শরীফুল রুকন : অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন ও জাতীয় ঔষধ নীতি-২০১৬ প্রণয়নের বিশেষজ্ঞ কমিটির আহ্বায়ক। ২০০৯ সালে প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে শিশুমৃত্যুর ঘটনার পর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি অধ্যাপক আ ব ম ফারুককে টিম লিডার করে একটি বিশেষজ্ঞ পরিদর্শন দল গঠন করে। ওই দলের কাজ ছিল ওষুধ কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা যাছাই করে প্রতিবেদন দেওয়া। নিজের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অধ্যাপক ফারুক ওষুধ কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে ডাক্তারদের দেওয়া ঘুষ আর ওষুধ বিপণনের ধরন প্রত্যক্ষ করেছেন।
দেশের চিকিৎসকরা কখন থেকে ওষুধ কোম্পানির টাকা-উপহারে বিক্রি হচ্ছেন— জানতে চাইলে অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ‘আমাদের দেশে এই খারাপ চর্চার ইতিহাসটা অনেক পুরনো। আমাদের দেশে পাকিস্তান আমলে বিদেশি কোম্পানিগুলো ডাক্তারদের উপহার দেওয়ার কাজটি প্রথম শুরু করে। বিদেশি কোম্পানিগুলোর ওষুধ ভালোই ছিল। কিন্তু তাদের সম্পর্কে দুটি অভিযোগ ছিল আমাদের। একটা হলো তাদের ওষুধের দাম অনেক বেশি। যদিও তাদের অধিকাংশ ওষুধের মান ভালো ছিল। দ্বিতীয়ত তাদের কিছু কিছু ওষুধ ক্ষতিকর বা অপ্রয়োজনীয় ছিল।’
অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে মনে করা হতো, যতই ক্ষতিকর বা অপ্রয়োজনীয় হোক— বিদেশি কোম্পানি মানে একটা বিশাল দেবদূত টাইপের ব্যাপার এবং তারা যা বানাচ্ছে সবই ভীষণ ভালো। অতএব এগুলো আমরা চোখ বুঁজে ব্যবহার করবো। তার মানে প্রেসক্রিপশন, বিক্রয়, ব্যবহার— তিন পক্ষের অসম্ভব একটা বিশ্বাস ছিল বিদেশি কোম্পানিগুলোর ব্যাপারে। এই সুযোগে বিদেশি কোম্পানিগুলো ডাক্তারদেরকে প্রভাবিত করতে উপহার দিত। প্রথমদিকে উপহারগুলো ছিল প্যাড, কলমের মত ছোট জিনিস। কিন্তু ধীরে ধীরে এটা বাড়তে লাগলো। দেখা গেল, স্বর্ণালংকার, রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন এগুলো উপহার দেওয়া শুরু হলো। কিছু উপহারের কথা কেউ জানতই না। সেগুলো হচ্ছে বিদেশে সেমিনার, কনফারেন্সগুলোতে ডাক্তারদের যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়ার ব্যয় কোম্পানি বহন করত। তখন ডাক্তাররা এটাকে সম্মানজনক ব্যাপার বা স্কলারশিপের মতো মনে করতেন। যে ডাক্তার কোম্পানির টাকা নিয়ে বিদেশে যান তিনি তো ওই কোম্পানির প্রতি মানসিকভাবে প্রচণ্ড রকমের দুর্বল থাকবেন এবং তাদের পণ্য তিনি লিখবেনই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের এই সাবেক পরিচালক আরও বলেন, স্বাধীনতার পর দেশের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুব আগ্রহ ছিল। তিনি ওষুধের দাম কমাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, এসব বিষয়ে সুপারিশ দিতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেন ১৯৭৩ সালে। কমিটির প্রধান করা হয় চট্টগ্রামেরই কৃতি সন্তান, জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত ডা. নুরুল ইসলামকে। ওই কমিটি দেশের ওষুধ শিল্পের উন্নয়নে বেশ কিছু সুপারিশ করে। সেখানে বলা ছিল, ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বিদেশ থেকে আনা যাবে না। এসব সুপারিশ বঙ্গবন্ধু বাস্তবায়ন করলে বিদেশি কোম্পানির ব্যাপক সংখ্যক ওষুধের দেশে প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় চাহিদার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো।
কমিটির সুপারিশের মধ্যে আরও ছিল, ওষুধ কিনতে হবে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক দামে। অর্থ্যাৎ ইংল্যান্ডে তৈরি একটি ওষুধ আনলে যে খরচ পড়ে, সেই ওষুধ যদি হাঙ্গেরি থেকে আনা হয় তাহলে হয়তো এর অর্ধেক খরচ পড়বে। তাহলে হাঙ্গেরি থেকে আনতে হবে, যদি মান ঠিক থাকে। মানের ব্যাপারে কোনো আপস করা যাবে না। কিন্তু দামের ব্যাপারে আপস করতে হবে, প্রতিযোগিতামূলক দামে আনতে হবে। যেখানে কম পাবে, সেখান থেকে আনতে হবে। এটা ছিল তৎকালীন সরকারের নীতি। এই নীতিগুলোর ফলে চিকিৎসকদের উপহার প্রদানের বিষয়টি কিছুটা কমে আসে। কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামের কাছ থেকে এসব কথা শুনেছেন বলে জানান তারই ছাত্র অধ্যাপক আ ব ম ফারুক।
অধ্যাপক ফারুক বলেন, ‘এরপর ১৯৮২ সালে যখন ওষুধনীতি প্রণয়ন করা হয়, তখন ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর আমলে নেওয়া ভালো সিদ্ধান্তগুলো আবার ফিরিয়ে আনা হয়। ফলে বিদেশি ওষুধ কোম্পানিগুলোর জন্য এই দেশে ব্যবসা কঠিন হয়ে যায়। দেশে ব্যাপকহারে ওষুধ উৎপাদন শুরু হলে দামও কমে যায়। ১৯৮২ সালের ওষুধনীতিতে বলা হয়, অনৈতিক বিপণন চর্চা করা যাবে না। কারণ, উপহারের দামটা তো দিচ্ছেন রোগী। কোম্পানি ওষুধের দামের সঙ্গে এগুলো যোগ করছে, ফলে ওষুধের দাম বাড়ছে। কিন্তু অনৈতিক বিপণনচর্চা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকদের উপহারের বিষয়ে আমেরিকায় খোঁজ নিয়েছিলাম। সেখানে আমার বন্ধুরা বললেন, আমাদেরকেও ওষুধ কোম্পানি গিফট দেয়, কিন্তু সেটা ৫ ডলারের বেশি দামের হতে পারবে না। অন্যদিকে আমাদের দেশে উপহার সীমাহীন। গাড়ি-বাড়ি কারা যাবেন, এটা নির্ভর করে, কে কত রোগী দেখেন। দিনে সময় নিয়ে ২০ জন রোগী দেখেন, ভালো ডাক্তার, তিনি কোম্পানির কাছে গুরুত্ব পাবেন না। গুরুত্ব পাবেন তিনিই, যিনি দিনে ১০০-২০০ রোগী দেখেন। ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতার ফলে গিফটের আকার ও সংখ্যা এখন বেড়েছে। এই টাকাটা আসছে রোগীর পকেট থেকে। এটা তো কোম্পানির লাভ থেকে আসছে না। এটাই আমাদের জন্য উদ্বেগের। কারণ গাড়ি দেওয়ার কারণে কম কার্যকর, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি এমন ওষুধ লিখছেন চিকিৎসকরা। আবার সবে এমবিবিএস পাস করা একজন ডাক্তার যদি কোম্পানিকে বলে আমাকে গাড়ি দিন, দেবে না। তাকে প্রমাণ করতে হবে, গাড়িটা দিলে যে টাকাটা যাবে, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা তার মাধ্যমে কোম্পানি অর্জন করতে পারবে। তাহলেই দেবে। ডাক্তাররা গাড়ি-বাড়ি নিচ্ছে। আর লোন শোধ করছে ওষুধ কোম্পানি। ঘুষ দেওয়ার খুবই আধুনিক একটা পদ্ধতি এটা। এগুলো ধরার উপায় নেই। এখন যতই সময় যাচ্ছে লোকজন বুদ্ধিমান হচ্ছে।’
‘এর মাধ্যমে দুটি ঝুঁকি। এক. দাম বেড়ে যাচ্ছে ওষুধের। আরেকটা হচ্ছে, কম কার্যকর, বেশি ক্ষতিকর, বেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যুক্ত ওষুধ রোগীর শরীরে চলে যাচ্ছে। এতে রোগীর শরীরের কোন অংশের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে, কিডনিসহ নানা অঙ্গপ্রতঙ্গ নষ্ট হতে পারে। মারাও যেতে পারে। ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতিতে অনৈতিক বিপণন বন্ধের কথা বলা হলেও বন্ধ হয়নি। সমস্যাটা এত ব্যাপক, এত গভীর এবং এত বেশি সংখ্যক লোক এটার সুবিধাভোগী, যার কারণে নিয়ন্ত্রণ করাটা খুবই কঠিন ব্যাপার।’ বলেন অধ্যাপক ফারুক।
তিনি বলেন, ‘আমরা বলি, উপহার প্রদানের একটা লিমিট করে দেওয়া হোক। যেটা আমেরিকা করে রেখেছে, একবারে একটা গিফট দিতে গেলে ৫ ডলারের বেশি দিতে পারে না। কারণ আমরা পুরোপুরি বন্ধ করতে পারবো না হয়তো। অনেক ওষুধ কোম্পানি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য উপহার দিতে বাধ্য হয়। দুটি কোম্পানির মালিক আমাকে বলেছেন, আমরা ওষুধের ব্যবসা করি, আমাদের বলা মুশকিল। আমরা কিছু বললে ডাক্তাররা ক্ষেপে যাবে, আমাদের উপর। আমাদের কোম্পানির ওষুধ লিখবেই না। ডাক্তারদের ডিমান্ড বাড়ছেই, বিষয়গুলো নিয়ে আপনারা কিছু বলুন। তার মানে ওষুধ কোম্পানি সবাই যে এই ধরনের গিফট দিতে চায় তা নয়। অনেকেই চায়, একটা ভালো পরিবেশ আসুক। বাধ্য হয়েই তারা চিকিৎসকদের টাকা-উপহার ইত্যাদি দেয়।’
মূল প্রতিবেদন : ডাক্তারদের পটাতে চেক বাড়ি গাড়ি সবই