রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

হেরে গেলেন আজাদ তালুকদার

প্রকাশিতঃ ২ অগাস্ট ২০২৩ | ১১:৫৯ অপরাহ্ন


হোসেন আবদুল মান্নান : আজাদ তালুকদার চলে গেলেন। (ইন্না-লিল্লাহ ওয়া ইন্না-লিল্লাহ রাজিউন) আমার বুকের চাপা দুঃখ প্রকাশ করতে আজকের সকালটাও যেন অঝোরে কেঁদে ওঠলো। ঘুম ভাঙ্গা চোখে জানালার গ্রিল ধরে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম সোজা পান্থপথের বিআরবি হাসপাতালের দিকে। দেখলাম, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে রাস্তা ঘাট, গাছপালা, উড়ালসেতু, জনজীবন। আমি কাকে ফোন করে কী বলবো? কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

২. আজাদ পেশায় একজন সাহসী সাংবাদিক ছিলেন। সাধারণত আমরা যেভাবে দেখি, আজাদ ছিলেন একটু ভিন্নতর ব্যতিক্রম। গত দু’বছর ধরে আজাদ তালুকদার ক্যানসারের সঙ্গে বাস করে চলেছিলেন। বাংলাদেশ ও ভারতের নানা স্থানে নানা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। হাসপাতালের বিছানা থেকেও লেখালেখিতে ব্যস্ত থেকেছেন। পাঠককে সবসময় হালনাগাদ রেখেছেন। ক্যানসার রোগীদের মধ্যে এতটা মনোবলে বলীয়ান ও আত্মবিশ্বাসী হতে আমি আর কখনও দেখিনি।

বাঁচার আকুতি কার না থাকে? পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার বেদনা চিরন্তন। তবে আজাদের ছিল অন্যরকম। আজাদ যেন এক জ্বলন্ত উদাহরণ। বলতেন, “আমি বেঁচে থাকবো। মহান আল্লাহ আমাকে দিয়ে আমার স্বপ্নগুলো পূরণ করাবেন নিশ্চয়ই”।

৩.চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘একুশে পত্রিকা’র সম্পাদক ছিলেন তিনি। পত্রিকাটি পাক্ষিক থেকে সাপ্তাহিক হয়ে এখন বৃহত্তর কলেবরে প্রকাশিত হয়ে আসছে। সংবাদ এবং প্রতিবেদন তৈরির নিজস্বতায় বুদ্ধা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ডাকযোগে প্রতিটা সংখ্যাই আমার জন্য বরাদ্দ রাখা হত।

পত্রিকাটি ঘিরেই আজাদের অধরা স্বপ্নগুলো তাঁর চোখের আলোয় নেচে ওঠতো। এটা দৈনিক হবে, জাতীয় দৈনিক হিসাবে একদিন দেশব্যাপী ঝড় তুলবে, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করবেন আজাদ তালুকদার এবং তাঁর নিবেদিতপ্রাণ কর্মী বাহিনী। আরও কতকিছু নিয়ে এক পৃথিবী ভাবনা ছিল তাঁর। আজাদ আমার কাছে অকপটে তাঁর নিজের এমন কথাগুলো বলতেন।

আমিও তাঁকে প্রাণিত করতাম, শাণিত করতাম। আপনি পারবেন আজাদ। মানুষের স্বপ্ন বৃথা যায় না।

৪. চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক এবং পরবর্তীতে বিভাগীয় কমিশনার হিসাবে সরকারি কাজের সুবাদে তাঁকে খুব কাছে থেকে দেখা বা বিবেচনা করার সুযোগ হয়েছিল। মনে পড়ে, আমাকে তাগাদা দিয়ে লেখা আদায় করে নিতেন আজাদ। তখন থেকেই তিনি তাঁর একুশে পত্রিকায় নিরবিচ্ছিন্নভাবে আমার লেখা ছাপাতে থাকে। আমি যেন নিয়মিত লিখতে পারি সে জন্যও তাঁর বিচিত্র কৌশল ছিল। সত্যিই আজাদ অসাধারণ মেধাবী ও প্রত্যয়ী ছিলেন।

উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমার গ্রামের বাড়িতে সন্ত্রাসীরা হামলা করলে দেশজুড়ে নিন্দার তুফান বয়ে যায়। আজাদ তাঁর পত্রিকায় শিরোনাম করেছিলেন, ‘একজন হোসেন আবদুল মান্নানের ওপর হামলা, পতনোন্মুখ সময়ের সাইরেন’।

৪. আজাদকে শেষবার বিআরবি হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম গত ২১ জুলাই দুপুরে। ডাক্তার ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরিবেষ্টনে থেকেই তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি আমার হাতে আপনার হাতটা রাখুন, আপনি আমার একজন সত্যিকারের সুহৃদ ও বন্ধু’।

শারীরিক যন্ত্রণার ভেতরেও একজন চিকিৎসককে বলছিলেন, ‘ওনি সাবেক স্বাস্থ্য সচিব’। আরও বলেছিলেন, ‘ক’দিন আগে রানুসহ আপনার বাসায় গিয়ে অনেক তৃপ্তির সঙ্গে ভাত খেয়েছিলাম’। আমি খানিকটা বিব্রতবোধ করলেও আজাদ তালুকদার তো এমনই ছিলেন।

তাঁর আত্মার মাগফিরাত ও অনন্ত শান্তি কামনা করছি।

লেখক : সাবেক সচিব, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক।