডিপ্লোমা চিকিৎসক এখন বেকার। উল্লেখ্য, বর্তমানে ১৬টি সরকারি ম্যাটস ও প্রায় ২০০টি বেসরকারি ম্যাটস ডিপ্লোমা মেডিকেল ‘ডিএমএফ’ কোর্সে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় অর্ধ লাখ। তাই প্রতিবছর বেকারত্বের সারিতে আরও অনেকে যুক্ত হচ্ছে।
২০২২ সালের হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (Household Income and Expenditure Survey-HIES)-এর প্রিলিমিনারি রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে এখনো হাতুড়ে ডাক্তার বা ফার্মেসির দোকানির সম্মুখীন হয়। তাই গ্রাম, চর, হাওর, কোস্টাল এবং পাহাড়ি এলাকাসহ যেখানে গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসকরা যেতে চায় না বা থাকতে চায় না সেইখানে ডিপ্লোমা চিকিৎসকদের নিয়োজিত করলে মানুষের গুণগত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির পথ সুগম হবে।
গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার গুণগতমান বৃদ্ধি এবং রেফারাল পদ্ধতি চালু করতে হলে প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে একজন ডিপ্লোমা চিকিৎসক এবং একজন নার্স / মিডউইফ নিয়োগের কোনো বিকল্প নেই।
অন্যদিকে, ডিপ্লোমা চিকিৎসকদের বেসরকারি হাসপাতালে কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই, কারণ বেসরকারি হাসপাতাল নিবন্ধন নীতিমালার অর্গানোগ্রামে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট প্র্যাকটিশনার তথা ডিএমএফ-এর কোনো পোস্ট নেই। তাই তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল হলো প্রাইভেট প্র্যাকটিস।
উল্লেখ্য, ডিপ্লোমা চিকিৎসকগণ বাংলাদেশ মেডিকেল এবং ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) কর্তৃক সীমিত আকারে প্রেসক্রিপশন করার অনুমতিপ্রাপ্ত। আর এর জন্য ডিএমএফ কোর্স কারিকুলাম বাস্তবিক প্রশিক্ষণ তথা ইন্টার্নশিপ থাকা বাধ্যতামূলক করা উচিত, যা ১৯৭৬ সালে শুরু হওয়ার পর থেকে এতদিন চালু ছিল।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ স্বাক্ষরিত ১৩-০২-২০২৩ তারিখে বারচিঅ/১৬/২০২৩/১৬৯ স্মারকে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং কোর্স (ম্যাটস)-এর নতুন কারিকুলামে বাস্তবিক প্রশিক্ষণ তথা ইন্টার্নশিপসহ চিকিৎসা শিক্ষার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমূহ বাদ দেওয়া হয়েছে, যা তাদের দক্ষ জনবল হিসেবে গড়ে ওঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
যেহেতু পাশকৃত ডিএমএফ পেশাদাররা চিকিৎসা সেবার মতো অতিসংবেদনশীল কার্যক্রমের সাথে জড়িত। অসঙ্গতিপূর্ণ কোর্স কারিকুলাম বাস্তবায়িত হলে তা জনগণের চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ।
এইসব বিষয় নিয়ে ম্যাটস শিক্ষার্থীদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ ডিপ্লোমা মেডিকেল স্টুডেন্ট’স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএমএসএ) বিভিন্ন সময়ে আবেদনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু এতে আশানুরূপ কোনো সাড়া না পাওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধভাবে ১৬ আগস্ট ২০২৩ থেকে ‘সাধারণ ম্যাটস শিক্ষার্থী ঐক্য পরিষদ’ ব্যানারে সংগঠিত হয়ে সারাদেশে একযোগে চার দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস বর্জন ও ছাত্র ধর্মঘট পালন করছে।
তাদের দাবিগুলো হলো—
১। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ১ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী উচ্চশিক্ষার সুযোগ;
২। অনতিবিলম্বে চার বছরের একাডেমিক কোর্স বহাল রেখে পূর্বের ন্যায় ১ বছরের ইন্টার্নশিপসহ অসঙ্গতিপূর্ণ কোর্স কারিকুলাম সংশোধন;
৩। অনতিবিলম্বে শূন্য পদে নিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃজন;
৪। এলাইড হেলথ শিক্ষা বোর্ড বাতিল করে ‘মেডিকেল এডুকেশন বোর্ড অব বাংলাদেশ’ নামে বোর্ড গঠন করা।
এই দাবিগুলোর মধ্যে ইন্টার্নশিপ বহাল রাখা এবং শূন্য পদে নিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃজন বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সারা বিশ্ব যখন ‘এভিডেন্সড বেসড মেডিকেল শিক্ষায়’ ব্রত হয়েছে তখন আমাদের দেশে ডিপ্লোমা মেডিকেল শিক্ষায় ইন্টার্নশিপ বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত কি আত্মঘাতী নয়? কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের যোগসাজশে এই ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকলে তা খুঁজে বের করে তাদের অতিশিগগিরই আইনের আওতায় আনা উচিত।
অন্যদিকে, উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের শূন্য পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনো জটিলতা থাকলে তা দূর করে শিগগিরই নিয়োগ সম্পন্ন করা উচিত। অধিকন্তু, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং তৈরি পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মেডিকেল টিম-এ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। পাশাপাশি নার্স, মিডওয়াইফ, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এবং ফার্মাসিস্টদের মতো গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক স্বাস্থ্য জনবলের শূন্য পদে নিয়োগ দান অপরিহার্য।
মনে রাখা দরকার, একটি বিল্ডিং নির্মাণে রড, ইট, সিমেন্ট কিংবা পাথর কুচি এবং বালুর গুরুত্ব যেমন একটি থেকে অন্যটির কম নয়, তেমনি সহায়ক জনবল ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে সেবা দান সম্ভাব নয়। আশা করি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব মহল চিকিৎসক নিয়োগের পাশাপাশি সহায়ক জনবলের শূন্য পদ পূরণেও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক।